বিভিন্ন জরিপ অনুসারে, করোনাকালে দেশে ঝরে পড়া মেয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছিল বাল্যবিয়ের হার। বাল্যবিয়ের প্রভাব যেমন পড়ে মা ও শিশুস্বাস্থ্যে, তেমনি তা দেশের অর্থনীতির ওপর এক বড় বোঝা। বাল্যবিয়ে বাড়লে কম বয়সে গর্ভধারণের ঝুঁকি বাড়ে। বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ৭৪টি শিশুর জন্ম দিচ্ছেন ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মায়েরা। এ নিয়ে মতামত প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজন। গ্রন্থনা শাহেরীন আরাফাত

আমাদের শিশুসনদে বলা আছে– ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষ শিশু। এদিকে আবার বিয়ের বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ বছর করা হয়েছে। তার মানে রাষ্ট্র তার নিজের নীতিতেই দ্বিধান্বিত। একদিকে সে ১৮ বছর পর্যন্ত মানুষকে শিশু বলছে। অপরদিকে শিশু থাকাবস্থায় বিয়েকে বৈধতা দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের ফোকাসটা কোথায়, তার মতাদর্শিক অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।

নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যখন সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ, বিয়ে ও সন্তানের অভিভাবকত্বের প্রসঙ্গটা চলে আসে, তখন দেখা যায়– আমাদের দেশ চলে ধর্মীয় বিধান অনুসারে। ফলে সেখানে আমাদের আইন খাটছে না। ধর্মীয় উগ্রবাদও প্রচণ্ড হয়েছে। গ্রামে গ্রামে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, এমনকি অনেক মসজিদে পর্যন্ত মেয়েদের সম্পর্কে বিদ্বেষী ওয়াজ করা হয়। এসব ওয়াজ নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। ফলে এটি এখন মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এর প্রভাব রয়েছে সমাজে। এদিকে মা-বাবা মনে করছেন, পরিবারে একটি মুখ বেশি খাচ্ছে। কাজেই তাকে বিয়ে দিয়ে দিতে পারলেই ভালো। তার তো সম্পত্তির মালিকানা নেই। অনেক মেয়ে চাকরি করছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সেই অর্থের ওপর নিয়ন্ত্রণ তার নেই। ওই অর্থ স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির কাজেই খরচ হয়।

আমাদের যে সামাজিক নিরাপত্তার বলয়টি ছিল, তা আগের চেয়ে আরও ভঙ্গুর হয়ে গেছে। মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার পথ এখনও মসৃণ নয়। এখনও এ ক্ষেত্রে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। ফলে মা-বাবা মনে করেন, কোনো অঘটন হয়ে গেলে মেয়েটির আর বিয়ে হবে না। রাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে মেয়েদের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন– স্কুলে গেলে মেয়েদের খাবার দেওয়া, তাদের বৃত্তি প্রদান। কিন্তু আমরা দেখছি, সে বলয়ও করোনাকালে ভেঙে পড়েছে। ওই সময়ে ব্যাপক পরিমাণে বাল্যবিয়ে হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র তার বাজেটে ওই ঝরে পড়া মেয়েদের ফিরিয়ে আনা, তাদের শিক্ষামুখী করার জন্য যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার দরকার ছিল, তা কিন্তু হয়নি।

বাল্যবিয়ের একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে আমাদের সমাজে। তারা রুগ্‌ণ, অসুস্থ শিশুর জন্ম দিচ্ছে। তারা পড়াশোনায় থাকছে না, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে থাকছে না। ফলে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তার যে অবদান থাকার কথা, তা সে দিতে পারছে না নাগরিক হিসেবে। সে যে শ্রমটা দিচ্ছে পরিবারে তার কোনো মূল্যায়ন থাকছে না। সংসারে তার প্রাপ্য সম্মানটুকুও থাকছে না। ফলে সে পরনির্ভরশীল হয়ে থাকছে। এতে যৌতুক, নারী নির্যাতন বাড়বে। পরবর্তী প্রজন্মে নারীর প্রতি সম্মান করা, সমতাভিত্তিক সমাজে যে চিন্তা আমরা করি, তা ভয়াবহভাবে বাধাগ্রস্ত হবে।

অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়