ঈদ মানেই নতুন শাড়ি। বাহারি নকশা, নান্দনিক মোটিফ, কাপড়ের ধরন শাড়ির সৌন্দর্য মেলে ধরে। পরিধানরীতি ও অন্যান্য কারণে নারীর কাছে শাড়িই সেরা।  লিখেছেন রিক্তা রিচি

স্বস্তিকা বরাবরই শাড়িপ্রেমী। হাতা ও গলায় ফ্রিল আছে এমন ব্লাউজের সঙ্গে একরঙা কিংবা ব্লকপ্রিন্টের সুতি শাড়ি পরতে ভালোবাসে সে। চোখে গাঢ় কাজল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক ও কপালে ছোট্ট টিপ! বেশ সাজ হয়ে গেল। যে কোনো উৎসবে তো বটেই, দিনমান ভ্রমণ, অফিস কিংবা বন্ধুদের আড্ডায় শাড়ি পরতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সে। সাধারণ দিনে হালকা সাজে থাকলেও যে কোনো উৎসবের দিনে শাড়ির সঙ্গে ভারী গহনা পরতে ভালোবাসে। সেই সঙ্গে স্নিগ্ধ ও ন্যাচারাল মেকআপ তো আছেই।
শাড়ি এমন একটি পোশাক, যা সব বয়সী নারীর কাছে গ্রহণযোগ্য। ঈদ ও যে কোনো উৎসবে শাড়ির কদর বাড়ে বৈকি। এবারের ঈদে দেশীয় পোশাকের ব্র্যান্ডসহ প্রতিটি ব্র্যান্ডই শাড়ি নিয়ে এসেছে। সেসব শাড়ির সংগ্রহে স্থান পেয়েছে সুতি, জামদানি, সিল্ক, জর্জেট, মসলিন, টাঙ্গাইল, মণিপুরি ইত্যাদি। সেসব শাড়িতে করা হয়েছে স্ক্রিনপ্রিন্ট, ব্লকপ্রিন্ট, ডিজিটাল প্রিন্ট, রিবন ওয়ার্ক, ডলার ওয়ার্ক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রিন্ট ইত্যাদি। জ্যামিতিক ও ফুলেল নকশার পাশাপাশি রয়েছে মূর্ত ও বিমূর্ত সব নকশা।
ঈদকে সামনে রেখে কে-ক্র্যাফটে শাড়ির বৈচিত্র্যপূর্ণ ডিজাইনের বড় আয়োজন থাকছে বলে জানান কে-ক্র্যাফটের স্বত্বাধিকারী ও ডিজাইনার খালিদ মাহমুদ খান।  নিজস্ব ডিজাইনে মোটিফের ব্যবহার, কালার কম্বিনেশন এবং ভ্যালু অ্যাডিশনে নানা মিডিয়ার ব্যবহার সবার দৃষ্টি কাড়বে বলে আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
মোটিফে বাহারি মিশেল : কে-ক্র্যাফটের শাড়িতে মোগল আর্ট, মোগল অর্নামেন্টস, ম্যান্ডালা ফ্লোরাল আর্ট, জামদানি, কাঁথা স্টিচ, আর্ট ডেকো মোটিফের ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানান খালিদ মাহমুদ খান। বিশ্বরঙের শাড়িতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রিন্ট ব্যবহার করা হয়েছে বলে জানান বিশ্বরঙের স্বত্বাধিকারী ও ডিজাইনার বিপ্লব সাহা।
কাপড়ের ধরন বুঝে ভ্যালু অ্যাড : কে-ক্র্যাফট এবারের শাড়িতে রুচিশীল ও যত্নে তৈরি কটন, হাফ সিল্ক, কোটা মসলিন ফেব্রিকের ব্যবহার করেছে। উজ্জ্বল রং, কন্ট্রাস্ট কম্বিনেশনে করা সবার জন্য উপযোগী এবং উৎসবমুখী এ শাড়িগুলোতে স্ক্রিনপ্রিন্ট ও এমব্রয়ডারি করা শাড়িগুলো অনন্য। রঙ বাংলাদেশের এবারের ঈদ কালেকশন শাড়িগুলো তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের স্লাব কটন, হাফসিল্ক, মসলিন, বলাকা সিল্ক কাপড় দিয়ে। শাড়ির নকশাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নানা ভ্যালু অ্যাডেড মিডিয়ার ব্যবহারে। এর মধ্যে রয়েছে– স্ক্রিনপ্রিন্ট, ব্লকপ্রিন্ট, হাতের কাজ, এমব্রয়ডারি, কারচুপি, ড্রাই ও কাটিং অ্যান্ড সুইং।
রং ও নকশার কারসাজি : রোজ বেইজ, স্কাই, অলিভ, নেভি, ব্ল্যাক, ফিরোজা, কোরা, টিল, অ্যাকুয়া এনটিক, পার্পল, হোয়াইট, প্যাস্টেল, ভায়োলেট, ব্রাউন, সি গ্রিন, অরেঞ্জ, ভায়োলেট, ব্রিক রেড, এমারাল্ড গ্রিন, ম্যাজেন্টাসহ নানা রঙে ডিজাইনকৃত বর্ণিল শাড়িগুলো পাওয়া যাচ্ছে কে-ক্র্যাফটে। বয়সভেদে শাড়ি ভিন্ন ভিন্ন হয়। তরুণী ও যুবতীদের জন্য শাড়ি এক রকম, ত্রিশোর্ধ্ব নারীদের জন্য অন্য রকম শাড়ি এবং বয়োবৃদ্ধদের জন্য ভিন্ন শাড়ি করা হয় বলে জানান বিশ্বরঙের স্বত্বাধিকারী ও ডিজাইনার বিপ্লব সাহা। বিশ্বরঙে ‘শ্রদ্ধা’ ক্যাটাগরির শাড়িও রয়েছে। এই ক্যাটাগরির শাড়ির রংগুলো প্যাস্টেল শেডের।
রঙ বাংলাদেশের শাড়ির জন্য মূল রং হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে সাদা, কালো, ম্যাজেন্টা, ব্লু, ফিরোজা, লাইট ব্রাউন, পার্পল, পেস্ট, কফি, অলিভ, মাস্টার্ড, মভ বা ফিকে লাল আর সহকারী রং হিসেবে আছে সি-গ্রিন, ব্রাউন, হলুদ, কমলা ও মেরুন।
আছে প্যাচওয়ার্ক : বিশ্বরঙের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শাড়ি
প্যাচওয়ার্কের শাড়ি। এসব শাড়ির জন্য ৪-৫টা শাড়িকে কেটে টুকরা টুকরা করে আবার জোড়া দেওয়া হয়। কোনোটার কুচি একরকম, পাড়, জমিন, আঁচল ভিন্ন ভিন্ন। এবারের ঈদে বিশ্বরঙ ছাড়াও বিভিন্ন ব্র্যান্ড নিয়ে এসেছে প্যাচওয়ার্কের শাড়ি।
বিশেষত্ব : ঈদের জন্য কেমন শাড়ি তৈরি করা হয়েছে এবং সেসব শাড়ির বিশেষত্ব কী, তা নিয়ে কথা হচ্ছিল বিশ্বরঙের স্বত্বাধিকারী ও ডিজাইনার বিপ্লব সাহার সঙ্গে। তিনি জানান, বরাবরের মতো এবারও তাঁতপ্রধান শাড়িগুলোকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তাঁতেরও নানা বৈচিত্র্য আছে। সুতি, হাফ সিল্ক, সিল্ক ইত্যাদির মধ্যেও আছে সরাসরি তাঁতে বোনা শাড়ি। কিছু শাড়ি আছে ডিজাইনার শাড়ি। সেসব শাড়িতে ভ্যালু অ্যাড করা হয়। এর মধ্যে ব্লকপ্রিন্ট, স্কিনপ্রিন্ট, ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রিন্ট, হাতের কাজ, মেশিন এমব্রয়ডারি, কম্পিউটার ওয়ার্ক, অ্যাপ্লিক, বাটিক, টাইডাই, ভেজিটেবল ডাই ইত্যাদি।
জরি-কাতান, কাসাভু-কোটা, প্রিন্টেড হাফসিল্ক ও মসলিন দিয়ে ঈদের জন্য অসাধারণ একটি শাড়ির কালেকশন তৈরি করেছে লা রিভ। রয়েছে অন্যান্য শাড়িও। লা রিভের এবারের ঈদের শাড়ির মোটিফ প্রশান্তি। সেখানে উজ্জ্বল রংগুলো বেশি গুরুত্ব পেলেও, রয়েছে হালকা ও শীতল রঙের শাড়ি।
বিশ্বরঙে পার্টি শাড়ির মধ্যে মসলিন, বলাকা সিল্কের শাড়িগুলো বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। এবারের ঈদে মসলিন ও বলাকা সিল্কের মিশেলেও কিছু শাড়ি তৈরি করা হয়েছে। সেখানে আলগা নকশিকাঁথার পাড় বসানো হয়েছে। স্ট্রাইপ, ডট, বল, জ্যামিতিক প্রিন্ট, ইসলামিক মোটিভ, ফ্লোরাল মোটিভ শাড়িতে করা হয়েছে। এ বছরের শাড়িতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রিন্টের ব্যবহার করা হয়েছে, যা আগে করা হয়নি। টিস্যু সিল্ক ও হাফসিল্কের শাড়িতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রিন্ট ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।
থিমভিত্তিক শাড়ি : প্রতিবারের মতো এবারও থিমনির্ভর কালেকশন তৈরি করেছে রঙ বাংলাদেশ। রঙ বাংলাদেশের স্বত্বাধিকারী ও ডিজাইনার সৌমিক দাস জানান,  পাখির রং থিমে তৈরি হয়েছে এবারের সব শাড়ি সংগ্রহের নকশা উপাদান। এবারের শাড়ির নকশায় গুরুত্ব পেয়েছে বাংলাদেশের সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় আবহ। পাশাপাশি সময়, প্রকৃতি, আবহাওয়া আর আন্তর্জাতিক ট্রেন্ডও।
বৈশাখ ও ঈদকে মাথায় রেখে হরীতকী শাড়িতে করেছে বিভিন্ন দেশীয় নকশা। ডিজিটাল প্রিন্টের মাধ্যমে তারা ফুটিয়ে তুলেছে কুলা, পদ্ম, ময়ূর, নারীর অবয়ব, ফুল, লতা-পাতা ইত্যাদি। একরঙা শাড়িতে ভিন্ন রঙের লেসের ব্যবহারও করা হয়েছে। কইন্যা, সাতকাহন সুতি শাড়িতে নিজস্বতার ছাপ রেখেছে। মা কিংবা বোনের জন্য যাঁরা শাড়ি কিনতে চান, তাঁরা দেশীয় ফ্যাশন হাউস কিংবা অনলাইন পেজে ঢুঁ মারতে পারেন।
মানানসই ব্লাউজ : ঈদের দিনদুপুরে কিংবা রাতের পার্টিতে গেলে শাড়ির সঙ্গে স্টাইলিশ ও ফ্যাশনেবল ব্লাউজ চাই। এখন নিজেকে সাহসী ও আকর্ষণীয় দেখাতে স্লিভলেস ব্লাউজ পরেন অনেকে। হল্টার নেক ব্লাউজ, পিটার প্যান কলার ব্লাউজ, জ্যাকেট স্টাইল ব্লাউজ, কেইপ স্টাইল ব্লাউজ, বাটারফ্লাই স্লিভ ব্লাউজ, মান্দারিন ব্লাউজ, কোল্ড শোল্ডার, পাফ হাতার ব্লাউজও বেশ চলে। মোট কথা, শাড়ির পাশাপাশি ব্লাউজেও বৈচিত্র্য চান ফ্যাশনসচেতন নারীরা। কেউ কেউ ফ্রিল হাতার থ্রি কোয়ার্টার অথবা ফুল হাতার ব্লাউজও পরে থাকেন। কিছু কিছু ব্লাউজে জারদোসি, বিডস, পুঁতি, চুমকি, লেইসসহ ভারী কাজ আছে। তবে এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, একরঙা শাড়ির সঙ্গে ভারী কাজ ও রঙিন ব্লাউজগুলো ভালো মানায়। ব্লাউজ নির্বাচনে মাথায় রাখতে হবে শাড়ির কাজ ও নকশার প্রতিও। শাড়িতে বেশি কাজ থাকলে ব্লাউজে কম কাজ থাকলেই ভালো। নয়তো নষ্ট হতে পারে চোখের আরাম।
শাড়ির নকশার রঙের সঙ্গে মিলিয়ে ব্লাউজ বাছাই করা যেতে পারে। একরঙা শাড়িতে ফ্লাওয়ার মোটিফে নকশা থাকলে ব্লাউজে ফুলের নকশা থাকতে পারে। জর্জেট, সিল্ক, মসলিনের মতো স্বচ্ছ শাড়ির সঙ্গে পরার জন্য বেছে নিতে পারেন ভেলভেট তথা মখমলের ব্লাউজ। হাফ সিল্ক, জামদানি, শিফন, পিওর সিল্ক ও তাঁতের শাড়ির সঙ্গে কাতান ব্লাউজ হতে পারে তুলনাহীন। তবে শাড়িতে যদি ব্লাউজ পিস থাকে, তা থেকেই বানিয়ে নিতে পারেন নিজের মনের মতো।
ব্লাউজ ছাড়াও এখন ক্রপটড, শার্ট, টপ এবং টি-শার্ট দিয়ে শাড়ি পরেন অনেকে। বিশেষ করে তরুণীরা এ ট্রেন্ড অনুসরণ করছেন বেশি। ট্র্যাডিশনাল ব্লাউজের বদলে এগুলো যেন একটু বেশি আধুনিক করে তুলছে। সেই সঙ্গে বাড়িয়ে তুলেছে শাড়ির জৌলুস।
যত্ন : নতুন শাড়ি পরার পর বাইরে থেকে এসে বাতাসে মেলে রাখুন। পরার পর ময়লা হলে শাড়ি পারতপক্ষে না ধোয়াও ভালো। সুতি শাড়ি পরিষ্কার পানিতে ডিটারজেন্ট মিশিয়ে ১০ মিনিট ভিজিয়ে রাখুন। এর পর ভালো করে ধুয়ে নিন। ব্লক বাটিকের শাড়ি সরাসরি রোদে না শুকানো ভালো। বাতাসে মেলে দিলেই ঘাম শোষণ হয়ে যাবে। ব্লক বাটিকের শাড়ি প্রথমবার ধুতে হলে লবণ পানিতে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রাখুন। তারপর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে নিন। ধোয়ার আগে উল্টো পিঠে আয়রন করে কিছুক্ষণ রোদে শুকিয়ে নেওয়া ভালো। এতে ব্লকের রং নষ্ট হয় না। শাড়ি কখনোই গরম পানিতে ধোয়া যাবে না। ধোয়ার পর টানটান করে মেলে দিতে হবে। শুকিয়ে গেলে ইস্ত্রি করে আলমারিতে তুলে রাখতে হবে।
মণিপুরি শাড়ি ড্রাইওয়াশ করা ভালো। যদি বাড়িতে পরিষ্কার করতেই হয় তাহলে হালকা ডিটারজেন্ট বা শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে নিন। তবে কচলাবেন না। ধোয়া হলে দুই পাশ সমান রেখে ঝুলিয়ে দিন।
তাঁত, জর্জেট, শিফন, সিল্ক, কাতান-বেনারসি শাড়ি ড্রাইওয়াশ করে নিন। জামদানি শাড়ি কাটাওয়াশ করতে হবে। খুব বেশি পরা না হলে শাড়ি ধোয়ার প্রয়োজন নেই। এসব শাড়ি আলমারিতে রাখার আগে আয়রন করে রাখুন। অনেক দিন পরা না হলে মাঝেমধ্যে খুলে ভাঁজ উল্টে-পাল্টে নিন। কাতান, বেনারসি, জামদানি ও সিল্কের শাড়ি হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখুন। কিছুদিন পরপর বের করে শাড়ি উল্টো করে রোদে মেলে রাখুন। জর্জেট ও শিফন শাড়ি আলমারিতে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখলে ছিঁড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই ভাঁজ করেই রাখুন। কাজ করা জর্জেট শাড়ি উল্টো করে ভাঁজ করে রাখলে ভালো থাকে। v

মডেল : সুষমা সরকার; পোশাক : কে-ক্র্যাফট;
মেকওভার : রেড বিউটি সেলুন; ছবি: কাব্য