ছোট থেকেই সন্তানের ব্যক্তিত্বের বিকাশ হতে থাকে। তবে সন্তানের প্রতি আপনার আচরণ, পরিবেশ, পরিস্থিতি, আপনার চরিত্র  ও অন্যান্য কারণে শিশুদের ব্যক্তিত্বের ত্রুটি দেখা দিতে পারে। লিখেছেন রোকুনুজ্জামান খান সাগর।

সন্তানকে নিয়ে আকাশকুসুম স্বপ্ন অনেক বাবা-মায়েরই থাকে। সন্তানের পড়াশোনা কেমন হবে, কত নামিদামি স্কুলে পড়বে, বড় হয়ে বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা নেবে– এমন সবকিছুই এক প্রকার ঠিক করে ফেলেন বাবা-মা। এতে দোষের কিছু নেই। তবে এর চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সন্তানের ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়তা করা। সন্তান কতটা মানবিক, দায়িত্বশীল ও উদার হবে, তার পুরোটাই নির্ভর করে বাবা-মায়ের আচরণের ওপর। তাই শৈশব থেকে তার প্রতি সঠিক আচরণ করতে হবে। নয়তো অনেক ধরনের ব্যক্তিত্বের ত্রুটি নিয়ে বড় হবে সন্তান।

সন্তান যদি ব্যক্তিত্বের ত্রুটির মধ্য দিয়ে বড় হতে থাকে, একটা সময় সে তার পারিবারিক, সামাজিক ও কর্মজীবনে অথবা নতুন কোনো পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারবে না। একজন ব্যর্থ মানুষ হিসেবে পরিগণিত হতে থাকবে।

বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিত্বের ত্রুটি নিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা আলোচনা করে থাকেন। তার মধ্যে পাঁচটি ত্রুটি অনেকের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়।

নারসিস্টিক পারসোনালিটি
নিজেকে সব সময় অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া, নিজেকে একমাত্র অতুলনীয় ব্যক্তি হিসেবে মনে করে নারসিস্টিক পারসোনালিটির মানুষ। পারস্পরিক সম্পর্কে এরা সুবিধাবাদী হয়ে থাকে। অন্যের বিষয়ে দায়হীন মনোভাব পোষণ এবং অন্যদের প্রতি এদের কোনো সহানুভূতি থাকে না। এমন ব্যক্তি ভাবে, সবাই তার অনুগত এবং সবাই তাকে তোয়াজ করবে।

কারণ, সন্তানকে অবাস্তব উচ্চ প্রশংসা, অতিরিক্ত প্রশ্রয়, অযৌক্তিক প্রশংসা, ত্রুটিপূর্ণ ভালোমন্দ শেখানো এবং ভ্রান্ত মূল্যবোধ ও বাহ্যিক আচরণ প্রকাশে উৎসাহিত করা– এ ধরনের ব্যক্তিত্বের প্রধান কারণ হয়ে থাকে।

প্যারানয়েড পারসোনালিটি
অহেতুক অন্যের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস এদের মূল বৈশিষ্ট্য। অন্যদের উদ্দেশ্য সব সময় এদের কাছে ক্ষতিকর বলে মনে হয়। আপনার কোনো যৌক্তিক মন্তব্যের মাঝেও দেখবেন এরা মন্দ অর্থ খুঁজবে। এদের মধ্যে ক্ষমাহীন দৃষ্টিভঙ্গি থাকে এবং আপসহীন মনোভাব প্রদর্শন করে। যার ফলে পারিবারিক ও কর্মজীবনে বাজে ধরনের প্রভাব পড়ে। সম্পর্কের অবনতি ঘটে। বাস্তবতাকে যথার্থভাবে যাচাই করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলে।

কারণ, সন্তানের ওপর প্রচণ্ড চাপ, অবিশ্বাস এ রূপ ব্যক্তিত্বের জন্য দায়ী। অযৌক্তিক আচরণ আপনার সন্তানকে আত্মবিশ্বাসহীন, লাঞ্ছনাবোধ ও অসহায়ত্ববোধের সৃষ্টি করে। এ ধরনের আত্মবিশ্বাসহীন ব্যক্তি অন্যদের ভুলভাবে বিচার করে। ভুল ধারণা পোষণ করে এবং ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

ডিপেনডেন্ট পারসোনালিটি
এমন ব্যক্তি সব সময় অন্যের অধীনে বেঁচে থাকতে চায়। অন্যের সাহায্য ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব বলে মনে করে। অন্যের ওপর দায়দায়িত্ব চাপানো, পরজীবী মনোভাব এদের ব্যক্তিত্বে ফুটে ওঠে। এরা এতটাই নির্ভরশীল হয়ে থাকে, অপরের অতিরিক্ত আশ্বাস বা পরামর্শ ছাড়া সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সহযোগিতা হারানোর ভয়ে এরা কারও সঙ্গে তর্কে জড়াতে পর্যন্ত চায় না। নির্ভর করার মতো কাউকে কাছে না পেলে এদের অস্বস্তি তৈরি হয়।

কারণ, অতিরিক্ত স্নেহ, প্রীতি ও রক্ষণশীল– সবকিছুতেই আগলে রাখার মনোভাবের কারণে শিশু স্বাভাবিক দায়-দায়িত্ব পালন থেকে দূরে থাকে। ফলে তারা স্বাবলম্বী বা আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারে না। পরবর্তী সময়ে এরাই আজীবন নির্ভরশীল ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়।

অবসেসিভ-কম্পালসিভ পারসোনালিটি
খুঁটিনাটি বিষয়ে অতিরিক্ত মনোযোগ, খুঁত খুঁতে স্বভাবের এবং সবকিছু নিখুঁতভাবে হতেই হবে– এমন ব্যক্তিত্ব আমদের আশপাশে দেখলেই আমরা খুঁজে পাব। এরা সংকীর্ণ ও অনুদার হয়ে থাকে। কাজের সূচিপত্র ও বিধিবিধান নিয়ে এতটাই মগ্ন থাকে, আসল কাজের মূল লক্ষ্য হারিয়ে ফেলে। কাজকে সম্পূর্ণ গুরুত্ব দিতে গিয়ে এদের মধ্যে অসামাজিক আচরণের লক্ষণ প্রকাশ পায়। কোনো কাজ অন্যকে দিয়ে ভরসা পায় না। এমন  ব্যক্তিদের মধ্যে জেদ ও একগুঁয়েমি ভাব প্রবলভাবে দেখা দেয়।
কারণ, মানবজীবনের দোষ-ত্রুটি ও ভালো-মন্দ দিকগুলোকে সন্তানের কাছে স্বাভাবিকভাবে উপস্থাপন না করে অনেকেই এড়িয়ে যান। মানুষ কেউ-ই নিখুঁত হতে পারে না। এই সত্যটি অনেকেই উপলব্ধি করতে পারে না। যার ফলে তাদের সন্তানদের মধ্যে এই ধরনের সমস্যা প্রবল আকারে দেখা যায়।

বর্ডার লাইন পারসোনালিটি
এই ধরনের ব্যক্তিরা সাধারণত নিজ অস্তিত্ব সংকটে ভুগে থাকে। সম্পর্ক তৈরি করতে পারলেও সুসম্পর্ক বেশিদিন ধরে রাখতে পারে না। আবেগের অস্বাভাবিকতা এদের মধ্যে অনেক বেশি দেখা যায়। নিজের ভুল বুঝতে পেরে পরবর্তী সময়ে এত বেশি অনুতপ্ত হয়ে যায়, যেখানে নিজেই নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা দেখা যায়। যেমন– ধারালো অস্ত্র দিয়ে হাত-পা কাটা, দরজায় বা দেয়ালে মাথা ঠোকা ইত্যাদি।

 কারণ, পিতামাতার উষ্ণ সম্পর্কের অভাব, গুরুত্বহীনতা, অবমূল্যায়ন, অভাব ও অবহেলায় বেড়ে ওঠা সন্তানদের আচরণে সাধারণত বর্ডার লাইন পারসোনালিটি বেশি দেখা যায়। ব্যক্তিত্ব গঠিত হতে সহায়ক ফ্যাক্টরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরত্ব আরোপ করা হয় পারিবারিক পরিবেশ ও পারিবারিক শিক্ষাকে। সুতরাং আপনার সন্তানের সম্ভাবনাময়, সুন্দর ও সুস্থ জীবনযাপনে পিতামাতা হিসেবে আপনার দায়িত্ব ও কর্তব্য অনস্বীকার্য।

বিষয় : সন্তানের ব্যক্তিত্ব ব্যক্তিত্বের ত্রুটি

মন্তব্য করুন