
বাংলা বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ (এপ্রিল, মে ও জুন) মাস পুরোটা সময় চলে বোরো ধান কাটা। এখন বোরো ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন বাংলার কৃষকরা। বর্তমানে রিপার ও কম্বাইন্ড হারভেস্টার থাকায় খুব সহজেই ধান কেটে ঘরে তুলছেন হাওরসহ অন্যান্য অঞ্চলের কৃষক। কিন্তু ধান কাটা-পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ কাজ ধান শুকিয়ে তা সংরক্ষণ করা। সে ক্ষেত্রে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় কৃষকদের। ছোট হয়ে আসছে উঠান। যে কারণে অনেক সময় ধান শুকানোর পর্যাপ্ত জায়গাও পাওয়া যায় না। আবার গ্রীষ্মের শুরু থেকেই চলছে তাপপ্রবাহ। প্রচণ্ড রোদ আর গরমে মাঠে ধান শুকানোও কঠিন হয়ে উঠছে। পাশাপাশি হুট করে চলে আসা বৃষ্টি ভিজিয়ে দিতে পারে অপ্রস্তুত কৃষকের কষ্টের ধান। ভালোভাবে শুকানোর অভাবে ধান সংরক্ষণ করতে পারেন না কৃষকরা। ফাঙ্গাস ও পোকার আক্রমণেও নষ্ট হয় ধান। গবেষণায় দেখা গেছে, ফসল কাটা থেকে সংরক্ষণ পর্যন্ত ধান নষ্ট হওয়ার পরিমাণ প্রায় ১৫ শতাংশ। এই অংশটি মোটেও কম নয়। তা কমিয়ে আনা সম্ভব হলে বৃদ্ধি পাবে খাদ্য নিরাপত্তা। এ জন্য প্রয়োজন আধুনিক কৃষিযন্ত্রের।
নতুন কৃষিযন্ত্রের উদ্ভাবনে বরাবরই কাজ করে যাচ্ছেন দেশের গবেষকরা। ধান শুকানো ও সংরক্ষণ পদ্ধতিকে যান্ত্রিকীকরণের আওতায় নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পোস্ট হারভেস্ট লস রিডাকশন ইনোভেশন ল্যাবের (পিএইচএলআইএল) একদল গবেষক ধান শুকানোর জন্য নতুন এক যন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন; যা ফসল ঘরে তোলার সময়ে কৃষকের মুখের হাসি আরও খানিকটা চওড়া করতে সক্ষম। যন্ত্রটির নাম রাখা হয়েছে বিএইউএসটিআর ড্রায়ার। এ বিষয়ে গবেষক দল ২০১৫ সালে কাজ শুরু করে। গবেষণা শেষে ২০১৮ সালের দিকে এটি মাঠ পর্যায়ে নেওয়া হয়। বর্তমানে কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সরকার যে ভর্তুকি দিচ্ছে ড্রায়ারটি সেটির অন্তর্ভুক্ত। এসিআই এবং এগ্রো মেক কোম্পানি দেশে ড্রায়ারটির বাজারজাত করছে।
এ যন্ত্রের মাধ্যমে রোদ বা বৃষ্টি যে কোনো সময়ে, যে কোনো জায়গায়, এমনকি ঘরের বারান্দাতেও ধান শুকানো যায় খুব সহজেই। মাত্র ৩ থেকে ৪ ঘণ্টায় ৫০০ কেজি ধান শুকানো যায়। ধান বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতাও থাকে প্রায় ৯০ শতাংশ। তবে যন্ত্রটির ব্যাপক সম্প্রসারণ হয়নি এখনও। বিদ্যুৎ ছাড়াও ডিজেল, কয়লা, লাকড়ি এবং এলপিজি গ্যাস দিয়ে ব্যবহার করা যায় যন্ত্রটি। দামও হাতের নাগালে। কৃষককে লোকসানের হাত থেকে বাঁচাতে সারাদেশে এ যন্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ চলছে। রংপুর, বগুড়া, কুমিল্লা, সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চলে অন্তত ২৫০টি ড্রায়ার এখন মাঠ পর্যায়ে কৃষকরা ব্যবহার করছেন। এই মানের আমদানি করা রাইস ড্রায়ারের দাম পড়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। ভারত ও চীন থেকে তা আমদানি করা হয়। দাম বেশি বলে এর ব্যবহার খুব কম। অপরদিকে, দেশে উদ্ভাবিত রাইস ড্রায়ারটির দাম পড়বে এক লাখ ২০ হাজার টাকা। এ ছাড়া বাণিজ্যিক পরিসরে ধান শুকানোর জন্য যেসব যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, তার দাম এক থেকে দেড় কোটি টাকা।
এ ছাড়াও গবেষক দল কোকুন (রেশম পোকা থেকে রেশম তন্তুসমৃদ্ধ এক ধরনের গুটি তৈরি হয়, যাকে কোকুন বলে) সমৃদ্ধ পাঁচ স্তরবিশিষ্ট হারমেটিক ব্যাগ পরীক্ষা করে দেখেছেন– এটি বীজ ও ধান সংরক্ষণে দেশের কৃষকদের উপকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমেরিকার গ্রেইন প্রো কোম্পানি প্রথম হারমেটিক কোকুন ব্যাগ তৈরি করে এবং ফিলিপাইনে এখন এটি প্রস্তুত করা হয়। বায়ুরোধী এ ব্যাগে অক্সিজেন প্রবেশ করতে পারে না। ফলে অভ্যন্তরীণ পোকামাকড় মারা যায়। বর্তমানে বীজ সংরক্ষণে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন ব্যাগটি ব্যবহার করছে। সনাতন পদ্ধতিতে সংরক্ষণে ধান অপচয় হয় প্রায় ৬ শতাংশ। হারমেটিক ব্যাগ ব্যবহারে তা অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব।
কম খরচে এবং সহজে ধান শুকানো যায় বলে ড্রায়ারটির চাহিদা কৃষক পর্যায়ে দিন দিন বাড়ছে– এমনটিই জানিয়েছেন পিএইচএলআইএলের প্রধান গবেষক ও বাকৃবির কৃষিশক্তি ও যন্ত্র বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মঞ্জুরুল আলম। তিনিই এ যন্ত্রের উদ্ভাবনে গবেষণা দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ড. মো. মঞ্জুরুল আলম আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের কৃষি এখন আধুনিক, যান্ত্রিক এবং বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। নিজ উৎপাদনশীলতা এবং বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে যান্ত্রিকীকরণ অপরিহার্য। ধান গাছ লাগানো, কাটা, মাড়াই-ঝাড়াই এসব কাজে যন্ত্রের ব্যবহার কায়িক শ্রম ও সময় বাঁচায় প্রায় ২০ শতাংশ। বীজ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ কমায় প্রায় ১৫ শতাংশ। আমরা মূলত পিছিয়ে আছি শস্য রোপণ, কাটা, শুকানো এবং পরবর্তী সময়ে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে। সরকার কৃষির যান্ত্রিকীকরণে এখন ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রণোদনা দিচ্ছে। এর আওতায় ধান লাগানোর জন্য ট্রান্সপ্লান্টার এবং কাটার জন্য রিপার ও কম্বাইন্ড হারভেস্টার ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে ধান গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে বর্তমানে ৩ থেকে ৪ শতাংশ, কাটার ক্ষেত্রে প্রায় ১০ শতাংশ, শুকানোর ক্ষেত্রে ২ থেকে ৩ শতাংশ এবং সংরক্ষণের ক্ষেত্রে মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ যন্ত্রায়ন হয়েছে। সরকারের উন্নয়ন প্রণোদনা এসব ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা গবেষণায় দেখেছি, শুধু ধান কাটা, মাড়াই-ঝাড়াই এবং শুকানোতে প্রায় ১৫ শতাংশ ধান অপচয় হয়। এ ক্ষেত্রে হারভেস্টার, ধান শুকানোর জন্য আমাদের উদ্ভাবিত বিএইউএসটিআর ড্রায়ার, সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন হারমেটিক ব্যাগ ব্যবহারে অপচয় কমিয়ে ২ থেকে ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব। এভাবে আমরা শুধু ধানের ক্ষেত্রেই অন্তত ৭০ লাখ টন ধান রক্ষা করতে পারি। আগামীতে আমাদের বাড়তি জনসংখ্যার প্রায় ৪৯ শতাংশের খাবার আমরা এই অপচয় রোধ করেই জোগাড় করতে পারি। কাজেই যেসব ক্ষেত্রে যন্ত্রায়ন কম হয়েছে, সেদিকে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে আমরা দেশের খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারব।’
গবেষণা দলের আরেক সদস্য অধ্যাপক ড. চয়ন কুমার সাহা বলেন, ‘কম সময়, কম খরচ ও কম কায়িক শ্রমে ধান শুকানোর জন্য আমরা এই ড্রায়ারের উদ্ভাবন করেছি। পাশাপাশি ড্রায়ারে শুকালে সনাতন পদ্ধতির তুলনায় অপচয় বাঁচে প্রায় ২ থেকে ৩ শতাংশ। এলপিজি গ্যাসচালিত আমাদের ড্রায়ারে ধানের মধ্যে গরম বাতাস প্রবাহিত এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য সেন্সর ব্যবহার করা হয়। বীজ ধানের জন্য এই তাপমাত্রা সবসময় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে এবং খাবার ধানের জন্য ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখা হয়। এ ছাড়াও ফল ও সবজির ক্ষেত্রে কর্তন-পরবর্তী অপচয় হয় প্রায় ২০ থেকে ৫০ শতাংশ। এই অপচয় কমাতেও আমরা হাইব্রিড ড্রায়ার নিয়ে কাজ করছি। ড্রায়ারের ব্যবহারে কৃষক মৌসুমি ফসলগুলো শুকিয়ে পরবর্তী সময়ে সরবরাহ করতে পারবেন। এতে তাঁরা আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবেন। পাশাপাশি পুষ্টি সরবরাহও বজায় থাকবে সারা বছর।’
বিষয় : ধান শুকানো ধান রক্ষা নতুন যন্ত্র
মন্তব্য করুন