কাইজার চৌধুরী। খ্যাতিমান ব্যাংকার ও লেখক। ২০১৩ সালে শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে ১৯৭৫ সালে গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে শুরু করেন ব্যাংকিং জীবন। এরপর একে একে এবি ব্যাংকসহ দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে অবসরে যান। খ্যাতিমান এই ব্যাংকারের সঙ্গে কথা বলে অনুপ্রেরণামূলক কথা তুলে এনেছেন আশিক মুস্তাফা।

পুরান ঢাকার মাহুৎটুলির নানাবাড়িতে বেড়ে ওঠা আমার পৈতৃক নিবাস মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়ায়। কিঞ্চিৎ অপ্রাসঙ্গিক হলেও অনেকটা ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়ার মতো বলতে হয়, আমার ছেলেবেলা নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের মধ্যে কেটেছে। যে বয়সে ‘মেঘ’, ‘ফড়িং’, ‘সমুদ্র’, ‘পাহাড়’– এসব শব্দের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার কথা, সে বয়সে শুনতে এবং পড়তে হয়েছে ‘হরতাল’, ‘হুলিয়া’, ‘গ্রেপ্তার’, ‘গুলি’র মতো যতসব মন খারাপ করা শব্দ। তারপর বয়স বেড়েছে। বাঙালি হয়ে উঠেছি যখন সবেমাত্র, অমনি বঙ্গবন্ধুকে চলে যেতে হলো। তবে এটাও স্বীকার করতে হয় যে আমাদের সময় মাঠ পেয়েছি, লাইব্রেরি পেয়েছি। আর পেয়েছি ‘কচিকাঁচা’ ও ‘খেলাঘর’-এর মতো সংগঠন। এসব সংগঠনের সঙ্গে যারা সম্পর্ক রেখেছিল, সেই কিশোর সাবালক হয়ে কখনও বাঁকা পথে হাঁটতে চায়নি।

বিনয় এবং সত্যবাদিতা দেশ সমাজ সমকালীন কিশোরভাবনার পটভূমিতে কিশোর মনোরঞ্জনের জন্য বড়দের বড্ড তোড়জোড় সেকালে যেমনটি ছিল, আজও ঠিক তেমনটিই আছে কিছু হেরফের বাদে এবং সেটা স্বাভাবিক নিয়মে যুগের দাবি মেনে, আধুনিকতার দাবি মেনে। আধুনিক ব্যাপারটা যদিও আপেক্ষিক। গেল শতাব্দীর ৪০-৫০ দশকের আধুনিক আর হাল আমলের আধুনিকতার মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে! সে যাক, আসলে আমি চাই, আমি যেমন কিশোরবেলায় আমার প্রিয় লেখকদের গল্প পড়ে পড়ে আনন্দে দিন কাটিয়েছি, রাত কাটিয়েছি; ভালো চিন্তা, ভালো ভাবনা, ভালো কল্পনা করতে শিখেছি এবং বর্তমানে সবাই আমাকে ভালো মানুষ হিসেবে গণ্য করছে কোনো ধরনের লোক ঠকানো ও ধূর্তামোর ধারেকাছে আমি নেই বলে। ঠিক তেমনি শিশু-কিশোর কিংবা তরুণরা সাহিত্য ও সৃজনশীলতায় বেড়ে উঠলে নিজে যেমন বিনয়ী, সত্যবাদী ও ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে, তেমনি ভবিষ্যতের ভালো মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবেও কাজ করবে।

যুদ্ধদিনের কথা এবং দেশাত্মবোধ যুদ্ধও আপনাকে দিতে পারে সঠিক পথের দিশা। বলছি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা। মনে পড়ে, বড্ড বিষাদময় ছিল দিনগুলো। তিক্ততায় ভরা। নিষ্ঠুরতায় ভরা। বড় কান্নাভেজা ছিল দিনগুলো। ছাব্বিশে মার্চ ভোরবেলায় রাস্তাঘেঁষা বাড়িটার দোতলার বারান্দার রেলিং ধরে দেখেছি, রাস্তা দিয়ে খানসেনারা খোলা পিকআপে করে বাঙালিদের রক্তে ভেজা নিথর দেহগুলো নিয়ে যাচ্ছিল কোথায় যেন। গা গুলিয়ে গেল, মাথা ঘুরে গেল, পেটেও কেমন গুড়গুড় ভাব; দু’দিন মুখে কোনো দানাপানি দিতে পারিনি। মে মাসের ৯ তারিখে ভোরবেলায় বৃদ্ধ পিতামহকে গাঁয়ের বাড়িতে পারিবারিক মসজিদের প্রবেশদ্বারে হাতে তসবিহ নিয়ে খানসেনাদের গুলি খেয়ে পরলোকে পাড়ি দিতে হয়েছে। বাড়ির ছাদ থেকে দেখেছি, দূরে শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, নয়াবাজারকে আগুনে ঝলসানো হচ্ছে দিনের পর দিন। দিনে কি রাতে হাওয়ার দমকে খাবার ঘরের ঘুলঘুলি দিয়ে ঢুকে পড়ে নয়াবাজারে পোড়ানো ছাই। সে ছাই পড়ে গিয়ে আমাদের থালার বাড়া ভাতে। আসলে যুদ্ধ আমাকে দেশাত্মবোধ শিখিয়েছে, তরুণদের মধ্যে যা না থাকলেই নয়। দেশাত্মবাধ ছাড়া কখনও ভালো মানুষ হওয়া যায় না। আর ভালো মানুষ ছাড়া কেইবা হতে পারে সফল?

তরুণদের বলি… আমি তৃতীয় শ্রেণির প্রথম পরীক্ষায় শূন্য পেয়েছিলাম। এর পরের পরীক্ষায় ৩ ও ফাইনালে টেনেটুনে ৩৫ পেয়ে পাস। এরপর নড়েচড়ে বসি। স্কুলের ফার্স্ট বয় হিসেবে রেকর্ড নম্বর নিয়ে পাস করে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে নটর ডেম কলেজে সায়েন্স নিয়ে পড়ি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে পেশাগত জীবনে প্রবেশ করি। আসলে যখন যা মন চেয়েছে তা-ই করেছি। তবে নিজের কাজে সৎ থেকেছি সব সময়। মানে, যেটা করেছি মন দিয়েই করেছি। তাই বলব, নিজের কাজে বিশ্বাস রেখে পথ চলো। যেটাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করো, সেটাই করো। আর ব্যাংকার হলে আরেকজন সৎ ব্যাংকার তৈরি করে যাবে। কেননা, তোমার অবর্তমানে সে-ই পূরণ করবে তোমার শূন্যস্থান! এতেই পাবে সফলতা। আর সফল হলেই বুঝতে পারবে সফলতার মানে।