প্রত্যেকটি জ্বরের ঢেউ বহুদিন আগে নিহত স্মৃতির মতো ফিরে আসে। জ্বরতপ্ত কপালে, ফেটে যাওয়া ঠোঁটে, বন্ধ চোখের ভিতরে নৃত্যপর আগুনের শিখায় হাত রেখে বলে, দেখো, আমি আবার ফিরে এসেছি তোমার খেলার সাথী হয়ে; আবার পুড়ি চলো সন্ধ্যাবেলা উদ্ভট আগুনে দু‘জন। আজকাল সন্ধ্যাবেলা নিয়মিত জ্বর আসে আমার। অত উত্তাপের  মধ্যে, আচ্ছন্নতার মধ্যেও মনে হয় শীত আমার হাত ধরে নির্ভরতা চায়। হাতের আঙুলগুলো তখন ঠাণ্ডায় বাঁকা হয়ে কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে চায়; চোখ খুলে রাখা যায় না। ঘরের ভিতরের স্বাভাবিক তাপমাত্রাকেই মনে হয় সন্ধ্যার মরুভূমি। কোনো এক শীতের যুগের দিকে এগিয়ে চলেছে।
সন্ধ্যাবেলা নিয়মিত জ্বর আসে আমার। বিছানায় কুঁকড়ে শুয়ে চোখ খুলে দেখি, ঘরের ভিতরে আলো নেই। হারিকেন জ্বলছে। কেউ কপালে হাত রাখে? জলবসন্ত হওয়ায় আমার কিশোর মুখ অসমান হয়ে গেছে। অসুখের কেমন একটা ভারী ঘ্রাণ আছে। তার সঙ্গে মিশেছে ধূপের গন্ধ। আর তাতেই আচ্ছন্ন হয়ে আছে বদ্ধ ঘর। পূবের ঘরে শুয়ে আছি আমি।
‘নীলা ফুপি তুমি!’
আমার ঠোঁট নড়ে বিষ্ময়ের আঘাতে।
‘তোমাকে তো কতকাল আগে সবল মৃত্যু এসে উপড়ে তুলে নিয়ে গেছে!’
বড় বড় চোখের দৃষ্টি আমাকে ছুঁয়ে যায়। তার ঠাণ্ডা হাতের আঙুল গালে লাগে টের পাই। ঘরের বাইরে বড় উঠানের অন্য পাশে উত্তরের ঘর থেকে রেডিওতে বিবিসি‘র সন্ধ্যার খবর পড়ছে সংবাদ পাঠক;স্পষ্ট শুনতে পাই।  
‘তোর গায়ে তো অনেক জ্বর! উঠে বাইরের বারান্দায় চল। তোর হাত মুখ ধুইয়ে দিতে হবে।’
ফেব্রুয়ারি শেষ হয়ে আসছে। বারান্দায় উবু হয়ে বসি। বুনো ঘাসের গন্ধ পাই, একপাশে  কেটে রাখা তামাকের গন্ধ পাই। মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বাদুরের ডানায় হাওয়া ভাঙার শব্দ শুনি। হাওয়া দেয়। শীত করে আমার। জ্বর আমার পাশে বসে বারান্দায় পা ছড়িয়ে। নীলা ফুপি যত্নে আমার মুখ মুছিয়ে দেয়। জলভর্তি পিতলের ঘটিতে গামছা ভিজিয়ে হাত মুছিয়ে দেয়। ঘাড়ের কাছে ভেজা গামছা স্বস্তিদায়ক মনে হয়।
‘দই খাবি? মা বিকেলে বানিয়েছে।’
কোথায় কোথায় যেনো যায় জ্বরের ঘ্রাণ মাখা সন্ধ্যার সেই বিষন্ন হাওয়া। অবসরে যাওয়া পুকুরে ঘাই মারে কোনো অচেনা মাছ। অন্ধকারে পুকুরের বুকে পড়ে থাকা সুপারি গাছের ছায়া ভেঙে ভেঙে যায় ঢেউয়ের সঙ্গে। চোখ বন্ধ করে আজও দেখতে পাই আমি সেই ঢেউ। দেখতে পাই, নীলা ফুপি ডাকছে আমাকে রান্নাঘরের চুলার পাশ থেকে। সেখানে মিষ্টি আলু পুড়ছে মাটির চুলার নিভে আসা আগুনে। নুন মাখিয়ে একটু পরে খেতে পাবো।
ছনের ছাউনি দেয়া রান্নাঘরের পাশে বাঁশঝাড় ইতিহাস তৈরি করতে অক্ষম। রান্নাঘরের মাটির মেঝেতে বসে হাই তোলা হুলো বেড়ালও ইতিহাসের কিছুই জানে না। আমি তখন কবিতা লিখতে শিখিনি। পড়িনি, জীবনানন্দ দাশের সেই অমোঘ উপমা-পাখির নীড়ের মতো চোখ। তবুও বাঁশঝাড়ে পাতা ঝরে পড়ে অসংখ্য। তক্ষক ডেকে ওঠে। টের পাই, মানুষের জ্বরের ইতিহাসের গায়ে শীত লাগার অনুভূতি।
নীলা ফুপি, তুমি কেনো ফিরে এলে? রেডিওতে বিবিসি‘র খবর শেষ হলে তুমি কি গরম ভাত আর মুরগীর মাংসের ঝোল খেতে দেবে? শরীর কাঁপে জ্বরের দাপটে। তবু বিছানায় উঠে বসি চাদর জড়িয়ে। তাঁত চলার অবিশ্রান্ত শব্দ থেমে গেছে দক্ষিণ পাড়ায়। জাম গাছের শুকনো ডাল খসে পড়ে টিনের চালে। কে ভাত খাইয়ে দেয় আমাকে এখন জ্বর এলে যত্ন করে? লেবুর সবুজ ঘ্রাণের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে যায় কার নেলপলিশবিহীন লম্বা আঙুল? জীবনানন্দ দাশ মৃত্যুর বিছানায় শেষে কমলালেবু খেতে চেয়েছিলেন। আমি লেবুর ঘ্রাণ খুঁজে ফিরি জ্বরের ঘোরে অসুখের অন্তরাত্মায়।  ঘরের টেবিলে রাখা হ্যারিকেনটা জ্বলে। পোকাদের বিচিত্র শব্দ আর ছোঁয়াচে জ্বরের ক্রোধ জাগিয়ে রাখে আমাকে অনেকক্ষণ।
জ্বরের ঘোর মাঝে মাঝে ভূগোল ভুলিয়ে দেয়। জ্বরগ্রস্ত সময় আমাকে চিরকাল জীবনানন্দেও আচ্ছন্ন করে রাখে। ভাবি, জীবনানন্দ কী জ্বরে ভুগতেন? এক ধরণের তীব্র জ্বর তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলো কি না এইসব কবিতা!
‘‘এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে;
জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কিনা।
অনেক হয়েছে শোয়া;-
তারপর একদিন চলে
গেছে কোন দূর মেঘে’’
জ্বরের ঘোর না-থাকলে কি এমন কবিতার চরণ লেখা সম্ভব? জীবনানন্দ দাশ হয়তো এক দিগন্ত আচ্ছাদিত ঘোরের মধ্যে বসেই লিখেছিলেন এমন সব কবিতা যা জ্বর এলে মনের মধ্যে একের পর এক জেগে উঠতে থাকে।
ফোয়ারাশিখার মতো ধমনীতন্তুর ফাঁকে ফাঁকে জ্বরের ঘোর আমার গভীরে এমন এক চেতনার আলো জ্বালায় যা শান্তি দেয় না। ছবির পর ছবি উঠে আসে আচ্ছন্ন মস্তিষ্কে। তারা হাঁটে, তারা গান গায়। আমি কোনো কোনো ভোরবেলা শুয়ে থেকে দেখতে পাই, মানিক নগর স্টেশন ছেড়ে একটা লঞ্চ চলে যাচ্ছে। ক্যালেন্ডারে ফেব্রুয়ারি ফুরিয়ে গেলেও নদীতে কুয়াশা তখনও। ঘাটের চাপকলে জল আশ্চর্য শীতল তখনও। অসুস্থ শরীরে আমি নুয়ে হাতল চেপে পান করছি। জেগে উঠছে বাজার, মদন মিয়ার খোলা, জাম গাছ, খালের ওপর কাঠের নড়বড়ে সেতু। পুকুরঘাটের সিঁড়িতে দেখি নীলা ফুপি হাঁসগুলোকে রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে দিচ্ছে। রান্নাঘরে অনেক মানুষের কলরোল। মাটির চুলার ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে শেষ শীতের বাতাসে।
হঠাৎ চমকে চোখ খুলতেই দেখি দৈত্যের মতো আমার মুখের ওপর ঝুঁকে আছে জ্বরগ্রস্ত সন্ধ্যা। কপাল পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। একটু আগে দেখা সাদাকালো সব ছবি একটা বড় জাদুর অনুষ্ঠানের মতো নিমেষে উধাও হয়ে যায়। টের পাই, শহরের বদ্ধ ঘরে সন্ধ্যাবেলা আজও জ্বর আসে আমার। কিন্তু এখন আর সন্ধ্যাবেলা জ্বর এলে মিষ্টি আলু পুড়িয়ে খেতে দেয় না কেউ। অ্যাম্বুলেন্সের তীব্র সাইরেন, রিকশার বেল, ঝগড়াটে মানুষের চিৎকার আর গাড়ির জ্ঞানশূন্য হর্নের জঘন্য শব্দে ভরে ওঠে চারপাশ। হঠাৎ মনে হয়, আমরা একটা পূর্ণাঙ্গ আর দীর্ঘস্থায়ী জ্বরের মধে বেঁচে আছি! বাঁচতে চাওয়ার আগ্রহটাই তো ভীষণ এক জ্বর। সে একটা জীবন তোলপাড় করে কত কী ভাবায়, স্বপ্ন দেখায়। আকাঙ্খার জ্বরে কখনো আমাদের শরীর পৃুড়ে যায় অশ্লীল ভঙ্গিতে। তবুও বেঁচে থাকার লোভ টেনে নেয় জ্বরের এক আগুন থেকে অন্য আগুনে। জ্বরগ্রস্ত হয়ে অথবা ঘোরগ্রস্ত হয়ে রোগশয্যায় মনে পড়ে কবি শঙ্খ ঘোষের সেই লাইন-আজ আর কেউ নেই। ঘুমন্ত ঘরের নীল জল। এক জ্বরের মধ্যেই সবাই চলে যায়। মাথার মধ্যে বিসর্জনের বাজনা বাজে প্রবল। সত্যিই এক ঘুমন্ত ঘরের নীল জলের তলায় সবকিছু যেন ডুবে যায়। তবুও সেই সবকিছুর স্মৃতি মনের মধ্যে থেকে যায়। জ্বর আর রোদ মাথায় করে কত মাইল হেঁটে শ্যামগ্রামে ওষুধ আনতে যাওয়ার স্মৃতি, বিকেলে পুকুরঘাটে বসে জলের ঢেউয়ে নিজের একলা মুখ ভাঙতে দেখার স্মৃতি-ছটফট করে মনের মধ্যে। তারপর জ্বর ভালো হয়ে গেলে দেখি কেউ নেই। ঘরময় শুধু ছড়িয়ে আছে জীবনানন্দের কমলালেবু আর জ্বরের স্মৃতি। তখন বলতে ইচ্ছে করে ছেলেবেলা আমার খুব জ্বর এসেছিলো। আমি জ্বরের সঙ্গে সেই ছেলেবেলা থেকে  বেড়ে উঠেছি। ক্লান্ত হয়ে আকাশে তাকিয়ে দেখেছি পশ্চিম আকাশে সন্ধ্যাতারার ফুটে ওঠা।
বলাই হলো না পুরোটা।  প্রতি সন্ধ্যাবেলা আমার আজকাল জ্বর আসে। শীত লেগে হাতের আঙুলগুলো নক্ষত্রের হাড়ের মতো পুড়ে শুকিয়ে যায়। আমি মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠি। অসুস্থ আঙুল কলম আঁকড়ে ধরে অনুবাদ করতে চায় জ্বরের দিনগুলিতে গ্রামের সাদাকালো ছবিগুলি। আপন মনে হয় তাদের। সন্ধ্যাবেলা নৈঃশব্দ নেমে এলে ভূতের মতো, মনে হয়, আসলে জ্বরটাই তো জাগিয়ে রাখলো এতকাল।
প্রত্যেকটি জ্বরের ঢেউ বহুদিন আগে নিহত স্মৃতির মতো ফিরে আসে। আজও আসে তারা। অসুখের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে।