বিভিন্ন জরিপ অনুসারে, করোনাকালে দেশে ঝরে পড়া মেয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছিল বাল্যবিয়ের হার। বাল্যবিয়ের প্রভাব যেমন পড়ে মা ও শিশুস্বাস্থ্যে, তেমনি তা দেশের অর্থনীতির ওপর এক বড় বোঝা। বাল্যবিয়ে বাড়লে কম বয়সে গর্ভধারণের ঝুঁকি বাড়ে। বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৭৪টি শিশুর জন্ম দিচ্ছেন ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মায়েরা। এ নিয়ে মতামত প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজন। গ্রন্থনা শাহেরীন আরাফাত

কোনো সামাজিক পরিবর্তনই ঝড়ের গতিতে হয় না। আইন পরিবর্তন-সংস্কার বা নতুন আইন প্রণয়ন করেও চট করে কোনো ন্যায্যতা নিশ্চিত করা যায় না। সামাজিক পরিবর্তনের গতি খুবই শ্লথ-ধীর। শহর, গ্রাম কিংবা প্রত্যন্ত ভৌগোলিক এলাকার সাধারণ মানুষও বাল্যবিয়ের আইন জানেন। মেয়েদের ১৮ আর ছেলেদের ২১ বছরের ন্যূনতম বয়সসীমা সম্পর্কে বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মানুষই জানেন। কিন্তু বিশ্বাস বা মানতে প্রস্তুত নন। শুধু কি তাই– বাল্যবিয়ের পরিণতি কী হতে পারে, সে সম্পর্কেও জানেন অনেকেই। অল্প বয়সে বিয়ে হলে কন্যাসন্তানটির পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাবে, সহিংসতার শিকার হতে পারে স্বামীর পরিবারে, বাল্যবিয়ে নারীর শরীরের পরিপূর্ণ বৃদ্ধি ও পুষ্টিতে অন্তরায়, সুস্থ সন্তানের জন্মের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়, সন্তানসহ ফিরে আসতে পারে আবারও মা-বাবার পরিবারে– রয়েছে এমন আরও অজস্র পরিস্থিতি। প্রায় সব গবেষণার তথ্যই বলছে– দারিদ্র্য, অনিরাপত্তা, সামাজিক কুসংস্কার, যৌন হয়রানি, যৌতুক ইত্যাদির জন্য আঠারোর আগেই বিয়ে দিয়ে পরিবার নিশ্চিন্তে থাকতে চায় সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে।

যে কোনো সংঘাত, জলবায়ুর অভিঘাত, কভিড, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন– যাই হোক না কেন, এর প্রথম শিকার আর লক্ষ্যবস্তু হয়ে যায় নারী ও কন্যাশিশু। তবে দীর্ঘ ও নিরবচ্ছিন্ন প্রচার অভিযান; সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ, কর্মসূচি ও সক্রিয় অবস্থান; স্কুলের সচেতন শিক্ষকদের সহযোগিতায় একটা পরিবর্তন দৃশ্যমান। তবে তা যথেষ্ট নয়, যেতে হবে বহুদূর। অথচ কোথায় যেন সব প্রচেষ্টা আটকে যায়– বেঁধে যায় বোধশক্তির বাইরে। আর সেটি হলো, পুরুষতান্ত্রিক বোধ-মানসিকতা ও প্রচলিত ধ্যান-ধারণার খোলস ছেড়ে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে না পারার অক্ষমতা, অনিচ্ছা, অনাগ্রহ– যা নারী ও কন্যাদের অবদমনের জন্য ব্যবহার করা হয়।

দেশের অর্থনীতি যখন দুর্বল হয়, তখন সে পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার জন্য বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য অনেক ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু বাল্যবিয়ে বন্ধ করার জন্য কি যথেষ্ট বিনিয়োগ আমরা করছি? বা যতটুকু করছি, তা কি যথেষ্ট সমন্বিত? শুধু অর্থনৈতিক বিনিয়োগ নয়, এখানে আমরা অভিভাবকরা এখনও যথেষ্ট মনোযোগী নই কন্যাসন্তানের ব্যক্তিত্ব গঠনে, আত্মমর্যাদা নিয়ে বেড়ে ওঠার গুরুত্বে, বা স্বভিমানের দৃঢ় বৈশিষ্ট্য গঠনে। অথবা নিজের ওপর আস্থা, মনোবল বাড়ানো, নিজেকে সাহসী করে তোলার বিষয়ে। স্কুলে পাঠিয়ে আর বিয়ে দিয়েই শেষ করি দায়িত্ব-কর্তব্য। সুতরাং করার আছে অনেক কিছুই। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজে বসবাসকারী জনগণ এবং রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক, প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা– সবার মানসিকতা পরিবর্তনেই সঠিকভাবে আইন প্রয়োগ হবে, সামাজিক পরিবর্তনও হবে।

পরিচালক, কর্মসূচি, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন