
নাসরীন জাহান
শিল্পের মাঝে শর্টকাটের কোনো জায়গা নেই। শৈশব থেকে সাহিত্য করি। প্রথম দিকে লেখা পাঠিয়ে অপেক্ষা করতাম, দিনের পর দিন ছাপা হতো না। অনেক দূরে গিয়ে পত্রিকা উলটে কত যে মন খারাপ করে ফিরতাম! প্রচুর খুঁজে খুঁজে ভালো বই পড়তাম। বছরে একটি লেখা ছাপা হলেও রাজি, মহিলা পাতা প্রচুর ছাপার প্রলোভনে পড়তাম না।
পত্রিকায় দশ বছর লেখালেখি করে একটা পরিচিতি পেলে সিনিয়র লেখকদের সাথে পরামর্শ করে বই করেছি। আমরা আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, হেলাল হাফিজ, আবুল হাসনাতদের সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে পেয়েছি।
চাইলে শর্টকাটে তখনও বই করা যেত। এখনকার মতো মিডিয়া যেত না, মোড়ক উন্মোচনের হুজ্জোত হতো না। তাতে কী। আমাদের পত্রিকা ছাড়া প্রচারের আর মাধ্যম ছিল না, তখন তো টেলিফোন পর্যন্ত ছিল না।
কিন্তু প্রথম গল্পের বইয়ের আগেই কবিতা ইলিয়াস ভাই, কবি আল মাহমুদ, শঙ্খ ঘোষ, বুদ্ধদেশ দাশগুপ্ত, জয় গোস্বামীসহ দুই বাংলার … আরও যারা প্রধান সারির শিল্পী-সাহিত্যিকরা ঠিক আমাকে খুঁজে নিয়েছেন। তাঁদের সান্নিধ্যে আরও ভালো বই, পড়া, ভালো চলচ্চিত্র দেখা, নানা পরখতায় নিয়ে এসেছি জীবনকে। আমি ফেসবুকে এসেছি সাত বছর হলো, এই ছয় বছরে সাহিত্যে নতুন পালক যুক্ত করলেও যা না করলেও তা … এ সময় আগের লেখা ছাপিয়ে অসামান্য কিছু করা অসম্ভব।
তাই ধারাবাহিকতার জন্য, ভালোলাগার জন্য লিখছি। খুব ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত শুনে কান ঝালাপালা– তোমার লেখা পড়লে নারীর লেখা মনে হয় না। যেন পুরুষরা রাজ্য জয় করে ফেলেছে। স্থিত হয়ে বুঝি, আসলে আমার ভাষায় বিশেষ কোনো জেন্ডারের ঘ্রাণ আসে না, এটাই হয়তো বোঝাতে চান।
নারী পাতা নিয়ে তীব্রভাবে মিডিয়ায় কথা বলায় নারীদের পুরস্কার অনন্যা আমাকে দেবে ফাইনাল করেও বাদ দিয়েছে।
ভালো করেছে। আমি বিভাজনের মধ্যে নেই।
কিন্তু সেই প্রলোভনে পড়ার বান্দা আমি ছিলাম না। স্থিততায় অটুট ছিলাম, সিরিয়াস ধারার সাহিত্য করব, তাতে পাঠক একজন হলেও সই।
ব্যাকরণ জেনে, ছন্দ জেনে ভাঙতাম। শুদ্ধ বাক্য জেনে বাক্য ভাঙতাম, সৃষ্টি করতাম। আর জানতাম প্রচুর ভালো বই লেখকের প্রথম গুরু।
সিরিয়াস ধারার বিশ্বসাহিত্যের যত বই পড়া যায়, তত নিজের ভাষা তৈরি হয়, লেখকের মন তেপান্তর হয়।
একঝাঁক ছেলের সাথে পাল্লা দিয়ে সাহিত্য করতাম। আমার তুমুল একাগ্রতা দেখে আমাকে কেউ নারী বলে হেলা করা তো দূরের কথা, আমরা প্রাণের বন্ধু হয়ে একে অন্যকে কত যে সাহায্য করেছি।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদের সাহিত্য আড্ডায় বাংলা, বিশ্বসাহিত্য নিয়ে তর্ক করে কত যে শাণিত করেছি নিজেদের!
আমার জীবনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, তখনকার দিনের জাঁদরেল পত্রিকা দৈনিক বাংলায় আমি নাইন টেনে থাকতে ডাকে গল্প পাঠাতাম, তা ছাপা হতো।
এক সময় বিল আনতে গেছি, সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবীব চশমা টেনে বললেন– কী চাই? আমি রোমাঞ্চে কাঁপছি। তিনি বললেন শিশু বিভাগ খুঁজছ? বলে তিনি আমাকে বাচ্চাদের বিভাগ দেখিয়ে দিলেন।
আমি যখন বললাম, তিনিই আমার লেখা ছেপেছেন, গম্ভীর কণ্ঠে বললেন– জানো না, আমরা স্কুলে পড়ুয়াদের লেখা ছাপি না?
আমি নতমুখে বললাম, এমন কোনো নিয়মাবলি পত্রিকায় দেখিনি।
তিনি দাঁড়ালেন। তাঁর হাত কাঁপছিল। আমার মাথায় রেখে বললেন, কিচ্ছুর অজুহাতে লেখাটা ছেড়ো না। এটাই করতে এসেছো তুমি।
দিন চলে যায়। রোদ্দুরের ভাঁজমধ্যে জমা হয় শিশিরের মতো ধুলো। এক রংধনুর ডানার সাত রং স্পর্শ করে আরেক রংধনুর বৃষ্টিকণার হাতছানি। বয়স আর উলটানো ক্যালেন্ডারে জমতে থাকে মুঠো তেপান্তরের ধূসরতা!
হ্যাঁ স্মৃতি! রোমন্থনের মধ্য দিয়েই নতুন হয়ে উঠে!
বিষয় : নাসরীন জাহান বিন্দু বিন্দু
মন্তব্য করুন