চটজলদি উত্তর দিতে ঢাকাইয়া কুট্টিদের খ্যাতি নাকি জগৎজোড়া। রাজন্যবর্গের কাছাকাছি থাকতে যে রকম চৌকস– তোষামুদে হতে হয়, দীর্ঘদিনের একনাগাড়ে চেষ্টায় সেটার পারঙ্গমতা প্রায় আকাশ ছুঁয়ে গেছে কুট্টিদের বেলায়। আর যারা রাজন্য নন, এমন লোকদের বেলায়– একটা কৌতুক মেশানো অবহেলা কুট্টিদের প্রায় রক্তমজ্জায় ...
জুলহাসের জন্ম আর বেড়ে ওঠা সেই কুট্টিদের সাথে– পুরান ঢাকায়। মধ্যম আয়ের উকিল বাবা ধানমন্ডি-গুলশান তো নয়ই, এমনকি মালিবাগ-মগবাজারেও ঘর ভাড়া নিতে সাহসী না হয়ে অবশেষে পুরান ঢাকায় এই সুন্দরদাস লেনের দোতলা বাড়িটার নিচের তলায়, যার সামনে কোনো উঠোন নেই। পেছনে খানিকটা জায়গায় মহল্লার প্রায় জনাকুড়ি ছেলে বিকেলে জড়ো হয় খেলতে– অতটুকু জায়গার খেলা তো আর হয় না– হয় বিস্তর চেঁচামেচি, আর গায়-গায় ঘষা খেতে খেতে একটু দৌড়াদৌড়ি। তাদের মধ্যে গোটাকয়েক স্কুলে যায় না। সেগুলো মুখখিস্তি করে। জুলহাসের মতো স্কুলে যায় যারা– খিস্তিগুলো তারা সব বুঝতে পারে, তবে বললে বলে মনে মনে। মনে মনে বলে তার কারণ– উচ্চারণ করে বললে মার খাবার ভয় থাকে।
শমসের বাবুর্চির লাড্ডু কারখানাটার কারিগরের ছেলেটা, কাঠি কাঠি হাত-পা কিন্তু মোটা পেটের নাসিরুল্লা– তার বাপ নামটা রেখেছিল পাকিস্তানি নায়ক নাসিরুল্লাহ বাটের প্রতি ভক্তিবশত। আরে ...  সেই এক জমানা রে–
মোহাম্মদ আলী-জেবা, নাসিরুল্লাহ বাট, আদিব, সুধীর, নিলো-রঙ্গিলা আর কী সব বই রে বাবা! জারকা, আখেরি চাট্টান! কারিগর এখনও কখনও গুনগুন করে ...  ইয়া জারকা! খানিক পরে হয়তো আপনমনে গেয়ে ওঠে– হাম হ্যায় দিওয়ানে তেরে । সেই কারিগরের ছেলে নাসিরুল্লা যখন তেড়ে আসতে আসতে বলে– মাঙ্গের পুত, তর ...
জুলহাসেরা তখন পিছিয়ে আসে– তার গায়ের জোরের ভয়ে নয়–  তার খিস্তির তোড়ে।
চিপা গলিটার পাশে ৯ ইঞ্চির একটা উপচে পড়া ড্রেনে– হালকা নীলচে রঙের এক ধরনের মিহি কাদা। শুকিয়ে ধুলো হলে পায়ে-পায়ে, হাওয়ায়-হাওয়ায় উড়ে তারা সারা পুরান ঢাকায় ছড়িয়ে যায়।
এটা-ওটার প্লাস্টিক প্যাকেট, দু-এক পাটি পুরোনা স্যান্ডেল-জুতো, গুলের কৌটো ইত্যাদি– বাদলা অথবা বুড়িগঙ্গার ভরা কোটালের উল্টো ঠেলা দেওয়া পানি নেমে গেলে এখানে-ওখানে জমে থাকে। সরেস তামাকে তৈরি মোস্তফা মিয়ার মিঠেকড়া গুল-নিচের লাইনে চাঁদের মতো বেঁকিয়ে লেখা– ‘সব সময় তাজা থাকে’– আর লাইন দুটোর মাঝখানে দাড়ি-মোচহীন কিন্তু টুপি মাথায় দেওয়া মোস্তফা মিয়ার একটা ছবি। গলে গেলেও, কাগজটুকু কী করে যেন দু-একটা কৌটোর গায়ে শেষতক ল্যাপটানো থাকে।
এখানে ঘাড় উঁচু করে মাথার পেছন দিকটা মাটির সমান্তরাল হলে কেবল আকাশ দেখা যায়, তাও এক টুকরো। গলির মাথাটায় সারা বছর গলায় মাফলার প্যাঁচানো হাজাম মোমেনউদ্দিনের সোয়া কাঠা জমির ওপর দেয়াল ঘেরা টিনের চালা, গেটের দরজাটাও টিনের, টিনেরই আরেকটা সাইনবোর্ডে লেখা ‘খতনা দেওয়া হয়’। দু-একদিন বাদে বাদে ছেলেদের বাবা-রে, মা-রে মার্কা চিৎকার ভেসে আসে। পাড়ার মেয়েরা বুঝি এই একদিনই খুশি হয়; মেয়ে হওয়ার জন্য।
গলিটা ওমাথায় গিয়ে মিশেছে সাড়ে ছ’ফুট চওড়া রাস্তাটায়– যেখানে সারাদিন নানান লোকের চলাফেরা, ফেরিওয়ালা, হকার, তরকারিওয়ালা, কদাচিৎ মাছ-মুরগির পায়ে-চালানো ভ্যান, অগুনতি ফন্দিবাজ দালাল কিসিমের হাজার জনের আনাগোনা সেই মাঝরাতে অবধি। এই মহল্লায় উকিল সাহেবের একটা আলাদা খাতির আছে। কারণ, জমিজাতির ক্যাঁচাল নেই এমন বাড়িওয়ালা এদিকে কম। মুফতে বুদ্ধি-পরামর্শের লোভে সবাই তাঁকে খাতির করে চলে। মহল্লার রাস্তাটা এগিয়ে গিয়ে যেখানে ইংলিশ রোডে উঠেছে সেই মোড়টায় অনেকখানি জমি রয়েছে গলির মুখের বাড়িওয়ালা গিয়াসউদ্দিন সাহেবের। ঢাকায় আরও বাড়ি থাকলেও তিনি এই পুরান ঢাকাতেই থাকেন। ভাইদের সাথে একটু টানাটানি আছে জায়গাজমি নিয়ে। উকিল সাহেবের সাথে দেখা হতে গিয়াসউদ্দিন বললেন– স্লামালেকুম উকিল সাব, বেশ কয়দিন তক্ দেহা নাই আপনের লগে, খায়রিয়াত তো! আপনার পোলাডায় আইছিল হেদিন– আমার ভাইস্তা সালমানের লগে। পোলাডি ভালা।
জি ভাই ধন্যবাদ আপনাকে– বলে উকিল আরও বললেন– ইংলিশ রোডের জমিটা …  ওইটার ডেট পড়ছে নাকি, ব্যারিস্টার সাবে কী কইলেন?
উকিল সাহেব থামলে গিয়াসউদ্দিন বললেন–
ডেট পরতাছে পরুক। জমিনডি তো আমার পজেসনে, বুঝলেন না! ব্যারিস্টারের থিকা দলিল ছুটায়া নিমু ভাবি, হুদা ডেট ফালানের কাম তো আপনেই চালাইয়া নিবার পারবেন, নাকি কন?
জি ভাই, নিলে আমি পারি।
জি, উকিল সাব! ভাইবা দেখি ইকটু– আইয়েন এক সুমায়, কথা হইব। আর হ– আপনের পুলাডারে পাঠায়া দিয়েন, আমগো বাড়ির লোকে পছন্দ করছে তারে, কইছে– ‘সইভ্যপোলা’।
কয়েক দিন বাদে গিয়াসউদ্দিন মিয়া– ভাইদের সাথে ইংলিশ রোডের দোকান আর জমি নিয়ে যে কেসটা– সেটার দায়িত্ব উকিল সাহেবকে দিয়ে দিলেন। সেই সাথে ওয়ারীর বাড়িটার ভাড়াটিয়দের সাথে বাড়িভাড়ার চুক্তি, কেরানীগঞ্জে দেশের বাড়ির জমিজিরাত– তার কাগজপত্র– এসবের দায়িত্বও উকিল সাহেবকে দিয়ে দিলেন কী মনে করে। ফিক্সড একটা ইনকামের এই ব্যবস্থা উকিলকেও বেশ খুশি করে তুলল।
সেই উকিলের পোলাডা ম্যাট্রিকে বিশাল রেজাল্ট করে ফেলল। গিয়াসউদ্দিনের ভাইপো সালমান পেল সেকেন্ড ডিভিশন। জুলহাসকে শাবাশি দিতে দিতে গিয়াসউদ্দিন বউকে ডেকে বললেন–
দেখছনি, উকিল সাবের পুলায় কেমন উমদা রেজাল্ট করসে! ফাস্ট ডিভিশন পাইসে পুলায়, তারে জর্দা শরবত খিলাও–
হ, হ খিলামুই তো, আহো বাজান আহো–
মহিলা বললেন।
নিজের একমাত্র নাইন পড়ুয়া মেয়ে মিলা, মিলা ইয়াসমিনকে ডাকলেন তিনি– অয় মিলা হুনছোস, ইদিকে আইয়া পর, দেইখা যা তর সালমান ভাইয়ের দোস্তে …
হ হুনছি তো! জুলাস ভাইয়ে ফাস্ট-ডিভিশন পাইছে! ভাইয়া আমারে কইছে তো–
নাইন পড়ুয়া মিলা বলতে বলতে ঘরে ঢুকল।
খানিকটা জর্দা খেয়ে বরফ আর তোকমা দেওয়া ঢাকাই শরবত ভালোই লাগল জুলহাসের। ভীষণ ফর্সা আর তীক্ষ্ণ চোখের মিলা রেলিংয়ে আধঝোলা হয়ে গলা বাড়িয়ে তার ভাই সালমানকে ডাকতে লাগল–
ওই ভাইয়া আইসা পড়ো– তোমার দোস্তে আমাগো এইখানে।
তরতর করে সিঁড়ি ভেঙে সালমান উঠে এলে– গোলগাল ফর্সা চাচিটা বললেন–
ওই ছেরা, তর পছন্দের তোকমা শরবত ব্যাকটি তোর বইনে খাইয়ালাইবো কইলাম, খাইতে চাইলে জলদি কর …
বন্ধুটা যেন সাথে করে স্বস্তি বয়ে আনল জুলহাসের জন্য– শিরদাঁড়াটা আলগা করে দিল সে এবার। চাচি বললেন–
কুন কলেজে ভর্তি হইবার চাও তুমরা?
জুলহাস আর সালমান প্রায় একসাথে বলে উঠল–
কাজী নজরুল কলেজেই হই, কী কন চাচিআম্মা!
চাচিআম্মা বললেন–
ভালাই হইব, বারীর লগে কলেজ হইলে আওন-যাওন সহজ হয়!
বাল্যবান্ধবী সাবিনা ইয়াসমিনের নামের সাথে মিলিয়ে নাম রাখা একমাত্র মেয়ে মিলি ইয়াসমিনকে এবার তিনি ইয়াসমিন বলে ডাকলেন, ডাকার ফাঁকে জুলহাসকে নিরিখ করে তিনি বলতে লাগলেন–
বাবা জুলহাস, ভর্তির কাম সারা হইলে তুমি আমার মাইয়াডারে পরাইও...  তুমার ইকটু হাত-খর্চাভি হইয়া যাইব। মাইয়াডার ভি পরাছু না...  তুমার ওয়ালিদ জানেরে না-হয় আমিই কইয়া দিমুনে।
জি চাচি– আব্বায় রাজি হইলে–
ঠিক আছে, ঠিক আছে বাজান–
চাচি বললেন।
তাঁর থেকে পরে এবং খারাপ রেজাল্ট করা অনেক উকিল পসার জমিয়ে ফেলেছে দেখে–অনেক সময় উকিল সাহেবের মন খাবাপ হয়। জীবনে সাকসেসফুল হওয়া, পসার জমানোর পেছনের অঙ্কটা ক্লিয়ারই হতে চায় না উকিল সাহেবের ব্রেনে। তার কাছে বিধাতাকে মনে হয় –সেই বড় ভাইয়ের মতো, মা বাড়ি না থাকলে যিনি ছোট ভাইকে গোসল করে নিতে বলেন কিন্তু নিজে হাত লাগান না। অনেক দিন পর এইবার তার মনে হলো– পসার যেন একটু একটু করে জমে উঠছে। প্রায় একসাথে দুটো কেস হাতে পেয়ে তার এ রকম মনে হওয়া শুরু হয়েছে। পাতলাখান লেনের চানাচুর ফ্যাক্টরিটার মালিকদের জমিজিরেত ভাগাভাগির কেসটা আর এই যে গিয়াসউদ্দিনের ভাইতে ভাইতে মামলা–
এ দুটোর কোনোটাই সহজে সুরাহা হবে না– চলবে অনেক দিন–
এ্যাদ্দিন পরে কি তার মা বাড়ি ফিরলেন? কে জানে!

তখনকার কুট্টিরা সারাদিন নবাববাড়ির ফরমায়েশ খেটে, তহশিলদারদের হাতে হেনস্তা হয়ে, বাজার সরকারদের কিটুনি শুনে, বরকন্দজদের ধাক্কা সামলে– মাঝরাতে যে খোলা জায়গাটায় ঘোড়া, গাড়ি– এইসব জমা করত– সেই খোলা জায়গাটার এখন বোধহয় বাহাদুর শাহ্ পার্ক নাম হয়েছে। বড়-ছোট এইসব তাবৎ ঘটনা– সময়ের পেটে নাশতা হয়ে ঢুকে কেমনে যে সেসব হজম হয়ে যায়– নাইনে পড়া মেয়েটাকে ইতিহাস পড়াতে পড়াতে জুলহাস আস্তে আস্তে এইসব উপলব্ধি করা শুরু করে দেয়।
আই-এ তেও জুলহাসের ফল খুবই ভালো হলো। সালমান মাঝে মাঝে মশকরা করে তাকে ‘মাস্টর’ ডাকে। মিলাকে পড়াতে বসলে মাঝে মাঝে সে কাছে এসে বসে। দু’বন্ধু  কথা বলতে বলতে কখনও ভুলে যায় সামনে বসা ছাত্রীটার কথা। সালমান বলে–
বহোতদিন তো একলগে থাকলাম– অহন বুঝি আলাদা হওনের পালা– তুই তো বুয়েটে যাইবি গিয়া! আমার তো আবুযর গিফারী কলেজ ছাড়া চান্স নাই।
জুলহাস বলল–
ধুরো হালায়, ভার্সিটির অ্যাডমিশন টেস্ট একলগে দিমুনে আমরা– দেখমুনে কোন খালের পানি কোনদিক দিয়া নামে!
খানিকটা মন খারাপ করেই যেন সালমান চলে গেল।
ভাইটা চলে যেতেই ঢাকাইয়া মেয়েটা শিক্ষকের ওপর তেরিয়া হয়ে উঠল, বলল– আমার ভাইয়েরে হালা কইলেন কিল্লিগা? যা ইচ্ছা তাই নাকি!
কী যেন একটা কিছু জানার কৌতূহল, আর কী একটা কৌতুক একসাথে মিশে থাকল মিলা ইয়াসমিনের চোখ জোড়ায়।
জুলহাস দেখল, বলল–
ঠিকই কইছি– বলে একটুখানি চেয়ে থাকল ছাত্রীর চোখের দিকে।

ঢাকাইয়া মেয়েটা কেন যেন খানিকটা স্থিরমতি হয়ে গেল সেদিন থেকে। আর জুলহাসের ওই অতটুকু মনটায় পৃথিবীর সব থেকে সাধারণ তবু আসাধারণ একটা মেয়ের জন্য একটা কী যেন অনুভব বাড়তে বাড়তে সবকিছু ছাপিয়ে গেল।
বুয়েটে চান্স হবার পর মিলা বলল একদিন– আব্বায় টাকা দিছে– আম্মায় আর আমি মার্কেটে গিয়া অনেকগুলা জামা-কাপুর কিনছি আপনের লাইগা– আম্মায় তো আপনেরে ভালোবাসে খুব–
আর তুমি? মিলার দিকে না তাকিয়ে আবছা মতো জিজ্ঞাসা করল জুলহাস। কোনোকিছু না বলে মেয়েটা জুলহাসের মুখের দিকে চেয়ে থাকল অপলক– অনেকক্ষণ ধরে।
জুলহাস নিজের মুখের ওপরে হঠাৎ করে অনেক বড় হয়ে ওঠা এক অদ্ভুত মেয়ের দৃষ্টির স্পর্শ অনুভব করল যেন। অনুভূতিটা একদম নতুন লাগল তার, কিন্তু একেবারে যেন অচেনাও নয়। মেয়েটা কিচ্ছুই বলতে পারল না। একা হয়ে কেন যেন একটু কাঁদল শুধু, বড় হবার পর এই প্রথম। তবে কেন? তা না জেনেই সে কাঁদল।
ঢাকাইয়া গোলগাল মা’টা বিকেলবেলা নিজের মনে শুকোতে দেওয়া কাপড়চোপড় গোছাতে গোছাতে বান্ধবীর গাওয়া একটা গান গাইতে থাকে গুনগুন করে–
              আমারো ছপন … আধো জাগোরোন
              চির দিন তুমারে চিনি …
              তুমি যে আমার কবিতা …

কোথা থেকে মেয়েটা এসে হাত লাগাল মায়ের কাজে। মা’টা একমুহূর্ত থেমে চেয়ে থাকলেন মেয়ের দিকে, ভাবলেন মেয়েরা আসলে ছেলেদের থেকে বড়। একদম এক বয়সী একটা ছেলে আর একটা মেয়ের মধ্যে– মেয়েটাই বড় হয়। আর হঠাৎই সে বড় হয়ে ওঠে– কখনও এক দিনেই।
কেমন করে যেন এ বাড়ির মা আজ ঠিকই টের পেয়ে যায় যে– তার মেয়েটা বড় হয়ে গিয়েছে। ছাদ বিকেলে মেয়েটার জন্য রাজ্যির ভালোবাসা যেন মা’টা আজ ভাঁজ করতে থাকে নিজের মনে–
আলমারিতে তুলে রাখবে তাই।