আমার এক পিতামহী নকশিকাঁথা সেলাই করতেন আর পছন্দের মানুষকে উপহার দিতেন। পুরোনো শাড়ি কাপড় পাটে পাটে বিছিয়ে অনেক সুঁই নিয়ে বসতেন তিনি, আর রাতদিন রঙিন সুতা দিয়ে সুঁই হাঁটাতেন। আমি জিজ্ঞাসা করেছি, এই পোট-পোট করে টাঁক দেওয়ার ধারণা তিনি কোত্থেকে পেলেন। তিনি হেসে বলেছেন, জুনি পোকা। তাঁর সুঁইগুলো ছিল জোনাকি, সুতাগুলো তাদের মিটিমিটি চলার পথ। তাঁর কল্পনার জুনিগুলো উড়ে যেত অন্ধকার ডালিম গাছের নিচে।

মৃত্যুর আগে তিনি শেষ কাঁথাটি সেলাই করেছিলেন অনেকটা একই রকম, শুধু ডালিম গাছের নিচে ছিল এক অতিরিক্ত নকশা, গেরুয়া সুতায় আঁকা কবর।
প্রকৃতি থেকে মানুষ নকশার উপকরণ সংগ্রহ করেন জান্তে-অজান্তেই। মানুষ মূলত সৃজনধর্মী। এ কারণেই তিনি মানুষ। প্রাণীদের সহজাত প্রবৃত্তি আছে, যা মানুষের ভেতরে খুব কম। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো চিন্তা করা এবং সেই চিন্তা অনুসরণ করে সৃজনশীল কাজ করা। মানুষ গুহাচিত্র এঁকেছে ৪০ হাজার বছর আগে। গ্রিক সভ্যতায় মূলত তিন ধরনের পাথরের থাম ব্যবহৃত হয়েছে, যেগুলোর স্থাপতিক নাম ডরিক, আয়োনিক ও কোরিন্থিয়ান। এই থামগুলো পৃথিবীর বহু সভ্যতায়, বহু ইমারতে ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলো চেনার সহজ উপায় হলো– ডরিক থামের গায়ে ঢেউ তোলা বা রিব করা থাকে, আয়োনিক থামের মাথা দেখতে মোড়ানো কাগজ বা ছাগলের শিংয়ের মতো চক্রাকার আর কোরিন্থিয়ান থামের মাথায় থাকে পাতার নকশা। অন্যান্য স্তম্ভসহ এই কোরিন্থিয়ান স্তম্ভ নারায়ণগঞ্জের অদূরে প্রাচীন শহর পানাম নগরীতেও প্রচুর দেখা যায়। নিঃসন্দেহে এই শহরের স্থাপত্যকলা ইউরোপীয় সভ্যতা দ্বারা প্রভাবিত।

বিশ্বব্যাপী যে গাছের শৈল্পিক পাতার আদলে যাবতীয় কোরিন্থিয়ান স্তম্ভের মাথা তৈরি হয় তা মূলত একটি ভূমধ্যসাগরীয় আগাছা, অ্যাকান্থাস স্পিনোসাস। এই গুল্মের খাঁজকাটা পাতা ব্যবহারের পেছনে একটি মিথও জড়িত আছে; যার হদিস পাওয়া যায় রোমান লেখক ভিট্রুভিয়াসের (৭৫-১৫ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ) রচনা থেকে। এই শোভাকর আলঙ্কারিক নকশার আবিষ্কারক ক্যালিমেকাস ছিলেন প্রখ্যাত গ্রিক স্থপতি ও ভাস্কর। এক অজ্ঞাতকুল ছোট মেয়ে মারা যাওয়ার পর হাসপাতালের নার্স তার খেলনাগুলো বাস্কেটে ভর্তি করে কবরের ওপর রেখে আসে। বাস্কেটের বুনটের ভেতর দিয়ে অ্যাকান্থাস গাছ পত্রবিস্তার করে সুশোভিত হয়ে ওঠে। শোকাহত ক্যালিমেকাস এই পাতা দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন এবং এর ব্যবহার শুরু করেন পাথরের স্তম্ভমুণ্ডে। এরপর অ্যাকান্থাস পাতার নকশা বা মোটিফ বিস্তৃত হয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতে। শুধু কাঠ বা পাথরের থামের ওপর নয়, এর ব্যবহার শুরু হয় ঝাড়বাতি, কার্পেট, আয়না, খাটপালং, ট্যাপেস্ট্রি, এমনকি পুস্তকেও।

অ্যাকান্থাস গণ-এর ইউরোপীয় দুটি প্রজাতির পাতা থেকে সাধারণত এসব নকশা আহরণ করা হয়। দ্বিতীয় উদ্ভিদটি অ্যাকান্থাস মলিস, যা ভারতীয় উপমহাদেশে পাওয়া যায়; কিন্তু পাতার খণ্ডগুলো স্পিনোসাস প্রজাতির মতো অতটা গভীর নয়। এই গণের আরেকটি প্রজাতি অ্যাকান্থাস ইলিসিফোলিয়াস ভারত-বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় সুন্দরবন এলাকা, সেন্টমার্টিন দ্বীপ ও টেকনাফের নোনা মাটিতে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে। এই কণ্টকময় প্রজাতি হরগজা নামে অধিক পরিচিত। যেখানে হরগজা গাছের আধিক্য দেখা যায়, অনুমিত হয় সেখানে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল স্বাস্থ্যহীন হয়ে পড়েছে অর্থাৎ এটি পরিবেশের জন্য একটি বায়ো-ইন্ডিকেটর প্লান্ট।

রোমান আমলে যুক্তরাজ্যে ঔষধি গুণের জন্য অ্যাকান্থাস স্পিনোসাসের চাষাবাদ শুরু হয়। প্রাচীন গ্রিক বৈদ্যরা ভাঙা হাড় জোড়া দেওয়া, সন্ধিপ্রদাহ, স্নায়ুরোগ, মূত্ররোগ ইত্যাদিতে এর ব্যবহার করতেন। আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর এর ব্যবহারে পোড়ার কোনো চিহ্ন বর্তমান থাকে না। আমাদের দেশে সরিষা ক্ষেতে দৃষ্ট শিয়ালকাঁটার পাতাও অতি সুন্দর, কণ্টকময়। এই শিয়ালকাঁটা গাছ যদি মেক্সিকোর আদিবাসী না হয়ে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে পাওয়া যেত তবে অনুমান করি, হয়তো এটাই অলঙ্কার হিসেবে ব্যবহৃত হতো কোরিন্থিয়ান থামের চূড়ায়।

বিষয় : নকশার রানী অ্যাকান্থাস

মন্তব্য করুন