সমর মজুমদার বাংলাদেশের প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী। নান্দনিক দৃশ্য শিল্পের পাশাপাশি বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পকে তিনি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক বইয়ের প্রচ্ছদ করেছেন তিনি। সমর মজুমদারের শিল্পকর্মে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য রীতির মিশ্রণ ঘটেছে।

শৈশবের স্মৃতি–

থাকা হতো মফস্বল শহর ফেনীতে। যেখান থেকে পা বাড়ালেই গ্রামে পৌঁছে যেতাম। মনে পড়ে– মায়ের কোলে চড়ে পুজো দেখার, মামার বাড়িতে যেতে সাঁকো পার হবার স্মৃতি, পুকুরে সাঁতার কাটার ছবি; গরু চরানো, মাছ ধরা, ঘুড়ি ওড়ানো। দেয়ালে ঝোলানো থাকত কাচে বাঁধাই করা মায়ের কতগুলো সূচিকর্ম; যা মা তাঁর প্রতিবেশী বান্ধবীদের দেখাতেন। এর মধ্যে ছিল লেখাযুক্ত কিছু পাখি ও ফুলের ছবি। আমার খুব গর্ব হতো যে, আমার মা একজন শিল্পী। আমি মা’র আঁকা সূচিকর্মগুলো কাগজে আঁকার চেষ্টা করতাম।

শৈশব কৈশোরের বন্ধু যাঁরা–

কৈশোরে দু-একজন বন্ধু যারা নিজগুণে আমার জীবনে স্থায়ী হয়েছিল সুনীল তাদের মধ্যে একজন। সেও ছবি আঁকার চর্চা করত। গান গাইতে পারত। তার সাথে আমার নীরবে ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা চলত। তার সব কথা আমি বিশ্বাস করতাম। একদিন তার ধোপদুরস্ত পাঞ্জাবিতে রঙের দাগ নিয়ে প্রশ্ন করাতে সে বলেছিল আর্টিস্ট হতে হলে কিছু রং খেয়েও ফেলতে হয়। আমি তা শুনে সত্যি সত্যি রং খেয়ে ফেলেছিলাম।

প্রথম বড় ক্যানভাসে আঁকার স্মৃতি–

প্রথম বড় ক্যানভাস সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় এ প্রতিকৃতিটি আমি মিছিলে বয়ে নিয়ে যেতাম। ভারতেও নিয়ে গিয়েছি শরণার্থী-সময়ে। মা বয়ে নিয়েছিলেন তাঁর বাঁধাই করা এমব্রয়ডারি। সাথে গুরুজনদের কিছু ফটোগ্রাফ। কতজন কতকিছু বলেছে! আরেকটা বড় ক্যানভাসের কাজ বোধ হয় সাধনা ঔষধালয়ের সাইনবোর্ড।

প্রথম প্রদর্শনী–

আর্ট কলেজে প্রথম বর্ষের বার্ষিক প্রদর্শনী।

যে ব্যক্তিগত ঘটনাবলির প্রভাব আপনাকে শিল্পী করেছে–

অদ্ভুত সব ভাবনা আমার মাথায় কাজ করত। আমার মনে হতো–আমার যেমন ঈশ্বর আছে, হয়তো আমিও তেমনি কারও না কারও ঈশ্বর। হাঁস, মুরগি, কলাগাছ এই যে সারিবদ্ধ পিঁপড়ে যাচ্ছে। নিচু হয়ে তাদের ডান দিকে যেতে বলতাম, বাঁ দিকে যেতে বলতাম, দাঁড়াতে বলতাম, ওরা আমার কথা শুনত না। আমি ওদের শাস্তি দিতাম। একবার তো আমার পা কামড়ে লাল করে দিয়েছিল লাল পিঁপড়ার দল। 

নতুন বই পেলে আমি প্রথমেই ইলাস্ট্রেশনের সন্ধান করতাম। হাতে আঁকা ছবিগুলো বারবার দেখতাম। কপি করার চেষ্টা করতাম। মনে পড়ে একবার রামায়ণ থেকে রবিবর্মার আঁকা ইলাস্ট্রেশন জটায়ু বধ ছিঁড়ে আমার বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলাম। দুঃসাহসী কাজ। যার জন্য আমাকে শাস্তি পেতে হয়েছিল।

চতুর্থ শ্রেণির ইতিহাস বইতে একটি ছবি ছিল ‘অশ্বপৃষ্ঠে সুলতানা রাজিয়া’। ছবিটি হুবহু কপি করে ক্লাসে হইচই তুলে ফেললাম। কেউ বিশ্বাস করছে না যে এটি আমি এঁকেছি। এবার অন্তত পঞ্চাশটি খাতায় এটি এঁকে প্রমাণ করতে হলো যে আমি আঁকতে পারি। সারা স্কুলময় তখন খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল।

তখন ঘরে বসে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জিন্নাহর ছবি আঁকি। একটানে গোলাপ ফুল, পদ্মফুলও আঁকতে পারি। আমার বাবা শিল্পী ছিলেন না। পরিচিত মণ্ডলে পরামর্শ নেওয়ার মতোও কেউ তখন ছিলেন না। সাইনবোর্ডের লেখার দোকানগুলোর সামনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতাম। একদিন দেখি কোথা থেকে একটা দোতারা জোগাড় করে বাবা টুনটুন করে বাজাচ্ছেন। খুশিতে মনটা নেচে উঠেছিল। তিনি আমাকে ডেকে বলেছিলেন, ‘শিল্পী হতে গেলে অনেক কষ্ট পেতে হয়, সে কষ্ট সহ্য করতে হয়।’ আমি বুকে পাথর বেঁধে প্রতিজ্ঞা করেছি শিল্পী হবো। আঘাত আসবে আসুক।

প্রিয় চিত্রশিল্পী যাঁরা ও যে কারণে তাঁরা প্রিয়–

ছবি আঁকার বিষয়ে লোকজ ভাবধারা আমাকে আকর্ষণ করে। আমি সব সময় আমার ছবিতে দরজা খোলা রাখতে চাই। সে হিসেবে কামরুল হাসান, এস এম সুলতান আমার প্রিয় শিল্পী। দেশের বাইরে মকবুল ফিদা হোসাইন, যোগেন চৌধুরী, পরিতোষ সেন, গণেশ পাইন। বৃত্ত আরও বাড়ালে পিকাসো আর ভ্যানগঘের ছবি আমি খুব উপভোগ করি। বিচ্ছিন্নভাবে আরও আছে।

যে লেখকের আশ্রয়ে বারবার ফিরে গেছেন, বইগুলো বারংবার পড়েছেন–

রবীন্দ্রনাথের কবিতা, ছোটগল্প এবং বিভূতিবাবুর উপন্যাস। জীবনানন্দ, শামসুর রাহমান আমি উপভোগ করি।

চিত্রশিল্পী ছাড়া আরও যা হতে পারতেন–

কবি হতে পারতাম। কারণ, আমি খুব একাকিত্ব পছন্দ করি। আমি কবিতা লেখার চেষ্টা করে হাল ছেড়েছি। বাংলার স্যার যতই প্রশংসা করুন; একসময় আমার মনে হলো, এগুলো নিছক পদ্য ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না। 

প্রিয় সংগীতশিল্পী–

জয়তী, দেবব্রত এবং সাগর সেন।

অন্যধারার প্রিয় শিল্পী যাঁদের কাজ ভালো লাগে–  

জয় গোস্বামীর ব্যক্তিত্ব ভালো লাগে। ভালো লাগে চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের  বাক্‌পটুতা। 

আপনার চরিত্রের শক্তিশালী দিক–

আমার বিশ্বাস, আমি শিল্পের সত্যকে দেরি করে হলেও চিনতে শিখেছি। প্রতারণা আমার সবচাইতে অপছন্দ।

মানুষের ব্যক্তিত্বের যে দিকটি আপনাকে সবচেয়ে বেশি আগ্রহী করে তোলে– 

সততার সাথে প্রজ্ঞা।

প্রিয় উদ্ধৃতি–

জ্ঞানই পুণ্য, অজ্ঞানতাই পাপ– গৌতম বুদ্ধ।

এপিটাফে যা লেখা থাকতে পারে–

আমার শূন্যতা কিছু বলছে, কান পেতে শোনো।