১৯৪৭ সালের গোড়ার দিক। বাসমতির পোস্টমাস্টার প্রভাসবাবু সরকারি ট্যুরে গিয়াছিলেন। এখন প্রত্যাবর্তন করিতেছেন। ‌স্টিমারের ফার্স্ট ক্লাসের ডেকে বসিয়া আছেন প্রভাসবাবু। অদূরে একমাত্র কন্যা রমা ডেকচেয়ারে উপবিষ্ট। চারিপার্শ্বে সকালবেলার রোদ পক্ষ বিস্তার করিয়াছে– নদীর তীরে সরু সরু উঁচু উঁচু অগাধ সুপুরিশ্রীর নীলচে বনানী। আরো রহিয়াছে জারুল, জামরুল, শিশু, শিরীষ, আম, মহানিম, ঝাউগাছ–  প্রকৃতির বিরাট পরিভাষা শক্তির মতো।
স্টিমারের বাটলার চা-বিস্কুট লইয়া উপস্থিত। সে দুপুরের খানা লইয়া আলোচনা করিতে আগ্রহী। প্রভাসবাবু চুরুট টানিতেছেন। বাটলার জিজ্ঞাসা করিল, ‘পাকিস্তান হইব নাকি কত্তা?’
প্রভাসবাবু বলিলেন, ‘হইবে শুনিয়াছি।’
বাটলার জিজ্ঞাসা করিল, ‘আউজগাই?’
‘হ্যাঁ, শিগগিরই।’
‘আপনারা পাকিস্তানে থাকইয়া না, কত্তা?’
‘দেখা যাক–’
‘থাইক্যা যায়ন মাইয়াপোলা লইয়া, আণ্ডাবাচ্চা আরামে থাকব।’
প্রভাসবাবু চুরুটে টান দিয়া বলিলেন, ‘মিলিয়া-মিশিয়া সুখে থাকিতে পারিলেই ভালো। মাছ খাওয়াও বাটলার–’
২.
১৯৪৭ সালের ২৫শে অক্টোবর। জামা মসজিদে ঈদুল আজহার জমায়েত। কয়েক সপ্তাহ আগে ভারতবর্ষ বিভক্ত হইয়া দুইখানা নতুন রাষ্ট্র গঠিত হইয়াছে। ইহাদের একটির নাম পাকিস্তান, আরেকটির নাম হিন্দুস্তান। হিন্দুস্তানের রাজধানী দিল্লি। পুরোনো দিল্লির অংশে মোগল বাদশাহ শাহজাহান নির্মিত জামা মসজিদ ভারতবর্ষে মুসলমানদের অস্তিত্বের প্রতীক হইয়া কয়েক শত বৎসর যাবৎ দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। নবসৃষ্ট স্বাধীন ভারতের শিক্ষামন্ত্রী কংগ্রেসের সভাপতি জেনারেল মাওলানা আবুল কালাম আজাদ আসিয়াছেন মুসলমান ভাইদের সহিত মোলাকাত করিতে।
মওলানা আজাদ উর্দ্দুতে বক্তৃতা করিতেছেন– ইহা জিন্নাহ সাহেবের ভাঙ্গা উর্দ্দু নহে; মওলানা আজাদের উর্দ্দু চোশত্‌উর্দ্দু। তাহার কণ্ঠ হতাশা ও ক্ষোভে দীর্ণ ও কিঞ্চিৎ উত্তপ্ত। তিনি বলিতেছেন, ‘মনে আছে ভাইসকল, আমি তোমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করিয়াছিলাম; তোমরা আমার জিহ্বা কাটিয়া ফেলিয়াছিলে। আমি হাতে কলম তুলিয়া লইয়াছিলাম; তোমরা আমার হাত কাটিয়া দিয়াছিলে। আমি সম্মুখের দিকে অগ্রসর হইতে চেষ্টা করিয়াছিলাম; তোমরা আমার ঠ্যাং ভাঙ্গিয়া দিয়াছিলে। আমি ঘুরিয়া দাঁড়াইতে গিয়াছিলাম; তোমরা আমার পৃষ্ঠদেশ ক্ষতবিক্ষত করিয়া দিয়াছিলে।
‘গত সাত বৎসরের তিক্ত রাজনৈতিক জুয়াখেলার সময় আমি বিপৎসংকেত উত্তোলন করিয়া বারবার তোমাদের চেতনা ফিরাইয়া আনিতে চেষ্টা করিয়াছি। তোমরা কেবল আমাকে অগ্রাহ্য কর নাই, বরং উপেক্ষা ও অস্বীকারের প্রাচীন ঐতিহ্য চেগাইয়া তুলিয়াছিলে। ঐ সবের ফলশ্রুতিতে আজ বিপদের অমানিশা তোমাদের ঘিরিয়া ফেলিয়াছে। অন্যদিকে আজ আমি নিজেই স্বদেশ ভূমিতে এতিম হইয়া গিয়াছি, আমার চেতনা পর্যুদস্ত হইয়া গিয়াছে। আমার হৃদয় যারপরনাই ভারাক্রান্ত।’   
‘একবার ভাবিয়া দেখ তোমরা কোন্‌ পথটি বাছিয়া লইয়াছিলে যে আজ এই বিপন্ন দশায় উপনীত হইয়াছ? আমি বলিয়াছিলাম, দ্বিজাতি তত্ত্ব তোমাদের সম্মানজনক অস্তিত্ব বিপন্ন করিয়া তুলিবে, তোমরা আমার কথায় কর্ণপাত কর নাই। যাহা হউক, বাদানুবাদে না-যাইয়া আমি সোজাসুজি বলিব ভারতবর্ষের বিভক্তি একটি বড় রকমের ভুল। ইহার মধ্যে দিয়া হিন্দু-মুসলিম সমস্যার সমাধান হইবে না। মুসলিম লীগের দিগভ্রান্ত নেতৃত্ব তোমাদের সর্ব্বনাশের কারণ হইয়াছে। অথচ নবসৃষ্ট হিন্দুস্তানে মুসলিম লীগের আজ আর কোনো কিছু করিবার অবকাশ নাই।’
মওলানা আজাদ আশ্বস্ত করিয়া বলিলেন, ‘ভাইয়েরা আমার, তোমাদের চারিপার্শ্বে যে দুর্যোগের ঘনঘটা তাহা অচিরেই অপসৃত হইবে। পিতৃভূমি হিন্দুস্তান ত্যাগ করিয়া পাকিস্তানে দেশান্তরের ভাবনা এক্ষণে পরিত্যাগ কর। নিজের বিচারবুদ্ধি আর ঘুম পাড়াইয়া রাখিও না। গতকাল তোমরা যমুনার তীরে গিয়া নির্বিঘ্নে অজু করিয়া আসিয়াছ; তবে আজ কেন ভীতসন্ত্রস্ত হইয়া পড়িয়াছ? প্রকৃত মুসলমানের পরিচয় দাও। আল্লাহর উপর বিশ্বাস হারাইও না। ভয় ও দুঃখে কাতর হইও না। ভাইসকল, যাহা ঘটিবার, তাহা ঘটিয়া গিয়াছে। অবশ্যম্ভাবী পরিবর্তনকে মানিয়া লও। হিন্দুস্তান তোমাদের মাতৃভূমি। কেন ইহা পরিত্যাগ করিবে? নিজের বোধবুদ্ধি লুপ্ত হইতে দিও না। দেশভাগ হইয়াছে তাহাতে কী-বা আসে যায়? নূতন করিয়া নিজের পৃথিবী গড়িয়া লও। আল্লাহ তোমাদের সহায় হন কিঞ্চিৎ এই দোয়া করি।’  
৩.
দেশভাগের করুণ সানাই বাজিতেছে। প্রথমোক্ত জীবনানন্দ দাশের উপন্যাসে একজন মুসলমান একজন হিন্দুকে ভারতবর্ষ বিভক্তির কারণে জন্মভূমি পূর্ব বাংলা ত্যাগ করিয়া হিন্দুস্তানে দেশান্তরী হইতে মানা করিতেছে। অন্যদিকে নেহরুর শিক্ষামন্ত্রী মাওলানা আজাদ মুসলমানদের উদ্দেশ্য করিয়া ধরিতে গেলে একই কথা বলিতেছেন। বলিতেছেন, তাহারা যেন ভারতবর্ষ ছাড়িয়া পাকিস্তানে চলিয়া না-যায়। তবে তাহাদের কথার সুর ভিন্ন, তাহাদের যুক্তিও অভিন্ন নহে।
বাস্তবে যাহা ঘটিল তাহা হাজার হাজার মানুষের করুণ কাহিনি। পাঞ্জাবের যে অংশ ইন্ডিয়াতে পড়িয়াছে সেই স্থান হইতে মুসলমানেরা দলে দলে পাকিস্তানে পাড়ি জমাইল। বাংলার যে অংশ পাকিস্তানে পড়িয়াছে সেই পূর্ব বাংলা হইতে হাজার হাজার হিন্দু সীমান্ত অতিক্রম করিয়া ইন্ডিয়াতে গেল। এই দেশান্তর ছিল মর্মান্তিক। আত্মপরিচয়ের সংকট পরের কথা, লক্ষ মানুষের জন্য প্রাণ লইয়া টিকিয়া থাকাই দায় হইল।
৪.
বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে মুসলমানদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র কি আবশ্যক হইয়া উঠিয়াছিল? ‌ভারতবর্ষের মুসলমানদের অবস্থা তৎকালে কেমন ছিল সেই প্রসঙ্গে নানা মুনির নানা মত রহিয়াছে। ‌মুসলমানরা নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে কী ভাবিত তাহার হদিশ করা জরুরী। এই প্রসঙ্গে ১৯৩১ সালে ‘শিখা’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘স্বাধীন ভারতের দাস’ শীর্ষক প্রবন্ধে নাজির উদ্দীন আহমদ যাহা লিখিয়াছিলেন তাহা প্রণিধানযোগ্য।
তিনি লিখিয়াছিলেন, ‘ভারতবর্ষে পাঞ্জাব এবং বঙ্গদেশ ব্যতীত ‌সর্বত্র মুসলমান সংখ্যায় অত্যন্ত অল্প। তাই ভবিষ্যৎ ভারতের শাসনভার হিন্দুর হাতেই ন্যস্ত হইবে, সন্দেহ নাই। হিন্দু যে সে-ক্ষমতা খুব নিরপেক্ষভাবে ব্যবহার করিবে তাহার অনুকূল প্রমাণ বর্তমানে পাওয়া যাইতেছে না। মুসলমানের উপর হিন্দুর বিদ্বেষ প্রত্যহই প্রকট হইয়া পড়িতেছে। ভারতবর্ষ ধীরে ধীরে দুইটি স্বতন্ত্র সৈন্যবাসে পরিণত হইতেছে। হিন্দু পূর্ব্বে যাহাকে ঘৃণা করিত তাহার প্রতি তাহার দরদ যেন নিমেষে নিমেষে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইতেছে। জৈন, বৌদ্ধ, শিখ, ব্রাহ্ম, নমঃশূদ্র সবাই তাহাদের পার্থক্য ভুলিয়া হিন্দুর সহিত এক হইয়া দাঁড়াইতেছে, এবং সে-একত্বের পরিপুষ্টি সাধন করিতেছে মুসলমানের উপর একটা বিজাতীয় ক্রোধ। পুরুষানুক্রমে হিন্দু সমাজ মুসলমান বিদ্বেষকে তাহার রাজনৈতিক জীবনের এক মূলমন্ত্র করিয়া রাখিয়াছে বলিয়া মনে হয়। … মানুষ হিসাবে মুসলমানের প্রতি হীন ধারণা পোষণ হিন্দুদের মধ্যে প্রায় সর্বত্র দেখা যায়। একবার কলিকাতার এক সবাই এমন কথাও অবলীলাক্রমে বলা হইয়াছিল যে, ভিন্ন জাতীয় নারীহরণ মুসলমানের এক ধর্ম্মীয় কাজ। ইহা দ্বারাই হিন্দুর মনের পরিসর বুঝা যায়। শত শত বৎসর ভারত শাসন করিয়া মুসলমান যে অপরাধ করিয়াছে, হিন্দুর নিকট তাহা অমার্জ্জনীয়।’
আহমদ সাহেব অধিকন্তু লিখিতেছেন, ‘স্বাধীন ভারতে মেজরিটি (বড়) সম্প্রদায়ের এই প্রকার মনোভাবকে ভয় করার মুসলমানের যথেষ্ট হেতু আছে। বর্তমান সময়ে এদেশ অনেকটা হিন্দুর দ্বারাই শাসিত হইতেছে। মুসলমান এ শাসনের উপরও সম্পূর্ণ প্রত্যয় করিতে পারিতেছে না। যেখানে হিন্দুপ্রাধান্য সেখানেই মুসলমানের অবিশ্বাস। হিন্দুরা মুসলমান সমাজের উন্নতির সাহায্য করা দূরে থাকুক বরঞ্চ তাহাদের সমস্ত শক্তি নিয়োগ করিতেছে তাহাদিগকে দাবাইয়া রাখিতে। কিছু দিন পূর্বে বঙ্গীয় প্রাদেশিক প্রাথমিক শিক্ষা আইনের ব্যাপারে হিন্দু সম্প্রদায় যে মনোভাবের পরিচয় দিয়াছে তাহা বাস্তবিকই অত্যন্ত লজ্জাজনক। তাই ভবিষ্যৎ ভারতে হিন্দু শক্তির অপব্যবহার মুসলমানেরা ভয় করিতেছে। কারণ হিন্দু আদর্শ ও হিন্দু মনোবৃত্তির প্রতিকূলতাকরণ হিন্দু সহ্য করিবে না। বিলাতি বস্ত্র বিক্রয়ের অপরাধে কিছু পূর্ব্বে বেনারসে আগা মোহাম্মদ জান হিন্দুর গুলিতে প্রাণ হারাইলেন। কংগ্রেসের কথামত হরতাল না করিবার জন্য কানপুরে কত লোকের প্রাণ নষ্ট হইল। এইগুলি দৃষ্টান্ত মাত্র। প্রকৃত দ্বন্দ্ব শুধু এই দৃষ্টান্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নহে; তাহা সুবিস্তৃত উভয় সম্প্রদায়ের জীবনের প্রতি কার্য্যকলাপের মধ্যে।’
নাজির উদ্দীন আহমদের প্রবন্ধ হইতে এই দীর্ঘ উদ্ধৃতি প্রদানের বিকল্প নাই। বাস্তবিকই তৎকালীন মুসলমান সম্প্রদায়ের শঙ্কার অন্যতম কারণ ছিল হিন্দুদের প্রাধান্য। এ কারণে ব্রিটিশরাজ ভারত ত্যাগ করিবার পূর্বেই হিন্দুদের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের সহিত একটি চুক্তি করিবার কথা আলোচনায় আসিয়া গিয়াছিল। আহমদ সাহেব এই ভাবিয়া দুশ্চিন্তিত ছিলেন যে, ‘… সমস্ত বড় কথার অন্তরালে ভারতের রাজনীতি ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানের বিভাগটাই অতি বড় সত্য রূপে দেদীপ্যম্যান হইয়া রহিয়াছে। সাত কোটি মুসলমানের ভবিষ্যৎ ছাব্বিশ কোটির সহিত নির্মম প্রতিযোগিতায় কী হইবে স্থির করিতে বেশি চিন্তা করতে হয় না।’
৫.
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে যাহা ঘটিয়াছিল তাহার একটি ছিল ভারতবর্ষ বিভক্ত করিয়া পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান নামের দুইটি দেশের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। এই বিভক্তির গোড়াপত্তন বহু আগে। ভারতবর্ষ ভাগের ঘটনা ইহাই প্রথম নহে। ১৯৩৫ সালে গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট করিয়া বার্মাকে পৃথক করিয়া ফেলা হইয়াছিল। ভুটান তো বহু আগেই স্বাধীন রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিল।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন দীর্ঘদিন হইতে চলিতে ছিল। ১৯৪৬-এর ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’-এর মর্মান্তিক ইতিহাস বাদে সহিংসতার ঘটনা খুব বেশি ছিল না। এইকথা বলা যাইবে না যে কোনোরূপ রাষ্ট্রবিপ্লবের মধ্য দিয়া ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করেছিল। ঘটনাবলীর পর্যালোচনা করলে নিশ্চিত হওয়া যায় যে শেষ অবধি ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে শান্তিপূর্ণ উপায়ে অর্থাৎ আলোচনা এবং চুক্তির মধ্য দিয়ে। নবসৃষ্ট স্বাধীন রাষ্ট্র ভারতের নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি লর্ড মাউন্টব্যাটনকে দেশের গভর্নর জেনারেল হিসেবে গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয় একটি প্রদেশ হিসাবে। ‌কিন্তু দ্রুত পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা পূর্ব পাকিস্তানের উপনিবেশিক শাসন কায়েম করে।
একদিকে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটিল, অন্যদিকে ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হইল।  ব্রিটিশরাজ কেন ভারত পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেল তাহা লইয়া বিভিন্ন মতবাদ প্রচলিত রহিয়াছে। এই অভিযোগও শক্ত যে অপরিকল্পিতভাবে ও তাড়াহুড়া করিয়া তাহারা শাসনভার ভারতীয়দের উপর তুলিয়া দিয়ছিল। সেরিল র‌্যাডক্লিফের বেঙ্গল বাউন্ডারি এওয়ার্ড যথাযথভাবে পর্যালোচনা না-করিয়াই বাস্তবায়ন করা হইয়াছে। অথচ কমিশনের ভারতীয় সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ নয়টি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতেই সক্ষম হন নাই। আর কাশ্মীর সমস্যা তো এখনও দগদগে ক্ষতের মতো জীবন্ত যে-রকম কিনা ফিলিস্তিনের বিভক্তি।
ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে আরও শক্ত অভিযোগ হইল তাহারা যখন ভারতের স্বাধীনতার কথা বিবেচনা করিতেছিলেন তখন নজর করেন নাই যে সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ঘটিতেছে এবং সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হইয়া ইঠয়াছে। তাহারা সচেতন থাকিলে ১৯৪৬-৪৭-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এড়ানো সম্ভবপর ছিল।
ভারত বিভক্তির জন্য মুসলিম লীগ দায়ী নাকি কংগ্রেস দায়ী– এই বিতর্কের শেষ নাই। নতুন নতুন কাগজপত্র আবিষ্কার হইতেছে আর আর নতুন নতুন যুক্তি উত্থাপিত হইতেছে। একদল মুসলিম লীগকে দোষী সাব্যস্ত করিয়া সুখী, অপর দল কংগ্রেসকেই এ বিভক্তির জন্য দায়ী করে। একে অপরকে দোষারোপের প্রক্রিয়া অদ্যাবধি চলমান রহিয়াছে। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনাবসানের সূত্রে বাংলা ও পাঞ্জাবের যে বিভক্তিকরণ তাহার মূল্যায়ন ও পুনর্মূল্যায়ন একটি অব্যাহত প্রক্রিয়া বলিয়া মানিয়া লইতে হয়।
জিন্নাহ সাহেব মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবী তুলিয়াছিলেন ইহাই প্রচলিত বয়ান। ইহার বিপরীতে সাম্প্রতিককালে ইতিহাসবেত্তা আয়েশা জলিল বলিয়াছেন‌, জিন্নাহ সাহেব মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির দাবী তুলিয়াছিলেন না-বলিয়া বলা উচিত তিনি ভারতের হিন্দু-মুসলমান সমস্যার প্রতি দৃঢ়তার সহিত দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিলেন। তাহার মতে, জিন্নাহ সাহেব প্রকৃতপক্ষে এমন একটি শাসনতন্ত্র চাহিয়াছিলেন যাহাতে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে ক্ষমতার ভাগাভাগির সুস্পষ্ট বিধান থাকিবে। নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড ও কানাডাতে এই ধরনের ব্যবস্থা রহিয়াছে। জিন্নাহ সাহেবের লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের মাইনরিটি হিসাবে নহে বরং একটি জাতি হিসাবে বিবেচনা করা।
সম্প্রতি আবিষ্কৃত কাগজপত্র পড়িয়া অনুমিত হয় দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রবক্তা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৬-এর ডিসেম্বর অবধি ভারতবর্ষ বিভাজনের স্পষ্ট দাবী উত্থাপন করেন নাই। তিনি ‘হিন্দু ইন্ডিয়া’ ও ‘মুসলিম ইন্ডিয়া’র কথা বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখ করিয়াছেন। ১৯৪৭ সালের মে মাসেও তিনি ধর্মীয় কারণে পাঞ্জাব বিভক্তির বিরোধিতা করিয়াছেন। জিন্নাহ সাহেব ‘হিন্দু ইন্ডিয়া’ ও ‘মুসলিম ইন্ডিয়া’র একটি কনফেডারেশনের কথাই ভাবিয়াছিলেন বলিয়া অনেকে ধারণা করেন।
বিংশ শতাব্দীর শুরু হইতে যে স্বদেশী আন্দোলন শুরু হইয়াছিল তাহা ভারতের বিভিন্ন জাতির মধ্যে ঐক্যবোধ কিয়দংশে সংহত করিয়াছিল। অন্যদিকে হিন্দু-মুসলমান প্রশ্ন এই ঐক্যবোধকে রাতারাতি খর্ব করিয়া ফেলে। বাংলার ‌স্বদেশী আন্দোলন পরবর্তীকালে দেশজোড়া অসহযোগ আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। ‌ভারতীয় ঐক্যবোধের মূলে যে ব্রিটিশ বিরোধিতা তাহা বিস্মৃত হইলে চলে না। তাই নীরদ চন্দ্র চৌধুরী মহাশয় আক্ষেপ করিয়া বলিয়াছিলেন, ‘ইংরেজবর্জ্জিত ভারতবর্ষের জন্য অতি অস্পষ্ট একটি ফেডারেলিজম ভিন্ন অন্য কোনো রাজনৈতিক আদর্শ আমরা মনের মধ্যে খাড়া করিয়া তুলিতে পারি নাই।’ অতঃপর তিনি যাহা বলিয়াছিলেন তাহা খুবই গুরুত্বপূর্ণ : ‘যখনই আমরা বাঙালি মনের ভারতীয় ঐক্যবোধের প্রকৃত রূপটি ধরিতে চায়, তখনই দেখি, উহা ভারতীয় বা হিন্দু সংস্কৃতির ঐক্যবোধ মাত্র– হিমালয় হইতে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিস্তৃত বহু জাতি বহু ভাষা বহু ধর্মসেবিত বাস্তব ভারতবর্ষের ঐক্যবোধ নয়।’ চৌধুরী মহাশয়ের আক্ষেপ ভিত্তিহীন ছিল না।
অখণ্ড ভারত হিন্দুপ্রধান দেশ। তর্কাতীত যে স্বরাজ কায়েম হইলে ভারতবর্ষে মুসলমানরা মাইনরিটি হইয়া পড়িবে। উপরিউদ্ধৃত নাজির উদ্দীন আহমদ সাহেবের অভিমত এই প্রসঙ্গে পুনরায় স্মরণ করা যাইতে পারে। উল্লেখ অপ্রসাঙ্গিক হইবে না যে, গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্টের অধীনে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইয়াছিল ১৯৩৭ সালে। ইহাতে কংগ্রেস ম্যাজরিটি পার্টি হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৫৮৫ আসনের মধ্যে তাহারা ৭১১টি আসনে বিজয় লাভ করে এবং অন্য কোনো দলের সহায়তা ছাড়াই ১১টির মধ্যে ৫টি প্রদেশে সরকার গঠন করিতে সক্ষম হয়। স্বাধীন অখণ্ড ভারতবর্ষে হিন্দুদের প্রাধান্য যে অপ্রতিরোধ্য এই সত্যটি প্রতিপন্ন হয় এবং মুসলমানদের মধ্যে গভীর আশঙ্কার সৃষ্টি করে। ১৯৪০ সালে গৃহীত লাহোর প্রস্তাব মুসলমানদের এবম্বিধ দুশ্চিন্তার সুস্পষ্ট প্রতিফলন।
দুশ্চিন্তাই মানুষকে দুশ্চিন্তা নিরসনে উদ্যোগী করিয়া তোলে। ভারতীয় মুসলমানদের ক্ষেত্রেও তাহা ঘটিয়াছিল। মুসলিম লীগ যে ক্রমে শক্তিশালী পার্টিতে পরিণত হইয়াছিল তাহার অন্যতম কারণ হইল এই যে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ মুসলমানদের অবস্থান উন্নতির জন্য একনিষ্ঠভাবে কাজ করিয়াছেন। আবুল কাশেম ফজলুল হকের মুসলীম লীগে যোগদান এইরূপ একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। অন্যদিকে কংগ্রেস নেতারা তাহাদের নিস্পৃহতা দিয়া এই কাজে সহায়তা করিয়াছেন। ১৯৪০ সালে  লাহোর প্রস্তাব যে দুইজন উপস্থাপন করিয়াছিলেন তাহারা হইলেন পাঞ্জাবি নেতা সেকান্দর হায়াৎ ও পূর্ব বাংলার নেতা আবুল কাশেম ফজলুল হক। ১৯৪৬-৪৭-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিজয় ছিল আশার অতীত। বাংলা ও সিন্ধু উভয় প্রদেশে মুসলিম লীগ সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে।
১৯৪৭-এ ভারত বিভাগের প্রেক্ষাপট সংক্ষেপে রচনা কোনো সহজ প্রকল্প নহে। সবশেষে দুই-তিনটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে চাই। প্রথমত: দেখা যাইতেছে লাহোর প্রস্তাবে ভারত বিভক্তিকরণের কোনো ধারণা ছিল না। দ্বিতীয়ত: জিন্নাহ সাহেবের দ্বিজাতি তত্ত্বেরও কোনো উল্লেখ ছিল না লাহোর প্রস্তাবে। তৃতীয়ত: আওয়ামী লীগের ছয় দফা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের  যে সার্বভৌমত্বের প্রস্তাব ছিল তাহা সর্বতোভাবে লাহোর প্রস্তাবেরই অনুগামী। ইহা অগ্রাহ্য করিয়া পাকিস্তানি শাসকচক্র ১৯৭১ সালে কার্যত লাহোর প্রস্তাবকেই অস্বীকার করিয়াছে।
একটি মজার কথা উল্লেখ করিয়া এই নিবন্ধ শেষ করিতে চাহি। কাগজপত্র ঘাটিয়া দেখা যাইতেছে ‘পাকিস্তান’ নামটি মুসলিম লীগের উদ্ভাবন নহে। ‌ কংগ্রেসের মুখপত্র অমৃতবাজার পত্রিকা এবং আনন্দবাজার পত্রিকা এই নামটি উদ্ভাবন করে এবং ক্রমাগত ব্যবহার করিতে থাকে। এইভাবে তাহারা পাকিস্তান নামটি চাপাইয়া দেয়। ইতিহাসের ভাজে ভাঁজে কত যে রস সঞ্চিত রহিয়াছে গবেষণা না করিলে তাহা বুঝা যায় না।

বিষয় : প্রচ্ছদ দেশভাগ

মন্তব্য করুন