
এক. শুরুতে কিন্তু সাদা সরল সত্যটাকেই জানান্তি দিচ্ছি!
নিজের, একদার, মুগ্ধতা বিষয়ে এখন আমি যা যা বলতে যাচ্ছি, সত্য সত্যই তার সবটাই সত্য বলছি। কিন্তু এই সত্য বলতে গিয়ে, নিজেকে নিয়ে কুণ্ঠা ও লজ্জায় আমার মাথা আর মাথার জায়গায় থাকছে না। সে রাত্রিবেলার সূর্যমুখীর মতন কাত হয়ে যাচ্ছে। হয়েছে কী, সুশীলজনের সামনে নিজ রুচি-আকুলতা-মুগ্ধতা নিয়ে জবান উঁচোই, আমার অবস্থা মোটেও তেমন সুবিধার নয়। এই যে আমার রুচি ওরফে মুগ্ধতা– সে উচ্চ মানসম্পন্ন পালংশাক শ্রেণির নয়। সে নিতান্তই অখ্যাত, বুনো, ডগডগা শেচি শাক গোত্রীয়। আফসোস!
যারা আমার হিতকামী (আদপেই আছে নাকি কেউ! একজন হলেও, আছেন কি কেউ?), তারা হয়তো বলবেন; রুচি উন্নত নয় তো সমস্যা কী! মাজাই-ঘষাই দিয়ে দিয়ে উন্নত করে নিলেই হয়!
তেমনটা যে করে নেওয়া যায়, সে কি আর আমি বুঝি না? বুঝি তো! কিন্তু যখনই নিজেকে পরিশীলিত করে তোলার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে যাবার জন্য মনস্থির করতে থাকি, তখনই আমার মাথার ওপর সমস্তটা আকাশের নীল আছড়ে আছড়ে পড়া শুরু করে। তখন এমনই বেদিশা বেদিশা লাগতে থাকে যে, নিজেকে সুসংস্কৃত করে তোলার কর্মে আর এগোনো হয় না। সেই কারণে কদাপিই আমার আর সুরুচিঅলা-সুসংস্কৃত হয়ে ওঠা হলো না।
ওফ! আমার কী হবে!
দুই. একদা তুমি প্রিয়!
হে আমার আদি মুগ্ধতা, তোমার নাম জুবি! তোমার নাম রাজ্জাক! তোমার নাম চিত্রালী! তোমার নাম মোহাম্মদ আবদুল জব্বার!
তখন জেগে উঠেছিলাম। আশপাশে দৃষ্টিও ছড়িয়ে নেওয়া হয়ে গিয়েছিলো ততোদিনে, অনেক অনেকখানি। দেখে নিয়েছিলাম চৈত্র মাসের ঝকমালো বউন্না ফুলের বাহার। ততোদিনে চোখ পেয়ে গিয়েছিলো হিজল ও কচুরিপানার পুষ্প-রংধনু। ততোদিনে স্বাদ নিয়ে উঠেছিলাম প্রায় প্রায়ই, সকাল করে করে, কাঞ্জির জাউ আর ডিম ভাজা আর পুঁটির শুঁটকির মহাতপ্ত-ঝাল ভর্তা। সন্ধ্যা ভরে দুরন্ত সব পরস্তাব-কথা, অনেক অনেক, শুনে উঠেছিলাম। পড়ার বই থেকে ঠেসে, কতো সব ইতিহাস, কতো সব পদ্য, কতো সব ব্যাকরণ– মুখস্থ করার বাধ্যতামূলক বিধিও পালন করে উঠছিলাম। আর একটু থেকে, আরও একটু করে করে বয়স্ক হয়ে উঠছিলাম। হয়ে উঠেছিলাম আস্ত একটা ষোলো বছর বয়স্ক মানুষ। এসএসসি শেষ, কলেজ শুরু।
জীবনের মধুরতম পর্যায়?
দূর দূর দূর! যে বলে সে অতি মিথ্যা বলে। সে না-বুঝেই অই বয়সরে অমন সোনার-বরনী বলে ঘোষণা দেয়। আন্ধা-বয়রা সে।
এই পনেরো-ষোলো বছর বয়সকে কে চায়?
আমি তো চাই না! একদম না!
হায় হায়! এর আগে শুধু মিষ্টি কথা আর মিঠা মিঠা বুঝ দিয়ে বলা হতো, ওটা করতে নেই, অমনটা করে না মানিক! আসো, মোহনভোগ রান্ধছি। খাও দেহি?
আর যেই না পনেরো-ষোলো বছরের বয়সটা এসে হাজির হলো, অমনি সর্বকর্মে কেবলই হুঁশিয়ারি, সর্বকর্মে কেবলই সতর্কীকরণ কণ্ঠ। কেবলই কটকটা নিষেধ, কেবল গালমন্দ, কেবলই নিষেধ। এইটা করো, কিন্তু অইটা কইরো না। পুব-পশ্চিম-উত্তর– সর্বদিকে যাও; কিন্তু দক্ষিণ দিগে, খবরদার যাইবা না!
ক্যান ক্যান? দক্ষিণে কী?
দক্ষিণে জোবেদাগো বাড়ি।
‘খবরদার কইতাছি, অমুকগো বাড়ির জোবেদার লগে য্যান চলাচলতি করতে না দেহি! তোমার আব্বায় কইলাম জানলে আমারে আস্তা রাখবো না!’
ক্যান ক্যান? জোবেদার দোষ কী? আমি তো দেখি, জোবেদা এক অতি হাস্যবতী মেয়ে। পড়তে তার একেবারে ভালো লাগে না সত্য, কিন্তু সে তো লোকের সাথে কলহ-বিবাদে নাই। ঘরের কাজকাম করতে তার দম-ফাঁপর, দম-ফাঁপর লাগে। পড়তেও তো তার কিছুমাত্র শান্তি লাগে না। সেই কারণে সে খালি নিঃস্বাধীন হতে চায়!
‘কেমনে লোকে নিঃস্বাধীন হয়, জুবি?’
‘নিজ সংসার হইলে!’
‘নিজ সংসার আবার কী?’
‘আরে বেক্কল, বিয়াশাদি হওন! তাইলেই নিঃস্বাধীন!’
অন্য মানুষের বাড়িতে গিয়ে কেমনে লোকে নিঃস্বাধীন হবে, সে আমার বুঝে কুলায় না সত্য, কিন্তু আমি মুখ খুলি না। খুললে যুদি জুবি বেজার হয়? তহন যুদি উয়ে অর চিত্রালী পেপারটা আর পড়তে না দেয়! তাহলে আমার কী হবে! আমি সেই পেপার তবে কই পাবো? সারা পাড়ায়, এক এই জুবিই, প্রতি শুক্রবার করে করে, চিত্রালী কেনে। আমি কেমনে কিনবো! আম্মায় জিন্দিগিতেও কিনতে দেবে? দিবে না। ওইটা পড়লে তার মাইয়ার মাথা-নষ্ট হইয়া যাইবো তো! ওরে সব্বনাশরে!
জুবি মাসের মধ্যে যখন-তখন কেবল রাতের শেষ শো-তে সিনেমা দেখতে যায়, সেটা সত্য। যাবে না কেনো! তার কিসমত হলো অতি খোশ-কিসমত। যারে বলে চান-কপাইল্লা, জুবি হইলো তা-ই। তার ভাই-ভাউজের সীমা-সংখ্যা নাই। তারা যখনই ফিলিম দেখতে যায়, জুবি তাগো পিছ ধরে। তারা তখন তারে না-নিয়া পারে নিকি? তারা তো আর আমার বাপ-মায়ের মতন কাঠুইরা-দিলের না! জুবির চোখ নিঃশব্দে আমারে নিন্দা-মান্দা দিতে থাকে।
দেওয়াই ন্যায্য। কারণ আমার মা-বাপও হরদমই রাতের শেষ শো-তে সিনেমা দেখে। প্রায় প্রায়ই দেখে। কিন্তু আমাদের একটা-কোনো ভাইবোনেরে জীবনেও নেয় না!
কী কারণ?
‘না না! পোলাপাইনে এইসব দেখলে না অগো মাথায় দোষ পইড়া যাইবো!’ আব্বা-আম্মার সিধা বিধি; ‘আর, রাইত কইরা এটি দেখলে, পরদিন আর পড়ালেহা হইবো? ইস্কুল কামাই হইবো না! কয় কী!’
অই অমন শেষ শো দেখতে গিয়ে গিয়েই না জোবেদা খাতুনকে আমার বাপ-মায়ের প্রায় নিত্যই চোখে পড়ে। অট্টুক মাইয়ায় নি এমুন সিনেমা-খাউন্তি শুরু করছে! অর উপায় কী! অর লগে বোলে পোলাপাইনরে মিলমিশ করতে দেওন যায়! ছেড়ীয়ে না অন্যগিলির ভিতরেও সিনেমার পোকা ঢুকাইয়া দিবো! মাথা না নষ্ট কইরা দিবো! খোদা-মাবুদ! কাজেই জুবির সঙ্গ আমার জন্য চিরনিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
কিন্তু আব্বা-আম্মায় কী যে ভুল করে! আমি হলাম গিয়ে আদম সন্তান! নিষেধ ভঙ্গ করার মহাপ্রতিভাসম্পন্ন আদি মাতাপিতার বংশধর! সেয় নিকি দক্ষিণ দিকে যাইবো না! যাইবোই। সেয় নিকি জুবিগো বাড়িতে পাও রাখোনের পন্থ বিছরাইয়া বাইর না-করোনের বান্দা! করবোই। জুবির কেনা চিত্রালী সেয় হাতে নিবোই নিবো!
এতো যে সিনেমা দেখে জুবি, তাতেও নাকি তার হাউস মিটে না। যেমন নাকি রাজ্জাক-সূচন্দার ফিলিম দেখলে কী আর আসল ফিলিম দেখোনের হাউস মিটবো? কোনোদিন মিটবো না!
‘ক্যান ক্যান? মিটবো না ক্যান? আসোল ফিলিম আবার কোনটি? জুবি?’
‘আরে! আসোল ফিলিম হইলো কবরী আর রাজ্জাকের ফিলিম! হেরা দোনোজোনে, যেমুন যেমুন কইরা দোনোজোনের দিকে চাওনটা দেয়! মাবুদ খোদা গো! হেইটা দেখলেই কইলজার ভিতরে জানি কেমুন গুটগুটানি দিয়া ওঠে! কেমুন কেমুন জানি লাগে! ওরে মা!’
আহ! জুবির কইলজার ভেতরে গুটগুটানি দেওয়া রাজ্জাক-কবরী! তোমাদের সিনেমা আমি যে কবে দেখতে পাবো! কবে যে! এমন নিদয়া হয় কেনো মা-বাপগুলা? এমন নির্দয়! সিনেমা দেখতে যাইতে দেয় না! নিজেকে বঞ্চিত-লাঞ্ছিত মনে হতে হতে আমার চক্ষে জল টুলুস টুলুস করতে থাকে। সেই জল কি নামতে দেওয়া যায়? জুবি দেখলে শরম না?
কিন্তু জুবি এমনই বুঝদার মেয়ে, সে আমার কষ্ট একদম ঠিকঠাক ধরে ফেলতে পারে। সে তড়বড় করে বলতে থাকে, ‘মোন বেজার করিস না বইন! তুইও যহন নিঃস্বাধীন হবি, তহন কতো দেখবি ফিলিম!’ (ওহো রে কিসমত! জুবি, বইন! জানি না তুমি অখন কই আছো! হোন হোন! অদ্যাবধি আমার কিসমতে নিঃস্বাধীন হওনের ফুরসত হইলো না!)
তো, শুধু ফিলিম দেখে দেখে, হাউস মিটে না বইল্লাই জুবিরে এমুন চিত্রালী পেপার কিনতে হয়। আবার সিনেমা হল থেকে বের হয়েই কিনে নিতে হয় সিনেমার গানের বই! নয়া সিনেমার গান রেডিওতে বাজোন শুরু হওনের বহুত আগেই, সেই গান দেখো, জুবি ঢগঢগায়ে তরতরায়ে গাইয়া ফানাফিল্লা হইতে থাকে। এই যে বেঈমান সিনেমার গান!
‘হোন গানটা! হোন না?’ জুবি তার গলা ছিন্নভিন্ন করে করে মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের গান গাইতে থাকে, ‘আমি তো বন্ধু মাতাল নই/ মানুষ যদি মোরে না-ই বলো/ বেঈমান বলো বেঈমান!’
ওহ! মোহাম্মদ আবদুল জব্বার! এতো মায়া কেমনে ছড়ান আপনি! এই ষোলো বছরের দুনিয়ারে যে তছনছ করে দিতে থাকে সেই মায়া! সেই এক রাতের নয়টা ত্রিশের অনুরোধের আসরে, রেডিওতে, আপনি গেয়েছিলেন না, ‘তারাভরা রাতে/ তারাভরা রাতে তোমার কথা যে/ মনে পড়ে বেদনায় গো/ মনে পড়ে বেদনায়’? সেদিন জানেন, আমি প্রথম বুঝেছিলাম, শুধু আমাদের উঠানের কামরাঙা পাতারাই না, আকাশও কেঁপে উঠতে জানে। কেঁপে উঠতে পারে! যদি আপনি সুর তোলেন! যদি আপনি! (আমি ওই সেদিনই, প্রথম, তারাভরা আকাশকে চক্ষের গহিনে গেঁথে নিতে শিখেছিলাম! আপনি গেয়ে উঠেছিলেন বলে। এই যে দেখুন, এই যে এখনও, আমার চক্ষের গহিনে আপনার কণ্ঠ হয়ে ওঠা তারারা ঝিকমিক, ঝকমক করে চলছে!)
যদি আপনি গেয়ে ওঠেন, ‘দুষ্টুমি যার চোখের পাতায়/ কাজল হয়ে হাসে/ সে যদি আজ একটু থাকে পাশে/ আমি দুষ্টু হাওয়ার চঞ্চলতা/ দেখবো না!’ আহ! আমার তখন নিজেকে কেমন ফেলনা ফেলনা, কেমন কেউ-না কেউ-না যে লাগতে থাকে! আহা গো! আমার চোখে তো কাজল ওঠে না কখনো। আমার চোখ কেমন কুটকুট করতে থাকে, কাজল দেওয়ার কথা শুনলেই! কাজল ওঠে জুবির চোখে, সঘন লেপটানো কাজল। তাহলে এই গান শুধু জোবেদার জন্য! আমি কেউ না, আমার জন্য কিছু না! ঈর্ষায় আমার পরান ব্যথা পেতে থাকে, কেবল টনটনাতে থাকে।
মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, সেই আপনার এই নতুন গান! এটা? এই যে বেঈমান বলো বেঈমান! আমার প্রাণ কাতরে উঠতে থাকে। কবে রেডিওতে বাজবে এই গান? কবে? কবে আপনাকে শুনতে পাবো! কবে আবার আমার মন, নতুন করে, অকারণ-অহেতুক কষ্টে ব্যথিত-বেজার হয়ে ওঠার আহ্লাদকে পাবে? কতোদিন পরে!
আর সেই শুক্রবারেরই চিত্রালীর পাতায় রাজ্জাক ও কবরীর ছবি! মন-ছলকানো, অন্তরঙ্গ, যুগল ছবি! পাতাভরা যুগল ছবি! ছবির ওপরে লেখা আছে– তুমি যে আমার কবিতা!
‘দেখছস? দেখছস? হেগো দোনোজোনেরে দেখলে মোনের ভিতরে কেমুন ইটিস-পিটিস লাগে? দেখলি?’ জুবি সোহাগে ঢলকাতে থাকে। আর আমি; তখনো যেই রাজ্জাকের একটাও কোনো সিনেমা, হলে গিয়ে দেখে ওঠার ভাগ্য পাই নাই; সেই আমি কিনা জোবেদার মতন সিনেমাখোর আহ্লাদীকে হিংসা করতে থাকি। সেই রাজ্জাক, যার স্মিত হাসি, শুধু চিত্রালীর পাতায় দেখে দেখেই, আমি শিখে যাচ্ছি পরান ধুকপুকানোর নয়া নয়া অন্ধিসন্ধি; ভালো লাগছে-ভালো লাগছে! সবকিছু কেবলই ভালো লাগছে আমার!
সেই তাকে নিয়ে জুবির অতো আকুল হওয়ার দরকার কী! উয়ে অর নিঃস্বাধীন হওনের চিন্তা নিয়া থাকুক না? রাজ্জাকরে নিয়া উয়ে বেতালা হয় ক্যান? রাজ্জাকরে দিয়া অর কোন দরকার!
অমন যে উপকারীবান্ধব জুবি, যে আমারে কিনা ফুরসত পেলেই চিত্রালী পড়তে দেয়, রাজ্জাকের নতুন সিনেমার গল্প শোনায়ে শোনায়ে ফাতাফাতা করে দিতে থাকে; সেই জুবিরেই কিনা আমার অমন বিষ-তিতা লাগতে থাকে। আমি যে একটা কী হিংসুনী! কেমুন যে বাদ-হিংসা বোঝাই আমার অন্তর! নিজেরে নিয়ে আমার তখন কেমন যে শরমটা লাগতে থাকে।
তিন. যে-আঙুল একদিন বে-সম্ভবকে প্রায়-সম্ভব করে তুলতে যাচ্ছিলো!
তুমি আমার বিষম মুগ্ধতা, উথাল-মাতাল মুগ্ধতা! তোমার নাম ‘আসল সোলেমানী খাবনামা ও অব্যর্থ তাবিজের কিতাব!’ ও হো! আমাদের কতোদিন দেখা নাই! আর কি হে হবে দেখা?
‘তগো নানীগো বাড়ির সিন্দুকে যে একটা বহুত দামি কিতাব আছে, তুই জানোস হেইটার কতা?’ জুবি একদিন মারমুখী হয়ে আমার সামনে দাঁড়ায়। কিছুর মধ্যে কিছু না, আমার দোস্তে আতকা আমার উপরে এমুন চেত করে ক্যান! চিত্রালীতে ‘আপনাদের চিঠি পেলাম’-এর চিঠি পড়তে থাকা আমারে– এইটা কী জিগায় সে! কিসের কিতাব!
‘হ! তামান দুনিয়ার মাইনষে হেইটার কতা জানে, আর তুমি বুঝি জানো না? মিছা কতা কম কবি, আমার সামনে!’ জুবি আরও রোষে ওঠে। কিন্তু সত্যই তো আমি ওটার বিষয়ে কিচ্ছু জানি না! কিসের কিতাব রে!
‘কিসের কিতাব আবার? অইখান হইলো এক খাবনামা! অতি আদত সোলেমানী খাবনামা ও তাবিজের কিতাব হেইটা! সেইনে সকল স্বপনের অতি খাঁটি অর্থ দেওয়া আছে। কোনো ভেজাইল্লা, মিছা, বুঝের কতা অইটাতে নাই! বুঝলি?’
আমি কিতাব বৃত্তান্ত রেখে, আবার চিত্রালীর চিঠি পড়ায় যেতে চাই। জুবি আটকানি দেয়। ‘দেখ, আমি নিত্যিই কতো কী আউলা স্বপন দেহি। স্বপনে কতো যে ডরান ডরাই। কিন্তু এইসব স্বপনের আগা-মাথা বোজোনের কোনো রাস্তা নাই আমাগো! বইখান যুদি তর হাতে থাকতো, তাইলে আমার ডর ঘোচতো। কোনো স্বপন লইয়া কোনো চিন্তা-ডর আমার অন্তরে থাকতো না! হুনলি বইন, আমার কতাখান?’ জুবি মিনতি করা ধরে।
‘আরে বাপ্পুইস রে বাপ্পুস! খাবনামার লেইগা নি এমুন উতলা হয় মাইনষে!’ আমার তাজ্জব লাগতে থাকে। তবে সেই তাজ্জব হওয়াটা আরও ঘন আরও তুমুল হয়ে ওঠে ‘আসল সোলেমানী খাবনামা ও অব্যর্থ তাবিজের কিতাব’খানা হাতে পাওয়ার পরে। ওরে আল্লাহ! স্বপন নাকি এতো এতো প্রকারের হয়! আর তার অর্থও নাকি এতো এতো রকমের হয়! ইসস! আমি কেনো এতোদিন এই বইকে হাতে নিইনি! কোনো খোঁজও কেনো করিনি! এমন বেতালা যা-তা কিসিমের কেনো আমি! নিজের জন্য নিজেকে আরও কতো লজ্জা না-জানি পাওয়া লাগবে! ধুর!
তবে নিজেকে নিয়ে গ্লানিতে থাকার অবকাশটা তখন, বিশেষ পাই না আমি। জুবি ধমাদ্ধম হামলে পড়তে থাকে। দিনে ঘুমালে সে একরকমের স্বপন দেখে, রাতের বেলা আবার অন্য রকম। এইসব কিসের আলামত! এইসব স্বপনের মরতবা কী, অর্থই বা কী! দুপুরের ঘুমে জুবি দেখে, কলা বোঝাই এক গাছ। খাবনামা বই বলে: ‘গাছ ফলবান দেখিলে– সুখী হইবে।’ সন্ধ্যারাতের ঘুমে জুবি এমন স্বপন পায়; মাইট্টা পাতিলে য্যান দুধ বলক দিয়া ওটতাছে খালি। খাবনামা বই বলে: ‘দুগ্ধ বলক দিয়া উঠিতে দেখিলে– আশা পূরণ হইবে।’
স্বপনের অর্থ জেনে জেনে জুবি যতো না আহ্লাদে বলকাতে থাকে, তার চেয়ে বেশি অনেক অনেক বেশি ছলকাতে থাকে আমার অন্তর! এমন বইও আছে! স্বপনের সকল কথার এমন মীমাংসা দিতে জানে যেই বই! এরে যদি আমি তন্নতন্ন করে পড়ে না-উঠছি, তো কী কইলাম! আমি তারে পড়তে থাকি, মন বিস্ময়ে ভরতে থাকে! আমি তারে পড়তে থাকি, মন কাঁপতে থাকে ভয়ে ও রোমাঞ্চে! দেখো দেখো, এই বইয়ের তাবিজের কথা অংশে কতো কতো নিদানের সন্ধান দেওয়া আছে!
এখন আমার নানাবাড়ির লাউগাছের ফুল কুঁকড়ে কুঁকড়ে মরে যেতে থাকলেও চিন্তা নাই। আমি কবজ বানায়ে গাছের গোড়ায় লটকে দিতে পারবো! সব মুশকিল আসান হয়ে যাবে! আরও কতো রকমের কবজের কথা যে লেখা আছে! সেগুলার নাম দেখেই তো ডর লাগতে থাকে। বাপরে বাবা! কিসের নাকি ‘ভালবাসা ও অনুগতকরণের তদবির’ আছে। আছে ‘মন বশীকরণের তদবির’। আরও আরও তদবির। মা রে মা। এইগুলা কী! এইসবের দিকে আমি কোনোদিন যেনো না তাকাই। কিসের থেকে শেষে না-জানি কী হয়ে যাবে!
তার মধ্যে আচমকা জুবির একটা কবজের দরকার পড়ে। কিসের কবজ লাগবে তার?
‘না! আমাগো লাউগাছের ফুলটি, টেমরা ধইরা, পইড়া যাইতাছে গা! তুই একটা কবজ লেইক্ষা দে দোস্ত!’
‘ও! এইটা তো সোজা বিষয়!’ এই নিদানের খোঁজ আমার হাতে আছে! দেখো কারবার! ফুটানির চোটে আমার মুখ-মাথা দিয়ে ভাপ বেরুতে থাকে। চোখ যেনো আর কিছুই দেখতে পেতে থাকে না। সেই সময়ে জুবি বইয়ের একটা কবজরে আমার সামনে ধরে বলে, ‘দে দে! এইটা কাগজে লেইক্ষা দে!’
‘এইটা কোনটা?’ আমি জিজ্ঞাস করি, ‘ফুল রক্ষা করোনের কবজের নকশা তো এমুন না!’
‘এইটা আরেকটা কবজ! তুই এইটারে খেয়াল করস নাই? অন্যগিলি যেমুন-তেমুন, এই কবজখানই হইলো মোক্ষম জিনিস! লেখ লেখ!’ জুবি ঝটংপটং কবজখানা লেখায়ে নেয়। আমি নিদান দিতে পেরে কতো যে অহংকার পেতে থাকি!
জুবির কবজ নেওয়ার সত্য কারণটা তিন দিনের মধ্যে সর্বলোকে জেনে ফেলে। আম্মাও জানে। লাউফুল বাঁচানোর কবজের ছুতা করে জুবি যে আমাকে দিয়ে মন বশীকরণের কবজ লেখায়ে নিয়েছিলো, আমি তো জানি নাই! হায় হায়! সেই কবজ নিয়ে সে মনা ভাইয়ের ঘরের পাশের হাসনাহেনা গাছের ডালে সুন্দরমতো বেঁধেও এসেছিলো।
তারবাদে তিন রাত্রি পার হয় নাই, দেখো মনা ভাই স্বয়ং সেই তাবিজ হাতে এসে দাঁড়ায় জুবির সমক্ষে! ওরে গাফুরুর রাহিম! কবজের কী গুণ! যেয় কিনা জুবির দিগে ফিরাও চায় না, সেয় আইয়া স্বয়ং খাড়া জুবির সামনে। তারবাদে হাউকাউ, বকাবাজি যতোই সে করুক; তাতে কী! জুবির লগে কথা কওয়া তো শুরু করছে! আগে তো জীবনেও কতা কয় নাই! কেমুন আগুইন্না কবজ এইটা! কেমুন তুক্ষার!
জুবি আহ্লাদে ফাল পাড়তে থাকে একদিকে, আরেকদিকে আম্মা ডালঘুটুনি হাতে আবার আমার দিকে তেড়ে আসে। ‘এইটা লইয়া বারোটা ডাইলঘুটুনি ভাঙল– এই মাইয়ার লেইগা! ইছ তোবা! এইটা কেমুন বেদ্দব মাইয়া! এমুন মাইর খায়!’ আম্বিয়া ফুপু চিল্লানি দিতে থাকে।
‘এমুন কইরা দুর্নাম কিনে মাইনষে! হায় হায়! লোকে এটি কী কইতাছে! মাইয়ায় বোলে তাবিজকরোনী ডাইন হইছে! হায় হায়!’ আম্মা কাঁদতে কাঁদতে ডালঘুটুনির বাড়ি চালাতে থাকে, আমার পিঠে। আমার চোখের সামনে, চুলার ভেতরে, অই তো, অমন তুক্ষার খাঁটি কবজের বইটা, দাউদাউ পুড়ে যায়! আহা রে! অমন খাঁটি বইটা!
আহা রে!
চার. পরিশিষ্ট
অন্য সকল মুগ্ধতা কবে যে কীভাবে ফিকে হয়ে গেছে, মনেও করতে পারি না আর। কোনোটা হয়ে গেছে একেবারে নাই-নিরুদ্দেশ। কিন্তু ‘আসল সোলেমানী খাবনামা ও অব্যর্থ তাবিজ’-এর কিতাবখানার জন্য টাটানি-যাতনা এখনো মোছে নাই। বরং কেমন যে তাজা রয়ে গেছে! কিতাবখানা হাতে থাকলে কতো কতো নিদানের উদ্ধার– কতো না সহজে করে ফেলা যেতো! ইসস!
ভ্রাতা ও ভগ্নিরা, আপনারা সেই কিতাবের খোঁজ পেলে জানাইয়েন গো!
বিষয় : প্রচ্ছদ
মন্তব্য করুন