ঈদ সামনে রেখে প্রচুর মসলা আসছে দেশে। মসলা উৎপাদন বাড়াতে সরকারের উদ্যোগ রয়েছে। তারপরও প্রায় অর্ধেক মসলা আমদানি করতে হয়। প্রতি বছর এ খাতে দেশ থেকে বিদেশে চলে যাচ্ছে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা। মসলার বাজার নিয়ে লিখেছেন সমকাল চট্টগ্রাম ব্যুরোর রিজিওনাল এডিটর সারোয়ার সুমন

আসছে ঈদুল আজহা। কোরবানির ঈদকে ঘিরে পেঁয়াজ, আদা, রসুন, জিরা, হলুদ, মরিচ, দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, জয়ত্রিসহ মসলাজাতীয় পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। আমদানি প্রক্রিয়ায় এরই মধ্যে যুক্ত হয়েছেন পাঁচ শতাধিক ব্যবসায়ী। তবে দামে প্রভাব রাখেন ৬০ থেকে ৭০ জন। পেঁয়াজ ছাড়া বেশিরভাগ মসলাই আমদানিনির্ভর। আগে পেঁয়াজের জন্যও নির্ভর করতে হতো ভারতের ওপর। এখন  নির্ভরতা কিছুটা কমেছে। এবারে দেশি পেঁয়াজ দিয়েই কোরবানির চাহিদা মেটাতে চায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে দাম নাগালের বাইরে গেলে বাণিজ্যমন্ত্রী আমদানি করার ইঙ্গিতও দিয়ে রেখেছেন। অন্য মসলার উৎপাদন বাড়াতেও কাজ করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এ জন্য করা হচ্ছে গবেষণা। নেওয়া হচ্ছে নতুন প্রকল্প।

জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘পেঁয়াজ নিয়ে অতীতে অনেক ভুগেছি আমরা। তাই দেশেই পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াতে মনোনিবেশ করা হয়েছে। কিন্তু দাম যদি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারি, তাহলে ফের আমদানি করব পেঁয়াজ। অন্যান্য মসলার আমদানিনির্ভরতা কমাতেও কাজ করছে সরকার। মসলা উৎপাদন আরও বাড়াতে নেওয়া হয়েছে নতুন প্রকল্প। দেশে যদি উৎপাদন বাড়ানো যায়, তাহলে আমদানির ওপর আমাদের নির্ভরতা অনেক কমে যাবে।’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডির) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘১৭ কোটি মানুষের দেশে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ব্যাপক থাকবে, এটিই স্বাভাবিক। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিলে এই চাহিদার বড় অংশ পূরণ করতে পারবে বাংলাদেশ। কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত এবং উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণ করা গেলে দেশেই উৎপাদন করে চাহিদা মেটানো সম্ভব। এখন প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আমদানি খাতে চলে যাচ্ছে বিদেশে।’

মসলার বাজার নিয়ন্ত্রণে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে উৎপাদন বাড়ানো গেলে মসলার বাজারে মনোপলি কমে যাবে। আমদানিনির্ভর হওয়ায় এখন বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন গুটিকয়েক ব্যবসায়ী। তাঁদের ইশরাতেই এখন দাম বাড়ে কিংবা কমে।’

মসলার বাজারে থাকা অস্থিরতা তুলে ধরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এক প্রতিবেদন পাঠিয়েছে জেলা প্রশাসন। সেই প্রতিবেদনে কারা কীভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে তা তুলে ধরা হয়েছে। কোন পণ্যের বাজার কেমন, আমদানি মূল্য, ব্যবসায়ীদের বাজারজাত প্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়েছে এতে। জানতে চাইলে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, বগুড়া, খুলনা ও রাজশাহীর ব্যবসায়ীরাই এখন মসলার বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। কিছু কিছু পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন গুটিকয়েক ব্যবসায়ী। কেউ সরবরাহ কমিয়ে, কেউ পণ্য হাতবদল করে দাম বাড়াচ্ছেন। আমরা মাঠের চিত্র তুলে ধরেছি প্রতিবেদনে। আশা করছি প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে মন্ত্রণালয়।’ 

বছরে আমদানি ব্যয় ৯০০ কোটি টাকা

দেশে তিনটি সমুদ্রবন্দর থাকলেও চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় মসলা। তিন শতাধিক আমদানিকারক প্রতি বছর প্রায় ৯০০ কোটি টাকার মসলা আনছেন দেশে। টেকনাফ, বেনাপোলসহ কয়েকটি স্থলবন্দর দিয়েও আসছে মসলাজাতীয় পণ্য। দেশে প্রতি বছর শতকোটি টাকার রসুন আসে। এগুলো আমদানি করে ৭০ থেকে ৮০টি প্রতিষ্ঠান। ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকার এলাচ আসে প্রতি বছর। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পেঁয়াজ আসে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার। তবে আমদানি বহাল থাকলে স্থলবন্দর দিয়ে আসে ২০০ কোটি টাকারও বেশি পেঁয়াজ। দারুচিনি, লবঙ্গ, হলুদ, মরিচ, জয়ত্রিসহ সব ধরনের মসলা মিলে আমদানি ছাড়িয়ে যায় ৯০০ কোটি টাকার ঘর।

দেশে এককভাবে ২০০ টনের ওপরে রসুন আমদানি করেছে ২০টি প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম বন্দরে দীর্ঘদিন ধরে শীর্ষ রসুন আমদানিকারকদের মধ্যে আছেন– মেসার্স মনজু এন্টারপ্রাইজ, ইমতিয়াজ এন্টারপ্রাইজ, ফাহাদ ট্রেডিং, ভাই ভাই ইন্টারন্যাশনাল, ওয়াশিফ ট্রেডিং, নিউ ফাতেমা এন্টারপ্রাইজ, এনএন এন্টারপ্রাইজ, মনির এন্টারপ্রাইজ, ভাই ভাই বাণিজ্যালয়, অপু এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স আল ফায়েদ ট্রেডার্স, আবরার ট্রেডিং, আই আই এন্টারপ্রাইজ, আইএন এন্টারপ্রাইজ, অয়ন এন্টারপ্রাইজ, আশরাফ স্টোর, হাফিজ করপোরেশন, সাবরিন এন্টারপ্রাইজ, এনএস ইন্টারন্যাশনাল ইত্যাদি।

পেঁয়াজ বেশি আসে স্থলবন্দর দিয়ে

আমদানি করা পেঁয়াজের বড় অংশ আসে স্থলবন্দর দিয়ে। মিয়ানমারের পেঁয়াজ টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি হয়ে পাইকারি মোকামে আসে। ভারতের পেঁয়াজ বেনাপোল বন্দর দিয়ে দেশে প্রবেশ করে বেশি। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আসে মূলত অন্য দেশের পেঁয়াজ। বছরে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকা মূল্যের পেঁয়াজ আসে চট্টগ্রাম বন্দরে। এসব পণ্যের বড় আমদানিকারক একে ট্রেডিং, সুরমা টেক্স, মক্কা এন্টারপ্রাইজ, জেনি এন্টারপ্রাইজ ও এনএন এন্টারপ্রাইজ।

আদা আসে ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকার

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এবার আদা তুলনামূলক কম এসেছে। তবে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমারের আদা এসেছে ব্যাপক। চলতি বছর আড়াইশ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ২৫ হাজার টন আদা এসেছে দেশে। সবচেয়ে বেশি আদা আমদানি করা চার প্রতিষ্ঠান হচ্ছে– বগুড়ার মিশু ট্রেডিং, ঢাকার ট্রেইটি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং, বগুড়ার বি কে ট্রেডার্স ও ঢাকার ভাই ভাই বাণিজ্যালয়। এর মধ্যে বগুড়ার মিশু ট্রেডিং ৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে সর্বোচ্চ ৬১৪ টন আদা এনেছে। ঢাকার ট্রেইটি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং ৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ৫৯৪ টন, বি কে ট্রেডার্স ৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ৪৩৯ টন ও ঢাকার ভাই ভাই বাণিজ্যালয় ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা মূল্যে ৩৯২ টন আদা এনেছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০ কোটি টাকার আদা এসেছে।

এলাচের বাজার ৩০০ কোটি টাকা

দেশে চলতি বছর ৪৯টি কনটেইনারে করে এখন পর্যন্ত এলাচ এসেছে প্রায় ১ হাজার ২৪০ টন। এর দাম পড়েছে ১৬৫ কোটি টাকা। প্রতি কেজির দাম পড়েছে ৮০৬ থেকে ৮২৫ টাকা। সবচেয়ে বেশি এলাচ আমদানি করা তিনটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে চট্টগ্রামের। এগুলো হচ্ছে– মেসার্স আবু মোহাম্মদ অ্যান্ড কোম্পানি, মেসার্স সাউদার্ন ট্রেডিং ও মেসার্স এবি দাশ ট্রেডিং কোম্পানি। এই তিন প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে ৬০০, ১১৭ ও ৮০ টন এলাচ আমদানি করেছে। সব মিলিয়ে বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার এলাচ আসে দেশে। 

জিরা, দারুচিনি, হলুদ, মরিচও আসছে

মসলার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে জিরা ও দারুচিনি। হলুদ ও মরিচের বড় অংশ দেশে উৎপাদন হলেও বিদেশ থেকেও আসছে। তবে জয়ত্রি পুরোপুরি আমদানিনির্ভর মসলা। গত বছরের তুলনায় জিরা এবারে কিছুটা কম এসেছে। তবে দারুচিনি গত বছরের তুলনায় এবার বেশি এসেছে। আমদানির পেছনে প্রতি বছর ব্যয় হয় ২০০ কোটি টাকার বেশি।