- ফিচার
- নৈসর্গিক নিদ্রা
নৈসর্গিক নিদ্রা

বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার সোনাকাটা ইউনিয়নে অবস্থিত সৈকতের নাম নিদ্রা। যার পরতে পরতে যেন সোনাঝরা রোদ খেলা করে। সাগর, নদী, কেওড়া ও ঝাউবনে ঘেরা দৃষ্টিনন্দন জায়গা এটি। বরগুনায় নিদ্রা ছাড়াও আছে সন্ধ্যা সমুদ্রসৈকতসহ আরও দর্শনীয় স্থান।
বরিশালগামী জাহাজে উঠলাম রাত ৮টায়। ঈদের পরদিন হওয়ায় যাত্রীর ভিড়। কেবিন তো দূরে থাক, ডেকে বসার মতোও জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে দ্বিগুণ ভাড়ায় স্টাফ কেবিনে আশ্রয় নিলাম। হুইসেল ছেড়ে রাত ৯টায় ছাড়ল জাহাজ। সঙ্গী রফিক, সৌরভ ও বশির। ভ্রমণকালীন স্বভাবসুলভ অভ্যাস অনুযায়ী জাহাজের ওপর, নিচ, ছাদ– সব জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করলাম মানুষের জীবনমান। এই দেখার মাঝেও ভ্রমণের অন্যতম অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়ে থাকল। ভ্রমণ শুধু বিনোদন নয়। জ্ঞান প্রসারেরও মাধ্যম। ঘণ্টা দুই পর কেবিনে চলে এলাম। ভোর প্রায় ৫টায় জাহাজ ভিড়ল বরিশাল ঘাটে। এর পর বিভিন্ন ধরনের যানবাহন বদলি করতে করতে তালতলী গেলাম।
দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের বন্ধুদের জন্য আগেই অপেক্ষমাণ ছিলেন বরগুনার গণমাধ্যমকর্মী ও পর্যটনবান্ধব টগবগে যুবক আরিফুর রহমান। প্রথমেই তিনি নিয়ে গেলেন ছাতনপাড়া রাখাইনপল্লিতে। খুবই সুন্দর পরিপাটি বাড়িঘর। পাড়াতে রয়েছে ধর্মীয় উপাসনালয়। এর নাম জেয়ারামা শ্রীমঙ্গল শনি প্যাগোডা। পুরো উপাসনালয়টি চকচকে সোনা রঙে আচ্ছাদিত। কিছুক্ষণ চলল ফটোসেশন। এর পর মোটরবাইকে করে ছুটলাম নিদ্রা সমুদ্রসৈকতে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। দেখেই চোখ ছানাবড়া। এত সুন্দর সমুদ্রসৈকত নিদ্রা! অথচ এই দেশের মানুষ আমরা চোখ মেলেই নিদ্রায় [ঘুমে] আছি। অসম্ভব সুন্দর সৈকতে নগ্ন পায়ে হেঁটে বেড়ালাম। দূর্বা ঘাসগুলো যেন সবুজ কার্পেটের মতো বিছিয়ে রয়েছে। সৈকতের পাড়টা প্রাকৃতিকভাবেই খাঁজ কাটা। ছবিতে কেউ দেখলে প্রথমেই ভেবে নেবেন, জায়গাটা সীতাকুণ্ডের গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকত। তবে গুলিয়াখালীর চেয়েও অনেক বেশি নয়নাভিরাম। কেওড়া, ঝাউবন ও ছৈলাগাছের সারি বাড়তি সৌন্দর্যের পসরা মেলেছে। পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর– এই তিন নদীর মোহনায় নিদ্রা সমুদ্রসৈকত। নিদ্রার চারপাশে ছোট ছোট গর্ত রয়েছে। তারই মাঝে জোয়ার-ভাটার পানি খেলা করে। এই দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। নদী অববাহিকার নোনাপানিতে সৃষ্টি হয়েছে প্রায় দুই কিলোমিটার লম্বা বেলাভূমি। সবুজ ঘাস, চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সাগরের মুক্ত বাতাস আপনার মন কাড়বে।
প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের মুগ্ধতার রেশ গিয়ে পড়ল ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের মাঝে নিজেদের সমর্পণের মাধ্যমে। একচোট হলো জলকেলি। এর পর উঠেই ছুটলাম ফকিরেরহাট। যেতে যেতে আবহমান বাংলার রূপ দেখি। হাত বাড়ালেই গাছে গাছে ঝুলে থাকা টসটসে পাকা খেজুর। তাল বৃক্ষের সমারোহ। সোঁদা মাটির গন্ধ। সারি সারি জেলে নৌকার বহর। এক কথায়, অসাধারণ এক গ্রামীণ পরিবেশ। শহুরে মানুষের জন্য অনন্য। ফকিরেরহাট বাজারে দুপুরের আহার সেরে ছুটলাম। এবার শুভসন্ধ্যা সৈকতের পথে।
ডিসি পয়েন্ট পৌঁছে ছোট্ট একটা খাল পার হয়ে শুভসন্ধ্যা সৈকতে গিয়ে উঠলাম। ওয়াও! ঝাউগাছ আর ঝাউগাছ। বালুকাময় সৈকত। এক পাশে বিশাল জলরাশি, আরেক পাশে সতেজ সবুজ ঝাউবন। বিশেষ করে কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন সৈকতে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সাগরলতা এখানে প্রচুর। এ রকম মনোরম দৃশ্য দেহ-মনে বেশ প্রশান্তি এনে দেয়। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের চেয়েও অনেক বেশি প্রাপ্তির আনন্দে আমরা দক্ষিণের দিকে আরও এগোতে থাকলাম। হাঁটতে হাঁটতে ঝাউবন ছাড়িয়ে অদ্ভুত আকৃতির গাছপালা ঘেরা এক জঙ্গলের দেখা পেলাম। বিস্ময়ে চোখ চকচকে। সৈকত ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়লাম। যতই এগিয়ে গেলাম, ততই যেন একটা ভৌতিক পরিবেশ ঘিরে ধরল। সত্যিই রোমাঞ্চকর অনুভূতি। স্থানীয়দের সূত্রে জানা যায়, এই জঙ্গলটার কেতাবি কোনো নাম নেই। এখানে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে বন্য গাছ। এর মধ্যে রয়েছে– শৈলা, কেওড়া, জিলাপি, বাইন, সুন্দরী ও শিশুগাছ। গাছগুলোর ডালপালা এতটাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে যে, দিনের আলো সেখানে প্রায় মলিন। শুভসন্ধ্যা সৈকত প্রায় চার কিলোমিটার দীর্ঘ। এর মধ্যে প্রায় দুই কিলোমিটার হেঁটে নিদ্রার পথ ধরি। সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় দেখার পর রাতে সেখানেই তাঁবু গাড়ব। নিদ্রা সৈকতে পৌঁছেই মনোমুগ্ধকর এক সূর্যাস্তের সাক্ষী হলাম। মাছ ধরার ট্রলারে চেপে সেন্টমার্টিন থেকে টেকনাফ ফেরার সময় সূর্য ডোবার যে রকম দৃশ্য চেখে পড়ে, ঠিক ওরকমটাই নান্দনিক লাগবে নিদ্রা সৈকত থেকে।
আলো থাকতে থাকতেই এবার তাঁবু টানাতে সবাই ব্যস্ত। আমি ব্যস্ত বারবিকিউ করার জন্য দেশি মোরগের খোঁজে। বাঁকা চাঁদ উঁকি দিতেই ক্যাম্পফায়ারের সঙ্গে স্থানীয় ভোকাল সগিরের গানের তালে তালে আমাদের নৃত্য। মুহূর্তগুলো দারুণ ছিল। সেখানে আমরা বারবিকিউর আয়োজন করলাম। লেলিহান আগুনে ক্ষণিকের মধ্যেই ঝলসানো মোরগ সবার পেটে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উল্লাস থেমে যায়। তাঁবুর ভেতর থেকে আসমানে থাকা লাখোকোটি তারার মেলা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙল একেবারে পাখিডাকা ভোরে। সমুদ্র পাড়ে ভোরের আলো উপভোগ করে ছুট দিলাম হরিণঘাটার পথে। নিদ্রা বাজার থেকে ট্রলারে চেপে বসলাম। এর পর প্রায় দুই ঘণ্টা ভাসতে ভাসতে গিয়ে পৌঁছলাম পাথরঘাটায়। এই দুই ঘণ্টার পানিপথের ভালো লাগাও ভ্রমণের ঝুলিতে থাকবে অম্লান। আমাদের আসার সংবাদ পেয়ে আগেই নদীর ঘাটে অপেক্ষায় ছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু জাফর। আমাকে দেখে ও যারপরনাই বেশ আনন্দিত। আমিও আপ্লুত। দেরি না করে অটোতে উঠে পড়লাম। যেতে যেতে হরিণঘাটা ইকোপার্কের গেটে পৌঁছলাম। প্রবেশ ফি পরিশোধের মাধ্যমে ঢুকে পড়লাম। সুন্দরী, কেওড়া, পশুর ও গেওয়া গাছের প্রাকৃতিক বন। এটি সুন্দরবনেরই একটি অংশ। পর্যটকদের জন্য রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার ও দৃষ্টিনন্দন ফুট ব্রিজ। এই বনে তেমন হিংস্র প্রাণী নেই। তবে প্রচুর হরিণ ও প্রায় ৫০ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির বন্য প্রাণীর বিচরণ রয়েছে। সুন্দরবনের মতোই প্রচুর গোলগাছ ও শ্বাসমূল উদ্ভিদসমৃদ্ধ এই বন। বনের ভেতরেই সমুদ্রসৈকত লালদিয়া যাওয়ার জন্য বোটে চড়ে বসলাম। খাল দিয়ে যখন বোট ছুটল তখন মনে হলো, আমরা যেন হরিণঘাটা নয়, মূল সুন্দরবনের কোনো খালের ভেতর দিয়েই যাচ্ছি। চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর বোট থেকে নেমে আবিষ্কার করলাম অন্যরকম এক জগৎ। হ্যাঁ, এই জগতের সৌন্দর্য শুধু ভ্রমণপিপাসুরাই উপলব্ধি করতে জানেন। দেরি না করে দ্রুত নেমে গেলাম আছড়ে পড়া ঢেউয়ের সঙ্গে মিতালি গড়তে।
যাবেন কীভাবে
ঢাকা-কুয়াকাটার বাসে চড়ে আমতলী যেতে হবে। সেখান থেকে অটো অথবা মোটরবাইকে যেতে হবে তালতলীর নিদ্রা সৈকতে। নদী দেখতে দেখতে যেতে চাইলে ঢাকার সদরঘাট থেকে জাহাজে চড়ে বরিশাল/পটুয়াখালী/তালতলী পর্যন্ত যাওয়া যাবে।
থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা
নিদ্রা সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে গেলে হাতের কাছে হোটেল পাবেন না। বরগুনায় ভ্রমণে গেলে স্থানীয় কারও কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তাঁবু গেড়ে থাকা যাবে। আশপাশে থাকা জেলে পরিবারদের সঙ্গে আলাপ করে খাওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে।
মন্তব্য করুন