
এ বিভাগে আইনগত সমস্যা নিয়ে পাঠকের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান।
আমার ছেলে রনির (ছদ্মনাম) বয়স ১৭ বছর। একাদশ শ্রেণিতে পড়ছে। একজন মেয়ের সঙ্গে ওর সম্পর্ক ছিল প্রায় এক বছর ধরে। মেয়েটির নাম সুমাইয়া। তারা একই ক্লাসে পড়ে। কয়েকদিন আগে তারা দুইজন বাসায় এসে উপস্থিত হয়। সুমাইয়া জানায় সে ব্যাগে কাপড়-চোপড় নিয়ে চলে এসেছে। তারা দুইজন বিয়ে করেছে। যেহেতু তাদের বিয়ের বৈধ বয়স হয়নি, তারা এক বন্ধুর বাসায় হুজুর ডেকে বিয়ে করেছে বলে জানায়। আমি সুমাইয়ার পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছি। তাঁরা জানিয়েছেন, সুমাইয়া এলে আসতে পারে। তাকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আমরা নেব না। সুমাইয়া কয়েকদিন ধরে আমাদের বাসাতেই আছে। তবে আমি শঙ্কিত। যেহেতু সে প্রাপ্তবয়স্ক নয়, আমি বা আমার ছেলে কি কোনো আইনি সমস্যায় পড়তে পারি? এখন আমার করণীয় কী?
সামরিন রহমান, ঢাকা
প্রিয় সামরিন,
আমাদের দেশে বিয়ের ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন, ২০১৭ অনুযায়ী মেয়ের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ আর ছেলের ২১। বর্তমান আইন অনুযায়ী, এর কম বয়স বিয়ের রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য নয়। তবে আমাদের দেশে বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে, বাল্যবিয়ে হয়ে এসেছে বরাবরই। সে সব বিয়ের পাত্রপাত্রী এবং তাদের সন্তান ও সংসার যাতে অসুবিধায় না পড়ে, আবার অন্যদিকে একজন ব্যক্তির ব্যক্তি স্বাধীনতাও অক্ষুণ্ণ থাকে, সে জন্য আইন এসব বিয়েকে বাতিলযোগ্য হিসেবে দেখে। অর্থাৎ যার শিশু বয়সে বিয়ে হয়েছিল, তিনি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর সময়ক্ষেপণ না করে আদালতে গিয়ে বিয়ে বাতিলের আবেদন করতে পারবেন। আবার যদি তিনি এই বিয়ে মেনে নেন, তাহলে তাও করতে পারেন এবং সে ক্ষেত্রে তাঁকে আদালতে যেতে হবে না। আপনার ছেলের বয়স ১৭। সে অথবা মেয়েটি চাইলে বিয়েকে এখনই বাতিল করতে পারে। অথবা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা আদালতে গিয়ে তা করতে পারে। এই স্বাধীনতা তাদের আছে।
এ দেশের শাসকেরা যখন মুসলমান বা হিন্দু জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যক্তিগত আইন প্রণয়ন করেন, তখন হিন্দু বা ইসলাম ধর্মের ধর্মীয় আইনকে পাটাতন হিসেবে ব্যবহার করেন। কারণ, তাঁরা জানেন, ধর্ম অনুরাগী জনগোষ্ঠী ধর্মের বিধানের বাইরে ব্যক্তিজীবনে কিছু সহজে মানবেন না। তবে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে ধর্ম ছাড়াও চলমান যুগ ও আন্তর্জাতিক মহলের প্রভাবও থাকে এবং সে প্রভাব অনুযায়ী অনেক আইন পরিবর্তন করা হয়। যেমন- বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন, ১৯২৯-এ মেয়ের বিয়ের বয়স ১৪ অতিক্রম হলেই প্রাপ্তবয়স্ক বলে উল্লেখ করা হয়; ছেলেদের ক্ষেত্রে এটি ছিল ১৮ বছর। কিন্তু ২০১৭ সালের সংশোধিত আইনে বয়স সীমা বাড়িয়ে মেয়ের ক্ষেত্রে ১৮ আর ছেলের ক্ষেত্রে ২১ করা হয়।
এখন আসি শরিয়া আইনের কথায়। যে আইনে আপনার ছেলে হুজুরের মাধ্যমে বিয়ে করেছে। বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হানাফি মুসলমানেরা কোরআন ও সহিহ্ হাদিসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত বিধিনিষেধ এবং ইমাম হানিফা কর্তৃক নির্দেশিত সেই বিধিনিষেধের বিশ্লেষণ ও বাস্তবিক প্রয়োগ অনুযায়ী তাদের ব্যক্তি জীবন পরিচালনা করে থাকেন। এই মুসলিম ধার্মিক আইনকেই বলা হয় শরিয়া আইন। আমাদের দেশে মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের উৎস হলো শরিয়া আইন। শরিয়া বলছে, বালেগ হলেই বিয়ে করা যাবে। মেয়েদের ক্ষেত্রে বালেগ-এর ন্যূনতম বয়স আনুমানিক প্রায় ৯ চন্দ্রবছর এবং লক্ষণ না দেখা দিলে আনুমানিক ১৫ চন্দ্রবছর থেকে সর্বোচ্চ ১৭ চন্দ্রবছর হতে পারে, যা ভৌগোলিক অঞ্চলভেদে ভিন্ন হতে পারে। তবে সাধারণত ১৫ চন্দ্রবছর বয়স হলেই ছেলে ও মেয়ে উভয়েই পূর্ণ বালেগ হয়ে থাকে।
প্রসঙ্গত, জোর করে ছাড়াছাড়ি করানো শুধু অমানবিক ও অনৈতিকই নয়, ছেলেমেয়ে দু’জনের জীবনেই ভয়াবহ মানসিক বিপর্যয় ও অস্থিতিশীলতা ডেকে আনতে পারে। মানসিকভাবে বিষণ্ন, বিষাদগ্রস্ত বা বিপন্ন হয়ে পড়লে দু’জনেই জীবনের প্রতি স্পৃহা হারিয়ে ফেলতে পারে। পড়ে যেতে পারে অসৎ সঙ্গ বা মাদকের কবলে। হারিয়ে ফেলতে পারে মা-বাবার প্রতি বিশ্বাস। এই অল্পবয়সে আবেগও প্রবল থাকে। তাই এই আবেগকে অন্যায়ভাবে প্রতিহত করা সঠিক কাজ হবে না। খুব চাপে রাখাও ঠিক হবে না। তবে বোঝানো যেতে পারে।
আপনার ছেলে এবং তার স্ত্রী দুইজনেরই বয়স ১৭ বছর। তারা ইসলামিক বয়ঃপ্রাপ্তির বয়সে পৌঁছে গেছে। ছেলের বয়স ২১ হলেই তারা বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবে।
নিজেকে মিথ্যা মামলা থেকে বাঁচানোর জন্য কি করবেন? আইন অনুযায়ী, মেয়ের অভিভাবক তার মা-বাবা। ছেলেমেয়ে দুইজনই একটি এফিডেভিট করতে পারে যে, তারা স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছে এবং এই বিয়েতে একসঙ্গে থাকতে চায়। তবে মেয়ের মা-বাবা যদি আইনের কাছে যান, তখন আপনাকে আইনি লড়াই লড়তে হবে। তাই মেয়ে তার মা-বাবার সঙ্গে যদি যোগাযোগ করে জানায় যে, সে স্বেচ্ছায় তার নতুন বাসায় আছে, সেটি সবার জন্য ভালো হবে।
মন্তব্য করুন