- ফিচার
- কাফকা, কাফকায়েস্ক ও আধুনিকতা
কাফকা, কাফকায়েস্ক ও আধুনিকতা
![ফ্রানৎস কাফকা [৩ জুলাই ১৮৮৩–৩ জুন ১৯২৪]](https://samakal.com/uploads/2023/06/online/photos/Untitled-1-samakal-6478dde29969f.gif)
ফ্রানৎস কাফকা [৩ জুলাই ১৮৮৩–৩ জুন ১৯২৪]
আধুনিক সাহিত্যে যদি হাতে গোনা কয়েকজনকে ধরা যায় যুগান্তকারী লেখক, তাঁদের তালিকায় ফ্রাঞ্জ কাফকাকে রাখতে হবে। এবং কাফকার প্রভাবটা একটু অন্য ধরনের। প্রভাব জেমস জয়েস, মার্শেল প্রুস্তেরও আছে; জয়েসের প্রভাবটা কী রকম : ভাষা নিয়ে ওর যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, সেটাকে কেউ অনুকরণ করতে পারবে না; কিন্তু কাফকার প্রভাব দৃষ্টিভঙ্গিতে, এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাবটা অনুবাদেও চলে আসে। এবং শেক্সপিয়ারের নাটক-গল্পগুলো যেমন সারা পৃথিবীতে মানুষ উপভোগ করে, কাফকাও তেমন। অদ্ভুত একটা ব্যাপার আছে তাঁর সৃষ্টকর্ম বিষয়ে। তিনি কিন্তু খুব কাজ করে গেছেন, অনেক কাজ, এমনকি শেষও করেননি। তাঁর উপন্যাস তিনটি– ‘আমেরিকা’, ‘দ্য ক্যাসল’ আর ‘দ্য ট্রায়াল’; এবং এদের ছাপিয়ে আমার মতে ওর সবচেয়ে যথার্থ শিল্প হলো গল্প মেটামরফোসিস। শৈল্পিক দিক থেকে এর চেয়ে উৎকৃষ্ট কাজ আর প্রায় নেই।
অদ্ভুত যে ব্যাপারটার কথা বলছিলাম তা হলো, কাফকা কম লিখলেও বেশি লিখে গেছে। কাফকা মারা যাওয়ার পর তাঁর চিঠি, ডায়েরিগুলো সামনে এসেছে এবং পরবর্তী সময়ে মহান সাহিত্য হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। লেটার্স টু ফেলিস; তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে যত কথা, ভাঙা গড়া; বেশ সুপরিসর গ্রন্থ। চিঠি নিয়ে রয়েছে লেটার্স টু মিলেনা, তারপর রয়েছে ডায়েরিগুলো। একটা অন্যরকম ব্যাপার, যেগুলোকে লোকে চিহ্নিত করে– আমি উপন্যাস লিখছি, নাটক লিখছি, এপিক লিখছি, এসব বিভাগের বাইরে স্বতঃস্ফূর্ততায় কিছু লিখে ফেলল কেউ, দেখা গেল ওটা থেকে সাংঘাতিক কিছু দাঁড়িয়ে গেছে। আমাদের মাইকেলের ক্ষেত্রেও হয়েছে এমন। মাইকেল তো ইংরেজিতে কবিতা তেমন কিছু লিখতে পারেননি। কিন্তু তাঁর ইংরেজি চিঠিগুলো বেশ মজাদার এবং চিঠিগুলোর সাহিত্যরস বেশ উপভোগ্য।
কাফকাকে এড়ানো যায় না। যেসব লেখক না-চাইলেও প্রভাব বিস্তার করে, কাফকা এ রকম একজন। এবং পপুলার কালচারেও কাফকা আছেন। সত্তরের দশকে একটা টিভি সিরিয়াল ছিল, প্যাট্রিক ম্যাকগুহনে দ্য প্রিজনার। এখনও ইউটিউবে পাওয়া যাবে। দেখেই আমার মনে হচ্ছিল এ তো কাফকায়েস্ক! ব্যাপারটা এমন। কাফকা একটা ধাঁচ দাঁড় করিয়েছেন। এই ধাঁচ এখনও প্রয়োগ্য এবং এর উপযোগ শেষ হবে না।
শৈল্পিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলার মতো আরও চমৎকার কিছু বিষয় আছে কাফকার। কাফকার বর্ণনারীতি নিয়ে বলি। ওর গদ্য, বলার যে ঢং, ভীষণ বাস্তবধর্মী। তার চরিত্রের পোকা হয়ে যাওয়ার যে বর্ণনা, অত্যন্ত নিখুঁত, বাস্তবানুগ, জীবন্ত বর্ণনা। তারপর পেনাল কলোনির কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে কাফকার লেটার টু হিজ ফাদারের কথা। বাবার আধিপত্যে তার দমবন্ধ লাগছে, তার ভেতর ঘনাতে থাকা অভিমান, অভিযোগ এগুলো যেভাবে ব্যক্ত হয়েছে, সাংঘাতিক।
কাফকার লেখাকে রূপক হিসেবে দেখা যায় না, যেটা এটার মানে এটা বা ওটা। কাফকার লেখার একটা সার্বিক প্রাসঙ্গিকতা থাকে জীবনের সাথে। জীবন যেভাবেই পথ বদল করুক না কেন, মেলানো যায়। কাফকার লেখার নানারকম ব্যাখ্যা চালু আছে। ধরা যাক ধর্মের ব্যাপারে। কাফকার ইহুদি ধর্মবলয়ে জন্ম, বেড়ে ওঠা। ওটা কিন্তু তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। সেটিকেও আয়ত্তে এনে বোঝাপড়ায় গেছেন। লেটার টু হিজ ফাদার্স এর উদাহরণ। এখানে বাবার ভেতর যে ইহুদি-পিতৃতন্ত্র, ধর্ম-সমাজের কৃষ্টির ভেতর আছে, সেসবের সঙ্গে তাঁর লড়াই চলেছে এবং কখনও বের হতে পারেননি। মজার ব্যাপার হলো, কাফকার ভেতর এই যে জিউইশ সংস্কৃতি ও জার্মান সংস্কৃতি যুগপৎ কাজ করেছে। কাফকা তো বলা যায় পুরোপুরি জার্মানের সাহিত্যের ভেতর থেকে এসেছেন। একদিকে তাঁর লেখার ভাষা জার্মান, অপরদিকে তাঁর বাড়ি প্রাগে; চেকোস্লোভাকিয়া, এখন যা চেক রিপাবলিক।
ওই একই যুগে কাফকার সমবয়সী আরেকজন ছিলেন, একই শহরে বাস, ইয়ারোস্লাভ হাশেক। তিনি চেক ভাষায় লিখতেন। কাফকা যে বিষয়গুলো নিয়ে ডার্ক, অ্যাবসার্ড পটভূমিতে লিখেছেন, ওই লেখক একই জিনিস লিখেছেন আরও হাস্যরসপূর্ণ ভঙ্গিতে। তাঁর সেরা উপন্যাস হচ্ছে, দ্য গুড সোলজার শোয়াইক। প্রথম মহাযুদ্ধের পটভূমি। শোয়াইকের বয়স হয়ে গেছে, স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছে, এ নিয়ে গল্পটা দাঁড়িয়েছে। প্রথম মহাযুদ্ধের অযৌক্তিকতা-অ্যাবসার্ডিটি নিয়ে এত হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিতে লিখেছেন যে উল্লেখ করার মতো। কাফকা একদিকে দেখাচ্ছেন অন্ধকার দিক, আর হাশেক দেখাচ্ছেন হাস্যরসের দিকটা। হাশেকের জীবনও বোহেমিয়ান ছিল।
যদি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা যায় তাহলে কোনো লেখা অন্ধকারাচ্ছন্ন কি হাস্যরসে পূর্ণ যে ভঙ্গিতেই লেখা হোক না কেন, পাঠক নিতে পারেন। পাঠক কমেডিও নেন, ট্র্যাজেডিও নেন; বিপরীতমুখী রস। স্কুলে থাকতে অবশ্য কেউ এমন বলতেন, ‘আমি ট্র্যাজেডি পছন্দ করি,’ যেন এটা একটা বাহাদুরির ব্যাপার। আরে কমেডি কী দোষ করল! আধুনিক লেখা হিসেবে যেমন বেকেটের লেখাগুলো অদ্ভুত কমেডি। তাঁর লেখা আমাদের জীবনের ওপর যেভাবে আলোকপাত করে, তার প্রভাব আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। আমার কাছে কমেডি ভালো লাগে। লোকে বলে আপনার লেখায় হিউমার বেশি। আমি বলি, ক্ষতি কী! কাফকার লেখার প্রভাব আমার লেখায় সরাসরি নেই। তবে আধুনিক সৃষ্টিকর্তাদের ভেতর ফ্রাঞ্জ কাফকা একজন। আধুনিক সময়বলয়ে যারা বেড়ে উঠেছেন তাদের ভেতর প্রভাবটা নানান আঙ্গিকে আসবেই। কাফকা, জয়েস, প্রুস্ত– ওদের প্রভাব বিস্তারের সক্ষমতা এমন।
একটা কথা আছে– স্ট্রাকচার অব ফিলিং। আমাদের জীবনে অনুভবের যে কাঠামোগুলো, এগুলোকে কিন্তু সৃষ্টি করা যায়। কাফকা পড়ার যে বিশ্বপ্রতিক্রিয়া তা হলো, এখানে তো আমার কথাই বলছে। হুবহু ওরকম না হলেও ঠিক মেলে। ঠিক যেমন এলিয়টের প্রুফ্রক কবিতাতে (দ্য লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফক)। সে কখনও কিছু বলতে পারছে না, ভালো লাগছে কিন্তু বলতে সাহস পাচ্ছে না– এক হিসাবে এটাও একটা কাফকায়েস্ক।
হ্যাঁ— কাফকায়েস্ক আবহটা কাফকার আগেও ছিল। দস্তয়েভস্কির নোটস ফ্রম দি আন্ডারগ্রাউন্ড- ওখানে যে প্রটাগনিস্ট সে নিজেকে পোকার সঙ্গে তুলনা করেছে। ওটাই মেটামরফোসিসে আক্ষরিকভাবে চলে এসেছে। এই যে দস্তয়েভস্কি, কিয়ের্কেগার্ড- ওনাদের একটা ট্র্যাডিশন আছে লেখার। মোটামুটি এটা হলো আধুনিকতার ট্র্যাডিশন। সেই হ্যামলেট থেকে শুরু করে ইন্ডিভিজুয়ালের যে ধারা চলে আসছে তাকে এই ট্র্যাডিশনের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। এমনটা যে আধুনিকতার একটা আলাদা নির্দিষ্ট যুগ আছে। আমরা কিন্তু আধুনিকতার বিবর্তনের মধ্যেই আছি। এর শেষ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এই অশেষ ধারাটাই একেককবার একেক নাম পায়। পোস্ট মর্ডানিজম, সুররিয়ালিজম, ম্যাজিক রিয়েলিজেম- এটা সেটা, সবই কিন্তু ওই আধুনিকতারই বিবর্তনের ফল। কাফকায়েস্কও তাই। এটা চলতে থাকবে।
আধুনিকতার বিপরীত হলো বাঁধাধরার পরিস্থিতি। আধুনিক প্রবহমান ধারায় প্রিমিটিভ সমাজগুলোতেও বদল আসছে। প্রিমিটিভ সোসাইটির প্রতি ঔৎসুক্যটাও কিন্তু মজার। আধুনিক শিল্পীরা প্রিমিটিভ কালচার নিয়ে মোহগ্রস্ত। পিকাসোর আফ্রিকার মাস্ক, গঁগা গিয়ে তাহিতি দ্বীপের চিত্রমালা সৃষ্টি করলেন; এর মানে প্রিমিটিভিজমও আধুনিকতার একটা প্রকাশ হতে পারে। রুশোর যে দর্শন (মানুষ মুক্ত, অতঃপর সমাজ দ্বারা শৃঙ্খলাবদ্ধ; মানুষ মূলত উত্তম, অতঃপর সমাজ দ্বারা কলুষিত; গণদাবি জনপ্রতিনিধির ইচ্ছায় নির্ধারিত হবে না) সেও তো আধুনিকতারই প্রকাশ। আমি একে বলি পারপেচুয়াল ক্যাটওয়াক অব মর্ডানিজম।
জয়েসের পোর্ট্রেট অব অ্যান আর্টিস্ট অ্যাজ এ ইয়াং ম্যান- ওখানে প্রধান চরিত্র স্টিফেন ডিডেলাস বলছে, দুঃখ উপভোগ করছি। এটাও আধুনিকতার একটা দিক। আমাদের এখানেও তো কয়েকজন আন্দোলন করেছিলেন, যেমন রফিক আজাদ ও তাঁর কজন বন্ধু বলেছিলেন, তাঁরা স্যাড জেনারেশন। খন্দকার আশরাফের থিসিসে এটা উঠে এসেছে। তাঁরা একটা ম্যানিফেস্টো লিখেছিলেন ইংরেজিতে। “উই আর স্যাড। আওয়ার ওনলি কম্প্যানিয়ন ইজ দ্য সিগারেট…” এটা পড়ে আমার ডিডেলাসের কথাটা মনে হয়েছিল স্যাডনেসটা ওনারা খুব উপভোগ করছেন। এও আধুনিকতার একটা দিক।
আধুনিকতার দিককগুলো কিন্তু ধাঁধাময়, কখনো পরস্পরবিরোধী। এখানে এটাও আছে ওটাও আছে। কাফকার গ্রিম জগতে কমেডিও আছে। দ্য ক্যাসলে পাওয়া যায়, দুজন যে লাফাচ্ছে আর ভেতরে দেখার চেষ্টা করছে এ তো একেবারে সাইলেন্ট কমেডির মতো।
কাফকা শেষ পড়েছি একটু দেরি হয়েছে। আবার পড়ব। লেখা নতুন করে পড়লে নতুন কিছু পাওয়া যায়। কাফকাকে চিন্তাশীল লেখকরা আত্মীয়জ্ঞান করেন। বুলগেরিয়ার সাহিত্যিক এলিয়াস কানেটির একটা বই আছে কাফকার লেটার্স টু ফেলিসের চিঠিগুলোর আলোচনা। চমৎকার! কাফকা যে তাঁর মর্মে পৌঁছে গেছেন, তীব্র যাতনাবোধ, মর্মবেদনা সহকারে, কানেটির লেখায় তা মূর্ত। আমার এক বন্ধু কাশীনাথ রায় (কবি ও কথাসাহিত্যিক) বলেছিলেন, বইটা পড়ে মনে হয়– কাফকা রাইটিং অন কাফকা। কাফকা নিজেই বুঝি নিজেকে নিয়ে লিখছেন। আমাদের দেশেও কাফকার পাঠক অনেক। তাঁরা কাফকাকে পড়েন, আপ্লুত হন, কাফকা তাঁদের নাড়া দেয়। এই উপমহাদেশ ও তার বাইরের ছবিটাও এমন।
আমি আশা করব, আগামী বছর মৃত্যু শতবর্ষে কাফকার অনুবাদ নতুন করে হবে। অনুবাদ বারবার করতে হয়। যে ভাষাতে অনুবাদ করা হচ্ছে, তার শৈল্পিক দিক প্রতিনিয়ত বদলাতে থাকে। আজকের গদ্য, একশ বছর আগের গদ্যে ফারাক আছে। এজন্য তিন প্রজন্ম পরপর নতুন করে অনুবাদ করা উচিত। এমনকি যেসব অনুবাদকর্ম ধ্রুপদির মর্যাদা পেয়েছে, সেগুলোর পরও নতুন অনুবাদ হওয়া উচিত। যেমন– আমার এক বন্ধুর বাবা জে এম কোহেন (১৯০৩-১৯৮৯)– তাঁর বিশেষ দখল ছিল স্পেনীয় সাহিত্যে। তিনি সারভান্তেসের বই নতুন করে অনুবাদ করেছেন। ফ্রাঁসোয়া রাবেলের লেখা দ্য হিস্ট্রিজ অব গারগান্তুয়া অ্যান্ড পান্তাগ্রুয়েল অনুবাদ করেছেন। তাঁর অনূদিত বইটি দীর্ঘদিন ধরে পেঙ্গুইন ক্লাসিক হিসেবে স্বীকৃত ছিল। হঠাৎ আমার বন্ধু একদিন বলল, বাবার অনুবাদগুলো আর রাখবে না ওরা। নতুন করে অনুবাদ করাচ্ছে। অনেক বই-ই নতুন করে অনূদিত হচ্ছে, যেমন আলবেয়ার কামুর দ্য ফল, আউটসাইডার। কাফকার একাধিক অনুবাদ আছে, আবারও হয়তো নতুন করে অনুবাদ হবে। u
মন্তব্য করুন