ঢাকা শহরে বেশ কিছুদিন ধরে গাছ কাটা নিয়ে বেশ আন্দোলন হচ্ছে। প্রাকৃতিক সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে বিধায়  মানুষ এ নিয়ে চিন্তিত। অথচ আমাদের পুরো দেশটাই একসময় সবুজে ভরা ছিল। তখন কিন্তু আমরা কল্পনাও করতে পারিনি কয়েকটি গাছ কাটার জন্য আমাদের চিৎকার করে সংরক্ষণের কথা বলতে হবে। ঢাকা শহরটা এখন শুধুই মানুষের দখলে। অন্য প্রাণীর বসবাস করার কোনো উপায় আমরা রাখিনি। পার্ক, জলাশয় আর ছোট বন সবই শেষ। এর ফলে দেশের অন্য জায়গার তুলনায় এ শহরের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি বেশি। এটি কমানোর উপায় আর আমাদের হাতে একেবারেই কম। ঢাকা শহরকে মানুষমুক্ত করে প্রকৃতির অন্যান্য উপাদান বাড়ানোর পথ খোলা নেই বললেই চলে। পরিবেশের ওপর মানুষের ভোগদখল বাড়লে পরিবেশও এক ফোঁটা ছাড় দেয় না। এর ফলই হলো ঢাকা এখন বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের একটি।

গ্লোবাল প্লানেট ইন্ডেক্সের বিভিন্ন সূচক যেমন স্তন্যপ্রায়ী, পাখি, সরীসৃপ, উভচরসহ অন্যান্য প্রাণীর হ্রাসের হারের এক তুলনা করছে ১৯৭০ সাল থেকে। এখানে দেখা যাচ্ছে, আফ্রিকা অঞ্চলে এই হ্রাসের হার প্রায় ৬৫ শতাংশ; অন্যদিকে এশিয়ায় এই হার প্রায় ৪৫ শতাংশ। সবচেয়ে কম হ্রাস পেয়েছে ইউরোপে; তাও আবার ২৪ শতাংশ। আইইউসিএন গোটা পৃথিবীর প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য একটি লাল তালিকা প্রকাশ করে আসছে ১৯৬৪ সাল থেকে। এই হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, ১ লাখ ৬০ হাজার প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যে প্রায় ৪২ শতাংশই বিলুপ্তির ঝুঁকির মধ্যে আছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ হলো, পরিবেশের ওপর মানুষের অধিক নির্ভরশীলতা আর পরিবেশ ধ্বংস। বাংলাদেশেও উদ্ভিদ ও প্রাণীর লাল তালিকা প্রকাশ হয়েছে। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে, ১৬১৯ প্রাণীর মধ্যে প্রায় ৩৯০ প্রজাতিই হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে। ১০০০ প্রজাতির গাছের মধ্যে ৩৯ শতাংশ প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছে।

এত এত পরিবেশ ঝুঁকির মধ্যেও তা সংরক্ষণের জন্য পৃথিবীব্যাপী আমরা খুব বেশি কিছু করতে পারিনি। সব প্রাণীর বেঁচে থাকার যে সমান অধিকার আছে, তা আমরা সেভাবে আমলেই নিইনি। ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর পুরো স্থলভাগ আর জলভাগের ৩০ শতাংশ করে সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করার অঙ্গীকার আছে। বাংলাদেশে এই সংরক্ষিত অঞ্চলের পরিমাণ এখন পুরো স্থলভাগের মাত্র ৩ শতাংশ। আমাদের সবুজ আচ্ছাদন আছে প্রায় ১৩ শতাংশ। সরকারিভাবে সংরক্ষিত বনভূমি আর সবুজ আচ্ছাদন ৩০ ভাগে উন্নীত করা খুবই কঠিন। এই পরিমাণ ভূমি এখন আর আমাদের নেই। অন্যদিকে অনাবাদি জমি না ফেলে রাখার ব্যাপারে সরকারের ব্যাপক প্রচারণা আছে। চাষাবাদ বাড়িয়ে মানুষের খাদ্যের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে হবে। তাই শুধু মানুষের একটা বাসযোগ্য পৃথিবী করতে গিয়ে আমাদের সব জায়গায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারিয়ে গেছে।

বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই প্লাস্টিক নিষিদ্ধ। অথচ দুনিয়াজুড়ে এখনও প্লাস্টিক বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতি বছর প্রায় ৪০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক উৎপাদন হয়। এর মধ্য থেকে ১৪ মিলিয়ন প্লাস্টিক যায় আমাদের সমুদ্রে। এভাবে প্লাস্টিক যদি সমুদ্রে যেতে থাকে তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রের মাছের ওজনের চেয়ে প্লাস্টিকের ওজন বেশি হবে। মাছের ক্ষতির পাশাপাশি সমুদ্রের তিমি ও ডলফিন জাতীয় প্রাণীরা সরাসরি এই প্লাস্টিকের প্রভাবে আক্রান্ত। সম্প্রতি এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, একটি নীল তিমি ১০-১৫০টি প্লাস্টিক দিনে খেয়ে থাকে; যা মৌসুম শেষে এর ওজন দাঁড়ায় প্রায় ৪ টন। এর ফলে তিমিরা আক্রান্ত হয়ে মারা পড়ছে। বাংলাদেশেও তিমির মৃত্যু হয়েছে এই প্লাস্টিকের প্রভাবে।

পরিবেশ নিয়ে যত ধ্বংসের কথা শুনি সেভাবে এর সংরক্ষণের উদ্যোগের কথা চোখে পড়ে না। ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নেচার রিসার্ভ বা সংরক্ষিত অঞ্চলের পরিমাণ দিন দিন বাড়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশের সুন্দরবনের সংরক্ষণের জন্য নানামুখী পদক্ষেপের ফলে বাঘের সংখ্যা কিছুটা হলেও বেড়েছে। এ দেশের উপকূলজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে সবুজ বেষ্টনীর উপকূলীয় বাদাবন। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে সবুজায়নের জন্য মানুষ প্রচুর গাছ লাগিয়েছে।

আমাদের দেশের সব বন আর জলাশয়, শহর থেকে গ্রাম এমনি সামুদ্রিক অঞ্চলে সব জায়গায় সব প্রাণীর টিকে থাকার ভালো জায়গা দরকার। এটি নিশ্চিত হলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে মানুষই। এবারের পরিবেশ দিবসে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে প্লাস্টিক দূষণকে। আমাদের পরিবেশ অধিদপ্তর এ ব্যাপারে খুব বেশি শক্ত ভূমিকা রাখতে পারেনি। এ দেশে পাতলা পলিথিন এখন নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রায় সবাই আমরা এই পলিথিন ব্যবহার করছি। মানুষের অংশগ্রহণ না থাকলে তা নির্মূল সম্ভব নয়। সবার জন্য সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে মানুষকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: বন্যপ্রাণী গবেষক
ছবি: লেখক ও আবদুল্লাহ আবু দায়ান