ঢাকা বুধবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩

স্মরণ

মুকুটবিহীন সম্রাট নজরুল

মুকুটবিহীন সম্রাট নজরুল

কাজী নজরুল ইসলাম (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬-১২ ভাদ্র ১৩৮৩)

মো. শহীদুল্লাহ সিকদার

প্রকাশ: ২৬ আগu ২০২৩ | ১৮:০০

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে চির অমর হয়ে আছেন। ৪৭ বছর আগে আজকের এই দিনে কবির দৈহিক মৃত্যু হলেও তাঁর উপস্থিতি সাহিত্যপ্রেমিক মানুষ মাত্রই প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করেন। ‘গাহি সাম্যের গান,/ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,/ নহে কিছু মহীয়ান।’ নজরুলের এ উক্তি মনে করিয়ে দেয়, যখন কারও পরিচয় হয় মানুষ তখন শ্রেণি-পেশা, বর্ণ-গোত্র, জাত-পাত, উঁচু-নীচু, শাসক-শোষক বা কোন ধর্ম-অধর্মের ব্যবধান থাকে না। থাকে না কোনো বিভেদ, থাকে না কোনো বৈষম্য। মানুষ পরিচয়ে মিলে যায় যত চেনা-অচেনা, সাদা-কালো, সীমা-পরিসীমার দ্বন্দ্ব।

মানুষকে যিনি মানুষের পরিচয়ে বিশ্বভুবনে পরিচিত করে দিয়েছেন তিনি সব মানুষের প্রতিনিধি, মানবতার ত্রাতা, মানুষের হৃদয় হরা, ভুবনজয়ী, দিগ্বিজয়ী সম্রাট কাজী নজরুল ইসলাম। মানুষ কবিতায় কবি মানুষের সেই শাশ্বত পরিচয় তুলে ধরেছেন। কবির সমস্ত সৃষ্টি, কর্মচিন্তা, ধ্যান-ধারণা সবকিছুই মানুষের জন্য। কবির মানুষ হলো ব্যথিত-বঞ্চিত, কবির মানুষ হলো সৃষ্টির সেরা।

 মানুষ যখন সমাজে বঞ্চিত হয়েছে, তখন নজরুলের মানবিক হৃদয় ব্যথিত হয়েছে। তাই তিনি সৃষ্টি করেছেন অমর বাণী, গল্প, গান, কবিতা ও উপন্যাস। আজকে আমরা বঞ্চনা দেখছি, সংকট দেখছি। উদারতার সংকট, সাম্প্রদায়িকতার সংকট দেখছি, বৈষম্য, শোষণ, অত্যাচার, নিপীড়ন দেখছি। পরাধীন ভারতে নজরুল আরও বেশি কাছ থেকে দেখেছেন মানুষের সংকট। এ সংকটে বিশাল, মানবিক, শিশুসুলভ, সুন্দর, পবিত্র নজরুল-হৃদয় কেঁদেছে মানুষের বঞ্চনা দেখে। পরাধীন ব্রিটিশ ভারতে নজরুল কাছ থেকে দেখেছিলেন পরাধীন দেশে মানুষের বিকাশের সম্ভাবনার দ্বার কীভাবে রুদ্ধ করা হয়, মানুষের কোমল হৃদয়ের আকুতিকে কীভাবে অবজ্ঞা করা হয়, কীভাবে মানুষ বঞ্চিত, অত্যাচারিত, নিপীড়িত হয়। সেখানে শুধু আর্থিক সংকটই নয়, সেখানে সাম্প্রদায়িকতার সংকট, কথা বলতে না পারার সংকট ও কাজ করতে না পারার সংকট। তিনি দেখেছেন কীভাবে উদারতা ভূলুণ্ঠিত হয়, কীভাবে মানুষের বিকাশের পথ রুদ্ধ করা হয়– এসব করুণ চিত্র কবি কাছে থেকে অবলোকন করেছেন। এর প্রতিবাদে কবি রচনা করেছেন বিদ্রোহী কবিতা।

মুক্তিসংগ্রামের ভাবপ্রবণ আদর্শ এবং আপসহীন অদম্য ইচ্ছা তাঁকে বেশি প্রভাবিত করেছে। তাই জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের অগ্রনায়কদের নিয়ে যেমন– লোকমান্য তিলক, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন প্রমুখকে নিয়ে তিনি কবিতা, গান ও প্রবন্ধ রচনা করেন। কবির মনে ঢেউ সঞ্চার করে নিরন্তর আন্দোলিত করে বিদেশি বিপ্লববাদ আন্দোলনের ইতিহাসও। কবি কল্পনাকে উদ্দীপ্ত, অনুপ্রাণিত করেছিল গোপীনাথ সাহা, ক্ষুদিরাম বসু, সূর্য সেন, যতীন দাস প্রমুখ শহীদের দুঃসাহসিক কার্যকলাপ। এ ছাড়া নজরুল কমিউনিস্ট আন্দোলনের দ্বারাও যথেষ্ট প্রভাবিত হন। সেই সময় মানুষের সংকট মোচনের জন্য পরাধীন ভারতে আমাদের এই ভূখণ্ডের সন্তান সন্দ্বীপের কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের সঙ্গে মিলে অবিভক্ত ভারতে প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন ১৯২২ সালে।

নজরুল বলেছেন, ‘আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম’। এ প্রেম ব্যক্তিগত নয়। তিনি প্রেম করেছেন মানুষের সঙ্গে, তিনি তৎকালীন বাংলা, ভারতের মানুষকে যেমন ভালোবাসতেন, তেমনি সাড়া বিশ্বে সব মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল। তিনি দেশ-বিদেশের সীমানার ব্যবধানকে ভাঙতে চেয়েছেন। শক্তি ও ক্ষমতার সাম্য চেয়েছেন। অত্যাচারী ও অত্যাচারিত যেন বৈষম্য ঘুচিয়ে বন্ধু হয়ে যায়, সেই সহাবস্থান চেয়েছেন। তিনি মানুষের কষ্টে কেঁদেছেন, মানুষের দুঃখে ব্যথিত হয়েছেন। তাঁর সমস্ত ত্যাগ, তিতিক্ষা, সংগ্রাম, লেখনী, মেধা, মানবতাবাদী বাণী– সবকিছু ছিল মানুষের জন্য। তিনি কোনো রাজ্যের রাজা নন বা কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের সম্রাট বা শাসক নন। তিনি সমগ্র মানুষের কাছে মুকুটহীন সম্রাট।   

অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার : প্রাক্তন উপ-উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন