দলীয় পরিচয়কে ঢাল বানিয়ে বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপব্যবহার এ দেশে বিরল কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু এই হীন প্রবণতা যে কতদূর ছড়িয়েছে; সামান্য পাঠাগারের টাকাও যে নয়ছয়কারীদের কবল থেকে মুক্তি পাচ্ছে না– তা বোঝা যায় বুধবার সমকালের লোকালয় পাতায় প্রকাশিত একটা প্রতিবেদন পড়লে। সে সংবাদ অনুযায়ী, কুড়িগ্রাম জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক তাহমিনা আক্তারের বাড়িতে রয়েছে তিনটি পাঠাগার। একটির সভাপতি তিনি নিজেই। অন্য দুটির সভাপতি তাঁর স্বামী আবুল বাশার খান ও মেয়ে অনামিকা খান। দুটিতে বই নেই। একটি ঘরের মাঝে বেড়া দিয়ে আসবাব রাখা হয়েছে। অন্যটির অস্তিত্ব না থাকলেও বই রয়েছে শয়নকক্ষে। অথচ সন্ধান সমাজকল্যাণ, তৃণমূল উন্নয়ন ও তৃণমূল যুব মহিলা নামের তিনটি পাঠাগারই গত দুই অর্থবছরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অনুদান পেয়েছে। শুধু এ তিনটিই নয়; এ রকম আরও কয়েকটি পাঠাগারের কথা ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।

বই পড়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ থাকা জরুরি। যেখানে স্থানীয় বাসিন্দারা বসে পড়ার পরিবেশ পাবেন না, সেখানে রাষ্ট্রীয় অর্থে পাঠাগার অনুমোদন পেতে পারে না। বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগারই যথেষ্ট। একই বাড়িতে তিনটি পাঠাগার অনুমোদন পায় কীভাবে? এ জন্য যাঁরা তথ্য গোপন করে একই পরিবারে একাধিক সদস্যের নামে পাঠাগার অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। পাশাপাশি তদারক সংস্থাও দায় এড়াতে পারে না।

জেলা প্রশাসন ও গণগ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ পাঠাগারের অনুমোদন দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ মনে করে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে তদারক কার্যক্রম চালালে নামসর্বস্ব পাঠাগারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

সমকালের সংবাদে কুড়িগ্রাম জেলার পাঠাগারকেন্দ্রিক অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। সারাদেশের পাঠাগারের ওপর অনুসন্ধান চালালে ফলাফল যে একই রকম বা উনিশ-বিশ হবে– তা ধরে নেওয়া যায়।

ক, খ ও গ শ্রেণিতে বিন্যাস করা পাঠাগারগুলো বছরে ৩৫ থেকে ৬৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বরাদ্দ পাচ্ছে। বছর বছর এ পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ পেলেও তিন বছরে অর্ধেক টাকার বই কেনা হয়নি এমন পাঠাগারের তথ্য সমকালের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বর্তমান বাজারমূল্য বিবেচনায় নিলে ৩৫-৬৫ হাজার টাকা একটি পাঠাগার নির্মাণের জন্য যথেষ্ট নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, চিকিৎসালয় ও ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণে অনেক ব্যক্তির দাতা হিসেবে জমি দেওয়ার কথা আমরা জানি। পাঠাগার নির্মাণের ক্ষেত্রেও এমন ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত, যাঁরা জমি বরাদ্দ দেওয়ার পাশাপাশি অবকাঠামো নির্মাণ করে স্থানীয়দের জন্য জ্ঞানচর্চার পরিবেশ সৃষ্টি করতে আগ্রহী। যাঁরা শয়নকক্ষে পাঠাগার দেখিয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থ উত্তোলন করেন, তাঁরা আর যা-ই হোন, ভালো মনের মানুষ হতে পারেন না। এমন ব্যক্তিদের হাতে পাঠাগারের অর্থ তুলে দেওয়ার ফল হলো রাষ্ট্রীয় অর্থের অপব্যবহার।

দেশে যত বেশি পাঠাগার নির্মাণ করা হবে এবং তরুণ সমাজকে বইমুখী করা যাবে, ততই আলোকিত মানুষ তৈরি হবে। বাজেটে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো ব্যাপক টাকা বরাদ্দ থাকে না। সীমিত বরাদ্দ দিয়েই উদ্দেশ্য সফল করতে হবে। তাই রাষ্ট্রীয় অর্থে যেন কারও ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। পাঠাগারের নামে তামাশাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা গেলে অন্য অনিয়মকারীরা সতর্ক হতে পারে। প্রচলিত প্রবাদ– চোর না শোনে ধর্মের কাহিনি। দু-চারজনকে শাস্তি দিয়ে চূড়ান্ত ফল নাও আসতে পারে। তাই উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে সব অনিয়মকারীকে শাস্তির আওতায় আনাই হবে উত্তম কাজ। ‘আপনার যা মন চায় লিখুন’ বলে সংবাদমাধ্যমকে দাম্ভিকতা দেখানো ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মধ্য দিয়েই শুরু করা যেতে পারে শুদ্ধি অভিযান।

মিজান শাজাহান: সহসম্পাদক, সমকাল
mizanshajahan@gmail.com