কুড়িগ্রামের খলিলগঞ্জে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক তাহমিনা আক্তারের বাড়িতে রয়েছে তিনটি পাঠাগার। একটির

 সভাপতি তিনি নিজেই। অন্য দুটির সভাপতি তাঁর স্বামী আবুল বাশার খান ও মেয়ে অনামিকা খান। দুটিতে বই নেই। একটি ঘরের মাঝে বেড়া দিয়ে আসবাব রাখা হয়েছে। অন্যটির অস্তিত্ব না থাকলেও বই রয়েছে শয়নকক্ষে। সন্ধান সমাজ কল্যাণ, তৃণমূল উন্নয়ন ও তৃণমূল যুব মহিলা নামের পাঠাগারগুলোর বিষয়ে তাহমিনা আক্তার কোনো কথা বলেননি। তবে তাঁর স্বামী আবুল বাশার খান বলেন, ‘আমাদের পাঠাগার বাদ দিয়ে আরও যেগুলো আছে, সেগুলো খোঁজেন। তিনটির মধ্যে আমারটায় বই থাকলেও অবকাঠামো নেই।’ তিনটি পাঠাগারই ২০২০-২১ সালে এবং দুটি ২০২১-২২ সালে বরাদ্দ পেয়েছে। এরপরও নিষ্ক্রিয় থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনার যা মন চায় লিখুন।’

এভাবে কার্যক্রম ছাড়াই সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে অনুদান পাচ্ছে কুড়িগ্রামের বেসরকারি পর্যায়ের নামসর্বস্ব অনেক পাঠাগার। অনুদান পেতে বসতবাড়িতে এগুলো গড়ে তোলা হয়েছে। কয়েকটি তালাবদ্ধ দীর্ঘদিন। এক বাড়িতে একাধিক পাঠাগারও পাওয়া গেছে। কোথাও বেড়ায় ঝুলছে সাইনবোর্ড। শয়নকক্ষ বা অতিথির ঘরকেও বলা হচ্ছে পাঠাগার। কোনোটির অস্তিত্বই নেই। সদস্যরা নিয়মিত আসেন না। হয় না মাসিক সভা। রেজিস্টার থাকলেও হালনাগাদ হয় না।

জেলা গণগ্রন্থাগার ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, কুড়িগ্রামে নিবন্ধিত পাঠাগার ৬৩টি। ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৩১টি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৪ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে ২২টি অনুদান পেয়েছে। ক, খ ও গ শ্রেণিতে এগুলো বছরে ৩৫ থেকে ৬৫ হাজার টাকা পেয়েছে। চলতি অর্থবছরেও বরাদ্দের আবেদন করেছে।

অনুসন্ধানে ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, চিলমারীর জোড়গাছে আহাম্মেদ মঞ্জিল গণগ্রন্থাগার তিন বছরে ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা পেয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী এর অর্ধেক টাকার বইয়ের দেখা মেলেনি, সংস্কারও করা হয়নি। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পাঠাগারটি দুই বছর তালাবদ্ধ। আসবাব ও বই রয়েছে লাইব্রেরিয়ান আবু আহম্মেদের শয়নকক্ষে।

সাত সদস্যের কমিটির সভাপতি তাঁর স্ত্রী ফেরদৌসী বেগম। সাধারণ সম্পাদক মা রীনা চৌধুরী। আবু আহম্মেদ বলেন, মানুষজন বই নিয়ে বাড়িতে পড়ে। তবে এলাকার অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী আহসান অপূর্বর ভাষ্য, বাড়িতে বই থাকায় সবাই সেখানে যেতে সংকোচ বোধ করে।

রাজারহাটের আশা স্মৃতি পাঠাগারও ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। কিন্তু মানসম্মত চেয়ার-টেবিল নেই। বস্তাবন্দি সরকারি বই। রয়েছে ধানের বস্তাসহ আসবাব। নেই রেজিস্টার খাতাও। ‘খ’ শ্রেণির পাঠাগারটিতে দুই হাজারের বেশি বই থাকার কথা থাকলেও আছে ৬১৬টি। হরিশ্বর তালুকের জনসেবা সাধারণ পাঠাগারেরও একই চিত্র। একই পরিমাণ বরাদ্দ পেলেও বঙ্গবন্ধু কর্নার ছাড়া বই নেই। কাগজে বাজেট থাকলেও ছিল না পত্রিকা বা সাময়িকী। সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, এ টাকায় কিছুই হয় না।

উলিপুরের দড়ি কিশোরপুরের এম এ জব্বার স্মৃতি পাঠাগার ২০২০-২১ অর্থবছরে বরাদ্দ পেলেও অস্তিত্ব নেই। বই ও আসবাব রাখা হয়েছে বেসরকারি কলেজের কক্ষে। পাঠক হাজিরা ও রেজিস্টার খাতা রয়েছে পশু-পাখির খাবারের দোকানে। গ্রন্থাগারিক মো. সৈকত বলেন, সভাপতি ঢাকায় থাকেন।

কুড়িগ্রাম পৌরসভার কবিরাজপাড়ার একটি বাড়িতে পাওয়া গেছে অপরাজিতা পাঠাগার ও প্রভাতী সমাজ উন্নয়ন পাঠাগার। জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোছা. রেজিয়া খাতুনের বাড়িতে একটির অস্তিত্ব থাকলেও নেই পড়ার পরিবেশ। অন্যটিতে রয়েছে বাইসাইকেল, টিভি, আবর্জনার বস্তা ও আসবাব। নেই রেজিস্টারও। রেজিয়া খাতুন বলেন, প্রভাতী পাঠাগারে দু’তিন বছর আগে চুরি হওয়ায় জিডি করেছিলেন। অন্যটি একটি কক্ষে চালু আছে। বরাদ্দ পাননি বলে দাবি তাঁর। যদিও বরাদ্দের তালিকায় দুটিরই নাম পাওয়া গেছে।

২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৬ হাজার টাকা পায় কুড়িগ্রাম সাধারণ পাঠাগার। তিনটি কক্ষের দুটি অপরিষ্কার, দুর্গন্ধের কারণে তালাবদ্ধ থাকে। পাঠকদের টাকা দিয়ে বই পড়তে হয়। সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজন হলে বন্ধ থাকে। পড়ার কক্ষে থাকে মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেল। পাঠক লুৎফর রহমান বলেন, পড়ার পরিবেশ নেই। বাথরুমের অবস্থা খারাপ। বিদ্যুৎ বিলের জন্য টাকা দিতে হয়।

কৃষ্ণপুর উন্নয়ন পাঠাগার রয়েছে সভাপতির অতিথি কক্ষে। হলোখানা, মোগলবাসা, সবুজপাড়া ও খলিলগঞ্জ, নাগেশ্বরীর গাগলা বাজার গ্রন্থাগার, সময় পাঠাগার ও ফুলবাড়ীর সৈয়দ আমিনুর রহমান পাবলিক পাঠাগারেও এমন জীর্ণ অবস্থা। অথচ জেলার প্রকৃত অনেক পাঠাগার পাঠক ধরে রাখতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। এরপরও অনুদান মেলে না। উলিপুরের বন্ধুজন পাঠাগারের সংগঠক মো. নাঈম ইসলাম বলেন, পাঠকরা নিয়মিত বই ও পত্রিকা পড়েন। সরকারি নিবন্ধন পেলেও অনুদান পাননি।

১২৩ বছরের পুরোনো কুড়িগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরি নিয়মিত চালু থাকলেও চলতি বছর বরাদ্দ পায়নি। লাইব্রেরিয়ান নয়নের ভাষ্য, গত বছরের বরাদ্দ দিয়ে কিছু অবকাঠামো মেরামত করা হয়েছে। রাজারহাটের স্বরলিপি সাধারণ পাঠাগার স্কুল শিক্ষার্থীরা চালাচ্ছে। এর সভাপতি মো. বাদশা মিয়া বলেন, যে বরাদ্দ মেলে, তা দিয়ে চালানো কষ্টকর। বরাদ্দ পেতে উৎকোচ দিতে হয়।

এ বিষয়ে সম্মিলিত পাঠাগার আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমাজ কল্যাণবিষয়ক সম্পাদক পলাশ কুমার রায় বলেন, বেসরকারি পাঠাগারগুলো নিজস্ব অর্থায়নে চলে। সরকারি বরাদ্দ পেলে বইয়ে সমৃদ্ধ ও অবকাঠামো উন্নয়ন হয়। প্রকৃত পাঠাগারগুলো অনেক ক্ষেত্রে বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

জেলা গণগ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান কেএম মেহেদী হাসান বলেন, অনুদানের জন্য অনলাইনে আবেদন নেওয়া হয়। জেলা প্রশাসন গণগ্রন্থাগারকে পাঠাগারগুলোর অস্তিত্ব আছে কিনা দেখতে বলে। তারা শুধু প্রতিবেদন পাঠায়। এর বাইরে খোঁজ নেওয়ার সুযোগ নেই।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, বিষয়টি জানা ছিল না তাঁর। চলতি বছর যেন এগুলো বরাদ্দ না পায়, সে জন্য উপজেলাভিত্তিক তদারকি কমিটি করবেন। তদন্ত করে প্রতিবেদন দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।