- ফিচার
- সাগরকন্যায় মনোরম সূর্যাস্ত
সাগরকন্যায় মনোরম সূর্যাস্ত

কুয়াকাটায় সমুদ্রের জল যেখানে আকাশের সঙ্গে মিশেছে, সেখান থেকে উঁকি দেয় কাঁচা সোনা রোদমাখা সূর্য। সেখানের সূর্যাস্তও মনোহরণকারী; যা যেকোনো মানুষকে ভাবুক করে তোলে। দিগন্তজোড়া সুনীল আকাশ, নয়নাভিরাম সমুদ্রসৈকত, ম্যানগ্রোভ বন, ঝাউবন কুয়াকাটার রূপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। লিখেছেন রুবেল মিয়া নাহিদ
দিনটি ছিল শুক্রবার। হৃদয়ের কম্পন যেন থামছেই না। সাগরকন্যাখ্যাত কুয়াকাটায় যাব। বিকেল ৩টায় বাসা থেকে যাত্রা শুরু। বাসে উঠেই যেন মনে হলো বাসের গতির সঙ্গে ক্রমে দূরত্ব কমছে বহুল প্রতীক্ষিত সেই সাগরকন্যার। পৌঁছালাম রাত ৯টায়। প্রথমেই কিছুটা বিশ্রামের জন্য উঠলাম রেস্ট হাউসে। সেখানে বসে যখন আমরা কৃত্রিম বাতাসে ক্লান্তি দূর করছি, তখন হয়তো সমুদ্রে মৃদু ঠান্ডা বাতাস বইছে আর জানান দিচ্ছে আমাদের আগমনী বার্তা। পরদিন সমুদ্রস্নানের আগে নাশতা সেরে নিলাম। এর পর সমুদ্রের দিকে রওনা দিলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পর সমুদ্রের দর্শন পেতেই যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল বিশালতার সামনে। ঢেউয়ের মাথায় সাদা ফেনা আর ঘোলাটে পানি যেন দু’হাত তুলে ডাকছিল। ছুটে যেতে ইচ্ছা করছিল সেই প্রান্তে, যেখানে নীল আকাশ আর সমুদ্র এক হয়ে গেছে। কিন্তু যাওয়ার তো সুযোগ নেই।
সমুদ্রস্নানে ইতি টেনে মধ্যাহ্নভোজ সেরে বেরিয়ে পড়লাম কুয়াকাটার অন্যান্য দর্শনীয় স্থান দেখতে। একে একে বৌদ্ধমন্দির, রাখাইনপল্লি, হাজার বছরের পুরোনো নৌকা, লেবুরচর, শুঁটকিপল্লি, বিখ্যাত কুয়া সবকিছুই দেখে নিলাম। সন্ধ্যায় যখন সূর্য অস্ত যাচ্ছিল, তখন যেন চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। এত অদ্ভুত সুন্দর প্রকৃতি কী করে হয়! রাতে যখন সমুদ্রপাড়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, তখন অদূরে বিভিন্ন মাছ ও কাঁকড়া দ্বারা তৈরি মসলাযুক্ত খাবারের ঘ্রাণ নাকে এসে তীব্রভাবে লাগছিল। সমুদ্রের তীর ঘেঁষে লাল কাঁকড়া ও ঝিনুকের ছড়াছড়ি। ফেরার পথে সারি সারি সামুদ্রিক মাছ ও কাঁকড়ার দোকান। কুয়াকাটায় এসেছি, কাঁকড়া খাব না, তা কী করে হয়!
লাল কাঁকড়ার রাজ্য: পাখি আর লাল কাঁকড়ার রাজ্য কুয়াকাটার ‘চর বিজয়’। কুয়াকাটা থেকে ট্রলারে চেপে সমুদ্রকে গভীরে থেকে উপভোগ করতে করতে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে দেখা মিলবে মাঝ সমুদ্রে জেগে ওঠা ‘চর বিজয়’। চরটিতে নামলেই বিশেষ করে শীত মৌসুমে দেখা যাবে দু’পাশে পাখির ঝাঁক। আপনাকে টেনে নেবে তাদের কাছে। কখনও চরে, কখনও সমুদ্রের পানিতে অবস্থান তাদের। পানির ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মেলাচ্ছে আবার পর্যটকদের মাথার ওপর দিয়ে ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে চরের অন্য প্রান্তে।
ক্লান্তিতে নিশ্চুপ হয়ে যখন দাঁড়িয়ে পড়বেন বেলাভূমিতে, গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে থাকবে অসংখ্য লাল কাঁকড়া। আপনার গতিবিধি লক্ষ্য করে আট পায়ে ভর করে কাঁকড়াগুলো চলতে শুরু করবে বালুর বুকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বালুচরটি লাল কাঁকড়ায় ভরে যাবে। এমন দৃশ্য দেখে যে কেউই ছুটতে থাকে কাঁকড়া ধরতে। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা ‘চর বিজয়’। প্রায় ১০ বর্গকিলোমিটারের দ্বীপটিতে এখনও কোনো জনবসতি গড়ে ওঠেনি কিংবা নেই কোনো গাছপালা। ছয় মাস পানিতে ডুবে থাকে চরটি আবার অন্য সময় ধু-ধু বালুচর। জনবসতিহীন দ্বীপজুড়ে লাল কাঁকড়া ও নানা প্রজাতির পরিযায়ী পাখির অভয়াশ্রম। কুয়াকাটা থেকে ট্যুরিস্ট বোটে যেতে পারেন।
দ্বীপের কাছাকাছি গেলেই স্বাগত জানাবে অসংখ্য পাখি। বোট থেকে নামলেই লালগালিচা সংবর্ধনা জানাবে লাল কাঁকড়ায় জড়ানো দ্বীপ। দ্বীপের স্বচ্ছ জলে সামুদ্রিক মাছের ছোটাছুটি নিমেষেই আপনার সারাদিনের ক্লান্ত মনকে ভরিয়ে দেবে অন্যরকম আনন্দে। তবে এ দ্বীপে কোনো দোকানপাট নেই, তাই কুয়াকাটা থেকেই খাবার, পানিসহ প্রয়োজনীয় জিনিস সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।
সকালে গিয়ে বিকেলেই ফিরে আসা যায়। কাঁকড়ার চরে ভোরে বা সকালে গেলে লাল কাঁকড়ার দেখা পাওয়াটা কষ্টকর। সূর্যের তাপে বালু উত্তপ্ত হয়ে গেলে কাঁকড়া দলবেঁধে বাইরে বের হয়ে আসে। তাই সকাল ১১টার দিকে গেলেই সহজে লাল কাঁকড়ার দৌড়াদৌড়ি উপভোগ করতে পারেন। তবে খেয়াল রাখতে হবে আপনার উপস্থিতি যেন কোনোভাবেই টের না পায়। সকাল ৭টার পর থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত অসংখ্য লাল কাঁকড়া দেখতে পাবেন এখানে। এ ছাড়া বিকেলেও দেখা মিলবে লাল কাঁকড়ার। ভাটার সময় পানি কিছুটা নেমে গেলে অসংখ্য লাল কাঁকড়া মিছিল নিয়ে ছুটে চলে।
কুয়াকাটার গঙ্গামতির চরে সূর্যোদয়: বিকেলে বাহনযোগে লেবুর বনের পাশে তিন নদীর মোহনায় সূর্যাস্ত দেখা। ‘আন্ধারমানিক’, ‘পায়রা’ আর ‘শিব বাড়িয়া’ এই তিন নদীর মোহনায় যেতে অসংখ্য সাদা ঝিনুকের ‘ঝিনুক বিচ’, রাখাইন লেম্বুনের নামানুসারে ‘লেম্বুন ঠোটা’ থেকে লেবুর বন দেখে নিতে পারবেন।
কুয়াকাটা সৈকতে: পাশেই রয়েছে ২-৩টি বৌদ্ধ মন্দির আর কিছু দূরে রাখাইনপল্লি। মোটরসাইকেলে করে ওই সব এলাকা ঘোরাটাও একটা বিশেষ অভিজ্ঞতা। প্রায় ৫৫০ জন মোটরসাইকেলচালিত গাইড আর দুই শতাধিক হলুদ পোশাকধারী ফটোগ্রাফার আছে কুয়াকাটাতে। ৫০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে একটি মোটরসাইকেলে করে কুয়াকাটার সব স্পট ঘুরে আসা সম্ভব। তবে সূর্যোদয়ের সময়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা আলাদা খরচ করতে হয়। একটু দরদাম করেই থাকেন পর্যটকরা।
কুয়াকাটার রাখাইনপল্লি: কুয়াকাটার রাখাইনপল্লিতে রাখাইনদের তাঁত ও বস্ত্রসামগ্রী পাওয়া যায়। আর কুয়াকাটা শহরের একদম মাঝেই রয়েছে সেই কুয়া, যার নামে এলাকার নামকরণ। মূলত সেটি একটি বৌদ্ধ বিহারে অবস্থিত। টিকিটের বিনিময়ে সেখানে প্রবেশ করে ছবি/সেলফি তুলে কিছুটা উঁচু সিঁড়ি বেয়ে বৌদ্ধ মন্দির ঘুরে দেখতে বেশ লাগবে। কুয়া আর বিহারের পাশেই রয়েছে অনেক মার্কেট। সৈকতের কোলঘেঁষা মার্কেট ছাড়াও সেখানে পাবেন পোশাক-আশাক, ঝিনুক পণ্য, আচারের নানা দোকান। তবে শুঁটকি মাছ কিনতে পর্যটকদের অবশ্যই যেতে হবে সৈকতের পাশের শুঁটকি মার্কেটে, নয়তো কিছুটা দূরে শুঁটকিপল্লিতে।
যাবেন কীভাবে
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সরাসরি বাসে পটুয়াখালী ও বরিশাল মহাসড়ক দিয়ে কুয়াকাটায় যাওয়া যায়। ঢাকার গাবতলী থেকে বাস পাওয়া যায়। বিলাসবহুল লঞ্চে করে বরিশাল গিয়ে সেখান থেকে স্থানীয় বাসে করে কুয়াকাটা যেতে পারবেন।
থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা
থাকার হোটেল, খাবার হোটেল আর দর্শনীয় স্থান প্রায় একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে অবস্থিত। কুয়াকাটা সৈকতের একদম কাছেই ৪০০ থেকে শুরু করে প্রায় ১০ হাজার টাকা মানের অনেক থাকার হোটেল রয়েছে। খাবার হোটেলের প্রায় সবই সৈকত থেকে মাত্র ২-৩ মিনিটের হাঁটা পথ।
মন্তব্য করুন