
বিভিন্ন জরিপ অনুসারে, করোনাকালে দেশে ঝরে পড়া মেয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছিল বাল্যবিয়ের হার। বাল্যবিয়ের প্রভাব যেমন পড়ে মা ও শিশুস্বাস্থ্যে, তেমনি তা দেশের অর্থনীতির ওপর এক বড় বোঝা। বাল্যবিয়ে বাড়লে কম বয়সে গর্ভধারণের ঝুঁকি বাড়ে। বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৭৪টি শিশুর জন্ম দিচ্ছেন ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মায়েরা। এ নিয়ে মতামত প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজন। গ্রন্থনা শাহেরীন আরাফাত
আমাদের দেশে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ অনেক কম। সর্বশেষ শ্রমবাজার জরিপের প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ প্রায় ৪২ শতাংশ। তার মানে কর্মক্ষম নারী ৪২ শতাংশ শ্রমবাজারে রয়েছেন। শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ কম হওয়ার একটা বড় কারণ হলো, লেখাপড়া শেষ করার আগেই অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। বাল্যবিয়ে হচ্ছে। এর যেমন স্বাস্থ্যগত ভয়াবহ ক্ষতিকর দিক রয়েছে, তেমনি অর্থনৈতিক ক্ষতির দিকও রয়েছে।
বাল্যবিয়ের পর দেখা যায়, সংসারের দায়িত্ব, সন্তান লালন-পালন– এসব কারণে তাঁর পক্ষে আর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। ওই নারী অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা থেকে ক্রমেই দূরে সরে যান। এটি নারীর ব্যক্তিগত জীবনে যেমন ক্ষতির কারণ হয়, তেমনি তাঁর শ্রমবাজারে আসার পথটা অনেক সংকুচিত হয়ে পড়ে। জাতীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আমরা যে নারীদের পেতে পারতাম, সেটি কিন্তু আর সম্ভব হয় না।
এ সময়ে দেশের প্রচুর দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন। কিন্তু বিয়ের পর অনেক ক্ষেত্রেই দক্ষতা বাড়ানোর বিভিন্ন প্রশিক্ষণে নারীরা যেতে পারছেন না। ফলে নারীর দক্ষতা বাড়ছে না। নারী শ্রম দিচ্ছেন। কিন্তু সেই শ্রম সংসারের অনুপার্জন খাতে থেকে যাচ্ছে। তার মানে যে নারী দক্ষ জনশক্তি হয়ে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারতেন, তা কিন্তু তিনি পারছেন না।
এতে নারী যেমন শ্রমবাজার থেকে সরে যাচ্ছেন, তেমন জাতি বঞ্চিত হচ্ছে সম্ভাব্য দক্ষজনশক্তি থেকে। বাল্যবিয়ের ফলে নারীরা অনেক জটিল রোগে আক্রান্ত হন। এর একটি অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে। সেই সঙ্গে এটি প্রজন্মান্তরেও প্রভাব রাখছে– অল্প বয়সে, অপূর্ণ শরীরে যে নারী মা হয়ে যাচ্ছেন তাঁর সন্তানও অনেক ক্ষেত্রে দুর্বল, অপুষ্ট হয়। দক্ষজনশক্তির মূল ভিত্তিই কিন্তু সুস্থ সন্তান। একটি দুর্বল, অপুষ্ট শিশুর শরীরে নানারকম ঘাটতি থাকে। জন্মগতভাবেই তার কর্মক্ষমতা কম থাকে। প্রজন্মান্তরে বাল্যবিয়ের প্রভাব সমাজ বয়ে চলে। কারণ ওই নতুন প্রজন্মের মানুষটি অনেক দক্ষ বা কর্মক্ষম নাগরিক নয়। যে শিশুটির বৃদ্ধি কম বা শরীরে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি আছে– অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এসব শিশু সেই মায়েদের, যাদের বাল্যবিয়ে হয়েছিল।
বাল্যবিয়ের ফলে পরিবারে নারীর ক্ষমতায়ন সেভাবে হয় না। নারীর ক্ষমতায়নের একটি বড় দিক হলো অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া। অর্থনৈতিকভাবে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে পরিবারে তার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বাল্যবিয়ের ফলে যেহেতু নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে, শ্রমবাজারে প্রবেশ করা কঠিন হয়ে পড়ছে; তাই পরিবারেও তাঁর গুরুত্ব বাড়ে না। কেউ হয়তো বলতে পারেন– ১৩ বছর বয়সে কোনো মেয়ের বিয়ে হয়েছে, পাঁচ বছর পর তাঁর বয়স ১৮ হবে। তখন পরিবারে তাঁর ক্ষমতায়ন হবে। কিন্তু তা সম্ভব হয় না। কারণ ১৮ বছরের পর বিয়ে হলে তাঁর যে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের সম্ভাবনা ছিল, সেটি তো পাঁচ বছর সংসার করার পর সম্ভব হচ্ছে না। তখন সামাজিক প্রেক্ষাপটে পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আর তাঁর থাকে না।
আইনের প্রয়োগ ও সামাজিক সচেতনতা বাড়িয়ে আমাদের অবশ্যই বাল্যবিয়ে রোধ করতে হবে। তবে কারও বাল্যবিয়ে হয়ে গেলে কী করতে হবে– এটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আগে যেমন বয়স্ক শিক্ষা ছিল, এমন শিক্ষাকার্যক্রম চালু করতে হবে অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া নারীদের লেখাপড়ায় ফিরিয়ে আনার জন্য। সেই সঙ্গে বাল্যবিয়ে হওয়া নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কীভাবে যুক্ত করা যায় তা ভাবতে হবে। মনে রাখতে হবে– শুধু জনসংখ্যায় বাড়লে হবে না, আমাদের প্রচুর দক্ষ জনশক্তি দরকার।
কান্ট্রি ইকোনমিস্ট, ইউএনডিপি
মন্তব্য করুন