- ফিচার
- মেলোড্রামা, মানসযাত্রা; ট্র্যাজেডির দিকে?
মেলোড্রামা, মানসযাত্রা; ট্র্যাজেডির দিকে?

দৃশ্য : ‘নাজুক মানুষের সংলাপ’
যখন কেউ পৌরাণিক পট রচনা করেন সেখানে প্রতীক আর অনুভূতিই চরিত্র। কখনও সেখানে বাহ্যিক ঘটনা ঘনঘটা থাকে, কখনও থাকে বোঝাপড়ার অভিযান। কোথাও ছেলে পিতাকে খুঁজতে বের হয়। কোথাও ‘আমি কে’ এ প্রশ্ন নিয়ে তরুণ ঘর ছাড়ে। শাহাদুজ্জামানের লেখা ‘নাজুক মানুষের সংলাপ’ এই দ্বিতীয় ঘরানার পৌরাণিক অভিযাত্রার নাটক।
এক প্রশ্নবান তরুণ প্রশ্ন নিয়ে বেরিয়েছে– সে কে, কোথায় বলেছে, কী চায়, কেন চায় তার অজানা। তার অজ্ঞ দশা তাকে ভাবনাজগতের ওপরতলে রেখেছে। অপরদিকে এক প্রাজ্ঞ সেই তরুণের অজানাকে জানাবেন। তিনি অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে ঋদ্ধ হয়েছেন, বহু অবোধ্যকে আয়ত্ত করে বোঝাপড়ার ভারে ভারী হয়ে অবস্থান করেছেন মাটির কাছে। হাওয়াভাসা তরুণকে তিনি প্রশ্নোত্তরের শুরুতেই মাটিতে নামিয়ে আনলেন। এই বোধে পৌঁছে দিতে নির্দেশক সাইফ সুমন মহিলা সমিতির দ্বিতল মঞ্চকে যেভাবে কাজে লাগিয়েছেন, প্রশংসনীয়। শাহাদুজ্জামান একটি ঝুঁকি নিয়েছেন। চরিত্র দুটির অভিযানটা দৈহিক না রেখে রেখেছেন মানসিক।
একটি ভারসাম্য থাকতে পারত, রেপার্টরি থিয়েটারের বাণিজ্যিক অবস্থানের কারণে যা প্রত্যাশা করাই যায়; কিন্তু তিনি হয়তো ইচ্ছাকৃত ভারসাম্যটা রাখেননি। দর্শকের প্রতি এটি চ্যালেঞ্জ এবং বিপুল দর্শকসমাগম বলে দেয়, চ্যালেঞ্জটা নিতেই বরং উৎসুক তাঁরা। সাইফ সুমন নির্দেশনায় অজস্র প্রতীকের চারু ব্যবহার করেছেন। চতুর্ভুজ, বৃত্ত– কখনও ঘূর্ণায়মান কখনও স্থির, ত্রিমাত্রিক/ত্রিদর্শী আয়না; যখন সবচেয়ে সজোর ও সরোষে তার প্রশ্ন করার ক্ষমতা তৈরি হলো আর প্রাজ্ঞ উত্তরের প্রাকৃত সুধা ঢালতে থাকলেন প্রতিটি প্রশ্নের পানপাত্রে, দ্রুত, আনন্দিত, তাদের পায়ের নিচের বৃত্তটা তখন ঘুরতে শুরু করেছে। দৃশ্যত নাটকের সেরা দুটো মুহূর্তের এটি একটি।
স্থান-কালের নিরপেক্ষ বিন্দুতে দাঁড়িয়ে মানুষ নিজের তিনকালকে দেখতে পায়। প্রাজ্ঞ বৃদ্ধের ভূমিকায় ইউসুফ হাসান অর্বাচীন তরুণকে ত্রিকাল দেখালেন (তিন তলের আয়নায় তিন মুখো হয়ে বিভ্রান্ত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকার অপূর্ব এ দৃশ্যটিকে আামি সেভাবেই নিয়েছি), এর আগে নিজেকে চিনিয়েছেন। নিজেকে জানার পৌরাণিক প্রশ্ন– আমি কে, আমি কীভাবে, আমি কেন; উত্তর কিন্তু প্রত্যেকের সত্তার গভীরে প্রোথিত। মনে হয়েছে, নাটকের সংলাপে মানুষের ভেতর প্রোথিত উত্তরগুলোকে জলের নিচে ডুবন্ত কলসের রূপকে দেখানো হলো।
প্রকৃতি থামতে জানে। একটা ঝড় নামে, কিন্তু মানুষ জানে না কখন থামতে হয়। এই সংলাপ সময়কেন্দ্রিক একটা ভাষ্য জাগায়। জগতে দুই ধরনের সময় বিদ্যমান। ক্রনোস ও কাইরোস। ক্রনোস আমাদের চেনা সময়। আর কাইরোস হচ্ছে সেই সময় যখন থামতে হয়। মানুষের সবচেয়ে বড় সাধনা কাইরোস নিয়ন্ত্রণের সাধনা। প্রাজ্ঞ যখন তরুণকে পরামর্শ দেন, তুমি ততটুকুই কোরো যতটুকু তোমার সাধ্য, তরুণ পরামর্শ মনে চলে গিয়ে আবার ফিরে আসে। শক্তির বিপরীতে এ নির্দেশনা তার জন্যে যথার্থ মনে হয় না। সে বলে, আমাকে আরও কঠিন কোনো নির্দেশনা দিন। প্রাজ্ঞ ভেবে বলেন, তাহলে তুমি ততোটুকু কোরো, যতটা তোমার সাধ্যে নেই। গানে-পার্বণে আবেগে-সংলাপে উচ্চকিত মেলোড্রামাটিক মঞ্চায়নটি কেবল এক তরুণের উত্তর পাওয়ার গল্প নয়। এক প্রাজ্ঞেরও নিজেকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাওয়ার গল্প।
প্রকৃতির সন্তান হয়ে, তার নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠার এই শেষ মূলমন্ত্রটা– তুমি তোমার সাধ্যের বেশি কোরো– যখন উচ্চারিত হলো, কথাটিকে কাইরোসের ধারণাকে পরের ধাপে ঠেলে দেওয়ার নির্দেশ পেলাম। এ যে ট্র্যাজেডি তৈরির নির্দেশ! এ যে নিজের জীবনকে অপরের জন্যে শ্রেষ্ঠ গল্প করে তোলার নির্দেশ! যেন বলা হচ্ছে, তুমি তোমার জীবনকে অপরের জন্যে গল্প হিসেবে তৈরি কোরো!
অবেশেষে সত্য মিথ্যা কখন পরস্পরের প্রতিযোগী, কখন সহযোগী, তা বোঝার শর্তগুলো জানল তরুণ। শিখল, কোথায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করতে নেই, কোথায় পথচলতি উত্তর পেতে নেই, কোথায় আছে। নিজেকে জেনে অগ্রসর হওয়ার দিকনির্দেশ নিয়ে সে আবারও যাত্রা শুরু করল, কঠিনের পথে। কঠিনের পথে নাজুকই হাঁটতে পারে। কমনীয় নারীই জন্ম দিতে পারে মানুষের।
মন্তব্য করুন