- ফিচার
- পাতার বুননে শৈল্পিক জীবিকা
পাতার বুননে শৈল্পিক জীবিকা

গ্রাফিক্স : বোরহান আজাদ
জ্যৈষ্ঠের তাপপ্রবাহে পুড়ছে পুরো গ্রাম। বোরো ধান কাটা শেষে এক রকম কর্মহীন গ্রামের পুরুষরা। চায়ের দোকান, গাছের ছায়ায় জিরিয়ে নেওয়ার ছলে অলস সময় কাটানো ছাড়া আর তেমন কোনো কাজ নেই। সংসারে স্বামীর রোজগারের পাশাপাশি বাড়তি আয়ের আশায় এখন আর হাঁস-মুরগি কিংবা দু’একটা গবাদিপশু পালনেই সীমাবদ্ধ নেই প্রান্তিক গ্রামীণ পরিবারগুলো। ক্ষুদ্র-মাঝারি কুটির শিল্পে আজকাল বেশ এগিয়ে গ্রামীণ নারীরা।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ভালুকজান গ্রামের ৩ সন্তানের জননী আয়েশা আক্তার। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা আয়েশাকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে সেই কবেই দায়মুক্ত হয়েছে তার পরিবার। গ্রামের আর দশটা মেয়ের মতোই একটা সুখী সংসারের স্বপ্ন ছিল তাঁর। তবে বিয়ের পর সবই যেন গুড়েবালি। দিনমজুর স্বামীর জোড়াতালির সংসারে অভাব আর দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই জোটেনি কপালে। মাথা গোঁজার মতো ভিটের ওপর মাটির পুরোনো ঘরটা ছাড়া এক শতাংশ জমিও নেই তাঁর। মৌসুমে দিনমজুর স্বামীর কাজ থাকলেও বেশিরভাগ সময় কর্মহীন। শেষমেশ জীবন-সংগ্রামে নেমেছেন আয়েশা নিজেই। সংসারের খোরাক জোগাতে ঘুরে দাঁড়ানোর হাতিয়ার হয়ে ওঠে শুকনো পাতা। গ্রামের আর দশজন নারীর মতো আয়েশাও বিরামহীন বুনে যাচ্ছেন। হোগলা পাতার রশির বুননে তৈরি করছেন দৃষ্টিনন্দন ঝুড়িসহ বিভিন্ন পণ্য। ৬ বছর ধরে এ কাজের সঙ্গে যুক্ত তিনি।
এখন আয়েশার আয় মাসে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। তাঁর হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হওয়া এমন সব বাহারি কুটির পণ্য বিক্রি হয় দেশ-বিদেশে। কাজের ফাঁকে আয়েশা বলেন, ‘বিয়ার পর যহন আমার পরথম সন্তান হইলো, মাতায় (মাথায়) আসমান ভাইঙ্গা পরলো। যেইহানে নিজেগর খাওন নাই, পোলাপানের খাওন দিমু কইতে? কিছু দিন মাইনষ্যের বাড়ি কাম করনের পর পাতা দিয়া ঝুরি তৈরির কাম শিকছি। স্বামী পোলাপান লয়া ভালো আছি।’ আয়েশার মতো কুলসুম, কোহিনূর, সাজেদাদের গল্প অনেকটা একই রকম।
ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত এক গ্রাম, ভালুকজানে দারিদ্র্যই ছিল মানুষের জীবনসঙ্গী। পুরুষরা দিনমজুরি করলেও নারীরা সংসারের কাজের পর অবসরেই কাটাতেন বাকি সময়। তবে এখন প্রতিটি বাড়ির উঠোনের চিত্র পাল্টে গেছে। প্রতিটি বাড়িতে মা, খালা, চাচি কিংবা স্কুলের শিশুরাও হোগলা পাতার হস্তশিল্প তৈরিতে পার করছেন ব্যস্ত সময়। তাঁদের হাতে তৈরি পণ্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে যাচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকাসহ অন্তত ৮২টি দেশে। ফুলবাড়িয়ার ভালুকজান, কৈয়রচালা, কুশমাইল, বরুকা– এই চারটি গ্রামে অন্তত ১ হাজার হতদরিদ্র পরিবারের সদস্যরা উদ্যোক্তা এবং কারিগর হিসেবে এ কাজের সঙ্গে জড়িত। অন্তত ১২০ ধরনের পণ্য তৈরি হয় এখানে, যার বাজার মূল্য বছরে প্রায় ৩ কোটি টাকা। রাস্তাঘাট সংস্কার করা গেলে এই খাতে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি উৎপাদন এবং বিক্রি দ্বিগুণ হতো বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা।
যেভাবে যাত্রা শুরু
বিডি ক্রিয়েশন নামক বেসরকারি রপ্তানিকারক শিল্পপ্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু ২০০৯ সালে। ২০১৩ সালে প্রথম এই প্রতিষ্ঠানটি কাজ শুরু করে ময়মনসিংহ জেলার ৮ উপজেলায়। নোয়াখালী, ভোলা, পাবনাসহ দেশের অন্য অনেক এলাকার মতো ফুলবাড়িয়া উপজেলাতেও গ্রামের নারী-পুরুষদের কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিটি বাড়িতে গড়ে তুলেছে ছোট-মাঝারি উদ্যোক্তা। ফলে বেড়েছে কর্মসংস্থান। গত অর্থবছরের হোগলা পাতা, বাঁশ, বেতসহ বিভিন্ন হস্তশিল্প মিলিয়ে ২০০ কোটি টাকার পণ্য বিদেশে রপ্তানি করতে পেরেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিডি ক্রিয়েশনের অপারেশন ম্যানেজার মোতালেব হোসেন বলেন, ‘পরিবেশে এমন কিছু পণ্য থাকে, বিশেষ করে খেজুর পাতা, তাল পাতা, হোগলা পাতা, ছন পাতা, বাঁশ, বেত, নারকেলের পাতা– এমন অনেক ধরনের অনুষঙ্গ অবহেলায় পড়ে থাকে। আমরা সেগুলো নিয়েই কাজে নেমেছি। দৃষ্টিনন্দন ডিজাইনের মাধ্যমে হোগলা পাতার বাহারি কুটিরপণ্যের দিন দিন চাহিদা বাড়ছে দেশ-বিদেশে।’ বিদেশের মেলাগুলোয় পণ্য নিয়ে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে সরকারের সার্বিক সহযোগিতার প্রত্যাশাও করেছেন তিনি। বিডি ক্রিয়েশন ছাড়াও এএসকে হ্যান্ডি ক্রাফট, ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের মতো রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো ভালুকজান গ্রাম থেকে পণ্য তৈরি করে নিয়ে গিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে।
বাড়ছে উদ্যোক্তা-কর্মসংস্থান
গুদামে সাজিয়ে রাখা বাহারি কুটিরপণ্য দেখতে দেখতে কথা হয় ভালুকজান গ্রামের কয়েকজন সফল উদ্যোক্তার সঙ্গে। তাঁদেরই একজন মোজাম্মেল হোসেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম এমএইচ হ্যান্ডি ক্রাফট। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় সংসারের অনটনে কিশোর বয়সেই ঢাকা চলে আসেন তিনি। তারপর কাজ নেন একটি হস্তশিল্প কারখানায়। ৫ বছর সেখানে কাজ শিখে ফিরে আসেন নিজগ্রাম ভালুকজানে। ২০১৬ সালে গ্রামের ২০ জন নারীকে হস্তশিল্পে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁর উদ্যোক্তা জীবনের যাত্রা শুরু। এখন তাঁর আওতায় ২৫০ পরিবার হোগলা পাতায় জীবিকা গড়ছে। এসব পণ্য তাঁর কাছ থেকে কিনে নেয় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। এখান থেকে মাসে তাঁর আয় লাখ টাকার ওপরে। মোজাম্মেল হোসেন ছাড়াও এ গ্রামের আলম মিয়া, সুমন মিয়াসহ বেশ কয়েকজন সফল উদ্যোক্তা রয়েছেন। উদ্যোক্তারা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবসায় কিছুটা ভাটা পড়ায় শ্রমিকদের মজুরি আগের মতোই রয়ে গেছে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে বিক্রি বাড়ার সঙ্গে মজুরি বাড়ানোর পাশাপাশি ব্যবসায় লাভ আরও বেশি হবে বলছেন তাঁরা।
এখানে তৈরি হয় ফুলের টব, কিচেন বাস্কেট, টিস্যু বক্স, বিড়ালের বাস্কেট, ক্যারেট, শপিং বাস্কেট, ফ্লোর মেটসহ কুটিরশিল্পের নান্দনিক বাহারি সব পণ্য। উদ্যোক্তারা জানান, পণ্যে ব্যবহৃত হোগলা পাতার রশি বরিশাল, নোয়াখালী থেকে কিনে আনা হয়। পরে নিজ নিজ এলাকায় দক্ষ কর্মীদের মাধ্যমে ফরম্যাট অনুযায়ী তৈরি পণ্য উদ্যোক্তারা সরবরাহ করে থাকেন। প্রতিটি কারুপণ্য তৈরি করে আকার আর প্রকারভেদে একজন নারী শ্রমিক মজুরি পান ৩৫ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত।
মন্তব্য করুন