- ফিচার
- তীর্থযাত্রী ও প্লেটোর সংলাপ
তীর্থযাত্রী ও প্লেটোর সংলাপ

`তীর্থযাত্রী’ নাটকের দৃশ্য
ছোটবেলায় প্লেটোর সংলাপ পড়ার পর মনের মধ্যে তিনটি চাওয়া তৈরি হয়েছিল। সক্রেটিসকে খুব কাছে থেকে দেখার ইচ্ছা হচ্ছিল, সরদার ফজলুল করিমের মুখ থেকে আরও কিছু কথা শুনতে ইচ্ছা হচ্ছিল এবং প্লেটোর বর্ণনায় আর কোনো বই আছে কিনা সেটাও পড়তে ইচ্ছা হচ্ছিল। খুবই আশ্চর্যের বিষয়, মঞ্চনাটক ‘তীর্থযাত্রী’ দেখার পর একই অনুভূতি হচ্ছে। সম্প্রতি নিউইয়র্কের কুইন্স থিয়েটারে হয়ে গেল হুমায়ূন কবীর-এর রচনা ‘তীর্থযাত্রী এবং তিনজন তার্কিক’ অবলম্বনে মঞ্চনাটক ‘তীর্থযাত্রী’র উদ্বোধনী প্রদর্শনী। এর নাট্যরূপ ও নির্দেশনা দিয়েছেন তৌকীর আহমেদ।
নিউইয়র্কের বাঙালিদের জন্য রচিত হলো আরেকটি ইতিহাস। কেন ইতিহাস, সেটা বলছি। এত দিন নিউইয়র্কে বিভিন্ন প্রদর্শনী দেখে দেখে একটাই অনুভূতি হয়েছে আমার, এখানে যাঁরা নাচ-গান-আবৃত্তি করেন, তাঁদের বেশিরভাগই অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ভুল করেন। তাঁদের দোষ দিয়ে লাভ নাই, এখানে শিক্ষক কিংবা প্রশিক্ষকসহ সকল সুযোগ-সুবিধারই অভাব আছে। যিনি এই সুযোগ-সুবিধার অভাবকে কাটিয়ে পারফরমারদের মধ্য থেকে শৈল্পিক বিষয়টি বের করে আনতে পারেন, তিনিই ইতিহাসের রচয়িতা হয়ে উঠতে পারেন। তৌকীর আহমেদের ‘তীর্থযাত্রী’ দেখতে গিয়ে আবারও বিষয়টি মনে হলো।
আমি নিশ্চিত যে, নাটকটির নির্দেশনা দিতে গিয়ে তৌকীর আহমেদকে অবশ্যই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের শক্তি ও দুর্বলতার দিকগুলোর সমন্বয় ঘটাতে গিয়ে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। একজন ভালো নির্দেশকের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, শক্তির পাশাপাশি অভিনেতার দুর্বলতাগুলোও তিনি এমনভাবে চরিত্রের অংশ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেন যে মনে হতে থাকে, চরিত্রটির বোধ হয় এভাবেই অভিনয় করা জরুরি ছিল। সেই সজ্জা থেকে বের হয়ে অন্য কোনো ভালো কাজ করা অবশ্য সেই অভিনেতার জন্য ভবিষ্যতের একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
আমার তিন কন্যা নোরা, জারা ও অরোরাকে নিয়ে যখন থিয়েটার হলে ঢুকছি তখন চারপাশে লোকারণ্য। ছোট কন্যা জিজ্ঞাসা করল, যে নাটকটি দেখতে যাচ্ছি তার প্লটটা আসলে কী? বললাম, দেখ, লেখক নিজেই বলেছেন তাঁর রচিত ‘তীর্থযাত্রী এবং তিনজন তার্কিক’-এর বড় দুর্বলতা হচ্ছে এর কোনো নির্দিষ্ট প্লট নেই। বইটি কোনো উপন্যাস বা গল্পের ধাঁচে লেখা নয়। তখন জারা বলল, তাহলে নাটকটা বেশ কঠিন হবে বলে মনে হচ্ছে? নোরা প্রশ্ন করল, প্লটই যদি না থাকে তাহলে আমরা দেখব কী? চলো দেখা যাক, ছোট করে উত্তর দিলাম আমি। কারণ প্রশ্নগুলোর উত্তর তখনও আমার অজানা।
নাটকটি দেখতে শুরু করার পর থেকে কখনও মনে হয়নি– এর নির্দিষ্ট কোনো প্লট নেই। লেখকের কথার মধ্যেই অবশ্য তার একটা উত্তর পাওয়া গেল, এটি নির্দেশক তৌকীর আহমেদের একটা সাহসী সিদ্ধান্ত।
তিনজন তার্কিককে দিয়ে একজন লেখকের কিছু বিক্ষিপ্ত ভাবনাকে মঞ্চে তুলে আনা যে কতটা কঠিন কাজ, সেটা প্রতিটি দৃশ্যে অনুভব করেছি। এ-ও অনুভব করেছি নির্দেশক বেশ দক্ষতার সঙ্গেই সেটা সম্পন্ন করেছেন। হাজারো প্রশ্নের জবাব নিয়ে প্রতিটি দৃশ্য বেশ রঙিন এবং ঘটনাবহুল করে সাজানো। তৌকীর আহমেদ একই সঙ্গে মঞ্চ এবং ফিল্মের মানুষ হওয়াতে মঞ্চের প্রতিটি মুহূর্তেই চমৎকার সব ফ্রেম পাওয়া যাচ্ছিল। সক্রেটিসের সঙ্গে প্লেটোর যে ধরনের আলাপচারিতা আমরা পাই ‘প্লেটোর সংলাপ’ থেকে, গ্যালিলিও এবং আন্দ্রেয়ার যে ধরনের বাগ্যুদ্ধ দেখি ‘গ্যালিলিও’তে ঠিক তেমনি করে আমাদের আশপাশে ঘুরে বেড়ানো হাজারো প্রশ্নের কিছু চমকপ্রদ অথচ নতুন ভাবনা আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছে ‘তীর্থযাত্রী’ দল। যুদ্ধ শেষ করে জীবনযুদ্ধে ব্যস্ত হয়ে ওঠা তিন তীর্থযাত্রীর কথোপকথনে আমরা ভাবতে শুরু করি– যুদ্ধ কী, কেন? সভ্যতার সংজ্ঞা কী, অধিকারের ব্যাপ্তি কতটুকু, কোন কোন পরাজয় আসলে জয়ের চেয়ে গৌরবের, আচার্য কখন দ্রোনাচার্য হয়ে ওঠেন, একটা লড়াই বিভিন্ন স্তরে স্তরে কীভাবে বাঁচার লড়াই, মর্যাদার লড়াই এবং প্রাপ্তিযোগের লড়াই হয়ে ওঠে, নীতি ও নৈতিকতার সর্বজনীন রূপ কি আসলেই আছে? এসব প্রশ্ন এবং সর্বোপরি আমাদের তীর্থযাত্রার আপেক্ষিকতা কোথায় লুকোনো সবকিছুই নির্দেশক তুলে এনেছেন তিন তার্কিকের কথোপকথনে। দেখতে দেখতে আবারও আমাদের ভাবনার জায়গায় নাড়া দেয় যখন চরিত্রগুলো বলে ওঠে, মন্দ ও মন্দের সংঘাত নতুন কিছু নয়, তবে ভালোর সঙ্গে ভালোর সংঘাতেই মানবতার আসল পরাজয়। যখন দেখা যায়, একই জল্লাদ একজনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে পরক্ষণেই আবার আরেকজনের কবরে ফুল নিয়ে উপস্থিত হয়। যাত্রীদের মনের মধ্যে কত শত প্রশ্ন আসে; কিন্তু তিনজনের পথচলা আর শেষ হয় না। নির্দেশক কঠিন কঠিন সব প্রশ্নকে অত্যন্ত চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। স্পষ্টতই উপলব্ধি করা গেছে যে কঠিন ভাবনাগুলোর চাপ যেন দর্শকের জন্য ক্লান্তিকর হয়ে না ওঠে, সেটাও ছিল নির্দেশকের যুদ্ধের জায়গা। এই কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, তৌকীর আহমেদ সেই যুদ্ধের বিজয়ী গ্লাডিয়েটর।
মন্তব্য করুন