- ফিচার
- এ সময় কাফকার
এ সময় কাফকার

কিশোর কাফকা
ব্যাপারটাকে কাকতালীয় বলা যায় মনে হয়– একটি অনিবার্য কারণে সহকর্মীদের মধ্যে কোর্স পাল্টাপাল্টি হলো এই সেদিনই। ‘কন্টিনেন্টাল লিট্রেচার’ নামের যে কোর্সে আমার ‘দ্য মেটামরফোসিস’ পড়াবার কথা, সেটি বদলে নিলাম ‘ল্যাটিন আমেরিকান লিট্রেচার’ আর এই শনিবারে পেলাম কাফকাকে নিয়ে লেখার আমন্ত্রণ। যে কয়বার ক্লাসে দ্য মেটামরফোসিস পড়িয়েছি, প্রতিবারই ভীষণ উত্তেজনা বোধ করেছি ভেতরে ভেতরে। যদিও শিক্ষক হিসেবে পাঠ্যবিষয় নিয়ে নিস্পৃহ এবং নিরপেক্ষ থাকাটা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিছু টেক্সট সম্পর্কে তেমন নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব হয় না। দ্য মেটামরফোসিস তেমনি একটি নভেলা। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করা এই লেখকের জীবন সম্পর্কে অনেক তথ্য এবং অনুমান, যা সাহিত্যপ্রেমী মাত্রেই জানেন, গৌরচন্দ্রিকা হিসেবে বলে নিই ক্লাসে। অবধারিতভাবেই ‘ডিকেন্সিয়ান’ টার্মটি ব্যাখ্যা করা যেমন সহজ, ‘কাফকাস্ক’ শীর্ষক প্রকরণ বোঝানো ততটা সহজ হয় না। যা কিছু অদ্ভুতুড়ে, অস্বাভাবিক, অন্ধকারে ঢাকা, যা কিছু শিহরিত করে, ভয় ঢোকায়, যা কিছু অস্তিত্বের আমূলে নাড়া দেয় তার সবকিছুকেই এককথায় ‘কাফক্যাস্ক’ বা কাফকীয় বলে ফেললে তা হয়তো অতি সরলীকরণ হয়ে যাবে। কাফকার মতন আর কোনো কিছুই নেই, বড়জোর সামান্য মিল থাকতে পারে কাফকার লেখার সঙ্গে, দুই-একটি বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে; যা থেকে বোঝা যায় কাফকার প্রভাব কত গভীর।
প্রায় ৯০% কাজ পুড়িয়ে ফেলেছিলেন বিশ্বসাহিত্যের এই বিরল প্রতিভা ফ্রানৎস কাফকা। যে ১০% বেঁচে গিয়েছিল তাঁর জন্য বিশ্ববাসী কাফকার নির্দেশ অগ্রাহ্য করা বন্ধু ম্যাক্স ব্রডের কাছে চিরকৃতজ্ঞ নিশ্চয়ই। পরবর্তী সাহিত্যিকদের অনেকেই কাফকাকে দিয়ে অনুপ্রাণিত। আমার ধারণা, যতটা না তাঁর কাজ দিয়ে, তারচেয়ে বেশি ব্যক্তি কাফকাকে দিয়ে প্রভাবিত হয়েছেন অনেকেই। বিখ্যাত আখ্যান রচয়িতা হারুকি মুরাকামির একটি উপন্যাসের নাম ‘কাফকা অন্য দ্য শোর’। মাকে খুঁজতে যাওয়া কিশোর নিজের জন্য ছদ্মনাম বেছে নেন এই মহান লেখকের পারিবারিক নামটিকে। আরেক বিখ্যাত চেক সাহিত্যিক মিলান কুন্ডেরার ‘দি আনবেয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং’ উপন্যাসের মূল নারী চরিত্র তেরেজার পালিত কুকুরের নাম ছিল কাফকা। নেটফ্লিক্সের জনপ্রিয় সিরিজ ‘ব্রেকিং ব্যাড’ আমি দেখিনি, শুধু শুনেছি এর নবম পর্বের নাম নাকি ‘কাফক্যাস্ক’।
মাস্টার্সে তুলনামূলক সাহিত্যে আমাদের পাঠ্য ছিল ‘চাঁদের অমাবস্যা’– সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর তিনটি উপন্যাসের একটি। লালসালু প্রায় সবাই স্কুলে থাকতেই পড়েছে, চাঁদের অমাবস্যা সেই তুলনায় কম পঠিত (কাঁদো নদী কাঁদো হয়তো আরও কম), কোনো পরিসংখ্যান ছাড়াই অনুমানে বলছি। চাঁদের অমাবস্যাকে মনস্তাত্ত্বিক কোনো বিশ্লেষণে না ফেলেও, শুধু পাঠ অভিজ্ঞতা দিয়েই কাফক্যাস্ক বললে সম্ভবত ভুল হবে না। পরিবেশ প্রতিবেশের যে ভয়াবহ বর্ণনা পাঠককে এক পীড়াদায়ক যাত্রার মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়, ব্যাখ্যাতীত মানসিক চাপ, যা পাঠক মূল চরিত্রের পক্ষ থেকে অনুভব করতে বাধ্য হন, সেটি এক কথায় বিরল অভিজ্ঞতা।
বাংলা সাহিত্যে আর কি এমন কোনো সাহিত্যকর্ম আছে; যা কাফকাকে দিয়ে বা তার কাজ দিয়ে প্রভাবিত? সরাসরি অনুপ্রাণিত না হলেও অন্তত পাশাপাশি রেখে তুলনা করা যায়। কাফকার সমকক্ষ হয়েছে কিনা, সেই তর্কে না গিয়ে শুধু কাফক্যাস্ক বা কাফকীয় বৈশিষ্ট্য আছে, এমন সাহিত্য কোনো কিছু পড়েছি কিনা বাংলায় তা ভাবতে গিয়ে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকলাম। মনে পড়ল হুমায়ূন আহমেদের ‘চোখ’ শিরোনামের গল্পের কথা। যে গল্পে প্রচলিত আইনে শাস্তি না দিয়ে একজন ধরা পড়া অপরাধীর চোখ খেজুর কাঁটা দিয়ে তুলে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। আবার আরেকটি গল্পে ‘নান্দাইলের ইউনুস’ নামের একজন ভাড়াটে খুনিকে উপস্থিত হতে দেখা যায়, কাকে খুন করবার জন্য, কী সমাচার, এর কোনো ব্যাখ্যাই দেওয়া হয় না, গল্পের প্লট মূলত অদ্ভুত সেই আগন্তুকের আগমনকে ঘিরেই। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের উইট এবং হিউমার ক্রূরতা বা অস্বাভাবিকতাকে অনেকটা লঘু করে। গা শিউরানো কোনো ঘটনাও খুব বেশি বীভৎস ঠেকে না। ‘চোখ’ গল্পের কথা মনে পড়েছে আসলে ‘পেনাল কলোনি’ নামের গল্পে অপরাধীকে সাজা দেবার জন্য বিশেষ একটি যন্ত্রের পীড়াদায়ক বর্ণনার জন্য। একটি চরিত্রের ব্যক্তিগত অসহায়ত্ব কিংবা সামাজিক অন্যায়ের সামনে একজন সাধারণ মানুষের অক্ষমতাকে মূল উপজীব্য হিসেবে উপস্থাপন করার দিক থেকে দেখলে সামান্য মিল থাকলেও আর কোনো হিসেবেই কাফকার কাজের সঙ্গে উল্লিখিত গল্পগুলোর কোনো মিল নেই। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বেণী লস্করের মুণ্ডু’ বা সত্যজিৎ রায়ের কিছু রোমাঞ্চ কাহিনিতে ব্যাখ্যাতীত ঘটনার ভীতিকর বা গা শিউরানো প্লট থাকলেও সেগুলো রহস্য রোমাঞ্চ জনরায় পড়ে, কাফকার গল্পের মতন ‘ডার্ক’ বা ‘গ্রটেস্ক’ হয়ে ওঠে না কখনোই।
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, শ্রেণিকক্ষে কাফকা পড়াবার অভিজ্ঞতা– দ্য মেটামরফোসিস বর্ণনারীতি আর বিষয়বস্তুতে যত অভিনবই হোক না কেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা এর গল্পের সঙ্গে রিলেট করতে পারেন। গ্রেগর সামসার পোকা হয়ে যাবার পরবর্তী পর্যায়ে পরিবারের সদস্যদের কাছে তাঁর অহেতুক বোঝা বনে যাবার ব্যাপারটি মূলত মানুষের স্বার্থপরতা আর পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানের অসারতাকে নির্দেশ করে বলে মনে করেন অধিকাংশ শিক্ষার্থী। এই সময়ে এই বিচ্ছিন্নতার বোধ সম্ভবত খুব স্বাভাবিক। দুই-এক প্রজন্ম আগেই, যখন ড্রয়িংরুমের একটি একুশ ইঞ্চি টিভি সেটের সামনে বসে বাড়ির সবাই একই অনুষ্ঠান উপভোগ করতেন, আমাদের দেশে সেই সময়টি চলে গেছে। একালের ছেলেমেয়েরা জ্ঞান হবার সঙ্গে সঙ্গেই নিজস্ব ডিভাইসে নিজের ইচ্ছেমতন সবকিছু দেখেন, পাশের ঘরে ভাই বা বোন কী করছে, তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা হবার দরকার পড়ে না। আধুনিক সময়ের যে বিচ্ছিন্নতার বোধ কাফকা লিখেছিলেন বহু আগে, তা আমাদের সমাজের জন্য তখন প্রযোজ্য না হলেও এখন যেন তা খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের যাপিত জীবনের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়।
পুঁজিবাদের এই প্রবল দাপটকে আমরা হয়তো খুব সচেতনভাবে ঠেকিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম বহুদিন। বিলাস ব্যাসন কিংবা অর্থ উপার্জনের চেয়ে জীবনের অন্যান্য বহু মূল্যবোধকে উঁচুতে তুলে রাখবার চেষ্টা করেছিলাম। ‘অর্থই অনর্থের মূল’ কিংবা ‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান’ ধরনের উদ্ধৃতি তুলে দিয়ে ভাব সম্প্রসারণ করতে দেওয়া হতো স্কুলে। শিশু-কিশোরদের শেখানোর চেষ্টা করা হতো যে টাকাপয়সাকে অত আহামরি কিছু ভাবার দরকার নেই, বেশি রোজগার কাউকে বেশি যোগ্য করে না। কিন্তু এই সময়ে এ ধরনের শিক্ষা সম্পূর্ণই অচল হয়ে গেছে। অর্থ উপার্জন না করতে পারলে যে একজন ব্যক্তির নিজের পরিবারের কাছে কোনো মূল্য নেই তা গ্রেগর সামসার করুণ পরিণতি দেখে বুঝে যান সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ তরুণ-তরুণীরাও।
এই বিচ্ছিন্নতা, বন্ধুহীনতা, পরিবারের সঙ্গে থেকেও একাকিত্বে ভোগার অনুভূতি এই প্রজন্মের জন্য স্বাভাবিক হয়ে গেছে সম্ভবত এই জন্য যে, একশ বছর আগে যে আধুনিক সময়ের শুরু হয়েছিল পাশ্চাত্যে, আমরা প্রাচ্যবাসীরা তখনও পর্যন্ত তাতে প্রবেশ করিনি পুরোপুরি। কাফকার মৃত্যুর একশ বছর পরে এসে হয়তো ঠিক সেই ভীতিকর প্রতিবেশ আমাদের ঘিরে ধরেছে, এতদিন পরে আমরা হয়তো কাফকার বহু আগে দেখানো জগতে ঢুকে গেছি, চাই বা না চাই, বাস করছি।
‘দ্য ট্রায়াল’ শীর্ষক উপন্যাসটিও আমাদের এই সময়ের কথাই বলে গেছে একশ বছর আগে। আমাদের আজকের পৃথিবীতে জোসেফের মতন অজানা অপরাধে গ্রেপ্তার হওয়া, গুম-খুন হওয়া খুব সহজ হয়ে গেছে। জোসেফের নিজের কাছে বা পাঠকের কাছে যা কখনোই পরিষ্কার হয় না, কে বা কারা তাকে কেন শাস্তি দিচ্ছে, এ সময়ে এসে এমন ঘটনা আর বিরল কিছু নয়। আবার যে আমেরিকাকে আমরা ভাবতাম একটা স্বপ্নের দেশ, আমাদের কাছে যা ছিল খুব অভীষ্ট গন্তব্য, সেই আমেরিকার আসল চেহারা স্পষ্ট হয়েছে ইদানীং। অভিবাসী আর কালো/বাদামি চামড়ার যে কোনো মানুষের জন্য আমেরিকা যে খুব নিষ্ঠুর আর প্রতিকূল, তা কাফকার অসম্পূর্ণ উপন্যাস ‘আমেরিকা’য় পড়ে হয়তো অতটা টের পাইনি আমরা, যা এখন বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে পাই। ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটার্স’ বহু আগে শুরু হলেও এই সেদিন পর্যন্ত শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে কালো মানুষদের। অভিবাসী কিংবা প্রবাসীদের প্রতি নিদারুণ বৈষম্য আর অন্যায়ের কথাও এখন আর কারও অজানা নয়। এগারো সেপ্টেম্বরের পর থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠী পদে পদে শিকার হচ্ছেন নানা ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক অন্যায়ের। আমেরিকার এই ভীষণ রূপ দেখিয়েছেন কাফকা বহু আগেই।
কাফকার প্রভাব আর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে হয়তো আরও বহু কিছুই বলা যায়। শ্রেণিকক্ষের আলোচনার কথা বারবার উল্লেখ করছি এজন্য যে, কাফকা পড়াতে গিয়ে আমার বহুবার মনে হয়েছে, সম্ভবত এত ডার্ক, এত নির্জলা নিষ্ঠুরতায় ভরা, এত সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলা সাহিত্যকর্ম স্নাতক পর্যায়ের সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যক্রমে রাখার ব্যাপারে আমাদের আরেকবার ভাবা উচিত। কামুর ‘দি আউটসাইডার’, সার্ত্রের ‘নসিয়া’ আর কাফকার ‘দ্য মেটামরফোসিস’ না পড়ে আধুনিক সাহিত্যের পাঠ সম্পন্ন হবে না এ কথা যেমন সত্য, একইভাবে এসব কাজ তরুণ প্রজন্মকে এই এলিয়েনেশন আর নিহিলিজমের দিকে আরও বেশি ঠেলে দিতে পারে, এমন কথাও আমার প্রায়শ মনে হয়। অন্তত আমি নিজে ছাত্রজীবনে ভয়ানক অস্তিত্ববাদী সংকটের মুখে পড়েছিলাম কাফকা পাঠের পরেই। বহুকাল বের হতে পারিনি সেই সংকট থেকে।
কাফকা আমাদের বোধের গভীরে কাজ করে, আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব আর চেনা জগতের নানান অনুষঙ্গকে প্রশ্ন করতে শেখায়, চেনা বা না চেনা কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব আর শোষণ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে। কৃত্রিমভাবে উৎপন্ন বহু আরাম-আয়েশের অসারতা দেখিয়ে আমাদের প্ররোচিত করে এই বানানো কম্ফোর্ট জন্মের বাইরে, মানসিকভাবে হলে কিছুটা বের হয়ে যেতে। এই বের হবার অনুভূতিটা প্রয়োজনীয় কিনা, তা নিয়ে তর্ক হতে পারে, তবে আর যা-ই হোক, সুখকর নয়।
মন্তব্য করুন