![সমরেশ মজুমদার [১০ মার্চ ১৯৪৪–৮ মে ২০২৩]](https://samakal.com/uploads/2023/05/online/photos/Untitled-57-samakal-645d3c1fda563.jpg)
সমরেশ মজুমদার [১০ মার্চ ১৯৪৪–৮ মে ২০২৩]
কোন লেখকের সাথে যদি তোমার প্রেম হয় তো তুমি বেঁচে গেলে। সত্যি সত্যিই বেঁচে গেলে। মরে গেলেও থেকে গেলে। গল্পে, কবিতার কোন এক গলিঘুঁজিতে সে তোমাকে এক আস্ত ল্যাম্পপোস্ট বানিয়ে এমন করে আটকে দেবে, পালানোর পথ নেই। কে যেন কবে আমাকে এমন বলেছিলো।
আর কোন গল্পের চরিত্রের সাথে প্রেম হলেও যে মুক্তি নেই, সেটা আমি নিজেই বুঝেছি। ভ্রমরের মতন থেকে থেকে সুর তোলে কানে। মৌমাছির মতন হুল ফোটায়, প্রেমিকের মতন মায়া ভেঙে পালিয়ে যায়।
আমি পাগলা দাশুকে নিয়ে দিশেহারা ছিলাম। পড়তে শিখেছি তখন, কেটে কেটে বানান করে। বই আছে চারপাশে, আছে কলোনির খেলার মাঠ, আর সাদাকালো বোকা বাক্স। খেলা আর টিভি দেখার সময় তো মাপা। নড়চড় হয়না। বই পড়বার সময়, কোন ঘড়ির কাটাকে তোয়াক্কা করতোনা। কখনো সন্ধ্যায় হোমওয়ার্ক ফাঁকি দিয়ে বিজ্ঞান বইয়ের আড়ালে গল্পের বই রেখে, কখনো ছুটির দিনে ভরদুপুরে, ভাতঘুমে মাখামাখি সময়ে, আঙুলে গোঁজা বই। তখন সময়টা পাখির মতন, ঝলমলে বাজ ফিনিস্ত। উড়ে আর ঘুরে। দৈত্য আসে, আর রাজকুমার, যুদ্ধ হয়, লড়াই হয়। ভালোরা জয়ী হয়, খারাপেরা পালায়।
সোনার কাঠি রুপোর কাঠি রাজকন্যা আর “গোল রুটি রুটি চলছে ছুটি ছুটি”র আমল চলছে। বানান করে উবু হয়ে বসে লবন মাখানো পেয়ারা খেতে খেতে রূপকথার বইয়ের পাতা। পড়তে শিখেছি সদ্য। কী অহংকার, কি আনন্দ! পেয়ারার সুবাস রূপকথার পাতা জুড়েও। এর মাঝে আমি পাগলা দাশুকে খুঁজে পাই। লাল মলাটের সুকুমার রায়ে পাগলা দাশু। কী নিয়ম ভাঙা সব কাজ তার! আমি এমন চরিত্র প্রথম খুঁজে পেলাম, যে খ্যাপা, অহংকারী এবং নিয়মকে গুড়িয়ে দেয়া মানুষ। কিন্তু ভারী আনন্দের। আমি চেয়েছিলাম মনে মনে পাগলা দাশু হতে, পারিনি। অতো সহজ নিয়মে থেকে নিয়ম ভাঙা?
অমন এক সময়েই, ক্লাস ওয়ান বা টুতে পড়ি বোধহয়। উপর তলার আন্টি আর আতাশাদের বাসায় দেখি দেশ। পত্রিকার পেছন পাতার একটা বিজ্ঞাপন দেখে জিভে জল আসতো, হলদে বিদেশী পনিরের মাঝে একটা পেন্সিল গুঁজে দেয়া ছবি। কিসের বিজ্ঞাপন কে জানে? বিদেশী পনির খেতে ইচ্ছে করে, আর দেশ পত্রিকা নাকে লাগিয়ে, লম্বা এক নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলি, “আন্টি তোমার গায়ে দেশের মতন গন্ধ। কী মিষ্টি।”
আন্টি বললো, “আয় বুড়ি তোকে একটা গল্প পড়ে শোনাই।”
আন্টি দেশ পত্রিকা থেকে সাতকাহন পড়ে শোনায়। যেদিন দেশের নতুন সংখ্যা বের হয়, আমি স্কুল সেরে ভাত খেয়ে দৌড়ে চলে আসি উপরে। আন্টির পাশে শুয়ে পা নাচিয়ে গল্প শুনি, দীপাবলি, অমরনাথ আর মনোরমার বেঁচে থাকার ইচ্ছের গল্প। আন্টি আমাকে পুরোটা পড়ে শোনায়না।
আমি বলতাম, “এইখানে কী লেখা আছে পড়, এই যে এই পাতায়।”
আন্টি বলতো, “না এইটা তুমি বুঝবেনা, এগুলো বড়দের জন্য। তারপর বাকিটা শোনো।”
আমি ততটুকু শুনতাম, যতটুকু আমাকে শোনানো হতো। সব আমি বুঝলাম কই তখন? এই যে যখন আন্টি সাতকাহন পড়ে চলছে, “বিদ্রোহ করতে গেলে নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হয়। নিজেকে প্রশ্ন কর তুমি তার কতটা উপযুক্ত।” আমি কী বুঝলাম? আমি বুঝলাম বিদ্রোহ খুব শক্ত জিনিস, সবার দ্বারা হয়না। পাগলা দাশু বিদ্রোহ করে, দীপাবলিও। কিন্তু তারা এক পৃথিবীর নয়। তাদের সংগ্রাম আলাদা, প্রতিবাদের প্রকাশও। এবং আমি বুঝলাম দীপাবলি সত্য, রক্তমাংসের, তাকে ছোঁয়া যায়।
যতটুকু আমার বয়সে কুলোয়, ততটুকু দিয়ে আমি দীপাবলিকে ভালোবেসে ফেললাম। দীপাবলির আলোতে ভাসলাম, আমার রূপকথারা কই হারালো! কিন্তু আমি কী দীপাবলি হতে চাইতাম? না, বোধহয়। দীপাবলির জীবনে ভালোরা হেরে যায়, খারাপেরাও হারে। কে কখন জিতবে বলা মুশকিল। এই কঠিন হিসাবের জীবনের থেকে সহজ জীবন আরামের। যেখানে ভালোদের জয় হবে,খারাপেরা হেরে যাবে।
কিন্তু জীবন, হায়, না চাইতেও দীপাবলিকে সামনে এনে দাঁড় করায়। বারবার, কতবার। ভুলে যেতে যেতে ও মনে করায়। আমরা দীপাবলিকে ভাঙি, ক্ষমতাতন্ত্রের কাঁচে দৃষ্টি রেখে তাকে মাপি। তর্ক করি, নাহ আজ দীপাবলি বড্ড বেমানান, পুরুষতন্ত্রের এক পুতুল ছাড়া কিছু আর নয়।
ভুলে যাই দীপাবলি আমার খুঁজে পাওয়া প্রথম সত্য চরিত্র। সাতকাহন প্রথম সাহিত্যপাঠ। যে সাহিত্যপাঠ জীবনের একমুঠো অন্ধকার আমার হাতে তুলে দিয়েছে। আমি শিখেছি, আলোর ওপাশের কালোও সত্য। এমন প্রথম পাঠের পর, দ্বিতীয় পাঠ, দেশ বিদেশের কত উৎকৃষ্ট পাঠ, সাহিত্যের আলো মরিচবাতির মতন ঝিকমিক করছে। যেই আলোতে আমরা সাতকাহন আর দীপাবলিকে বিশ্লেষণ করি। আর তর্ক জুড়ি সমরেশ মজুমদারের সাহিত্যিক মান নিয়ে। কিন্তু ভুলে যাই প্রথম যদি সমরেশ না হতেন, এমন আলোর পথ আমরা হয়তো খুঁজে পেতাম না। তিনি জানিয়েছেন যেন আমাদের, “এই পথ ধরে এগুলেই আলো পাবে।” এই যে অনিমেষ, জয়িতা, মাধবীলতা আর অর্জুনকে জীবনের প্রথমে খুঁজে পাওয়া পাঠকেরা আজ শোকগ্রস্ত, সেও বড় সত্য। সকল প্রথম যেমন সত্য হয়।
আর আমি কাল থেকে ভাবছিলাম, সমরেশ কী দীপাবলিকে ভালোবাসতেন? লেখককে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, “আপনি কি দীপাবলিকে কাছ থেকে চেনেন?”
ছোট্ট করে বলেছিলেন তিনি, “হ্যাঁ, আমি যেখানে থাকতাম, সে পাড়াতে দীপাবলি থাকত, আমার প্রতিবেশী ছিল।”
এই যে লিখছি আমি, কোথাও তো দীপাবলি আছে, পাগলা দাশুও। থেকে গিয়েছে। তারা একসাথে খেলছে আঁকিবুকি। কত কত প্রথম, তারা এক মিছিলে সবাই। এই যে, আমি দেখতে পাচ্ছি।
আমি ফিসফিস করে বললাম, “দীপাবলি, সমরেশ কী তোমাকে ভালোবাসতো?”
রক্তজবা লাটিমের মতন ঘুরতে ঘুরতে দীপাবলি হাসে, “তুমি বাসো ভালো?”
আমি মুখ ঘুরিয়ে লিখতে বসি,
“প্রিয় সমরেশ,
দীপাবলিকে আমি ভালোবাসি, এখনো।”
বিষয় : শ্রদ্ধাঞ্জলি কিযী তাহ্নিন সমরেশ মজুমদার
মন্তব্য করুন