গত ১০ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সের নিসে অনুষ্ঠিত ‘আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৩’-এ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের চার তরুণ– মোহাম্মদ সামছুজ্জামান আরাফাত, আরিফুর রহমান, মিশু বিশ্বাস ও শুভ কুমার দে নির্ধারিত সময়ে আয়রনম্যানের চ্যালেঞ্জে অংশ নিয়ে সফল হয়েছেন। পূর্ণদৈর্ঘ্যের এই আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ৯৩ দেশের ২ হাজার ৮০ ট্রায়াথলেট অংশ নেন। বাংলাদেশের সফল চার তরুণের গল্প শুনি চলুন…

আয়রনম্যানের বিভিন্ন ধরন থাকলেও ফ্রান্সের নিসে গত ১০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৩ হচ্ছে পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রতিযোগিতা। এতে অংশগ্রহণ করা প্রত্যেক প্রতিযোগীকে ১৭ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে সমুদ্রে ৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার সাঁতার, পাহাড়ি রাস্তায় ১৮০ কিলোমিটার সাইক্লিং এবং উঁচু-নিচু পথে ৪২ দশমিক ২ কিলোমিটার দৌড় সম্পন্ন করতে হয়েছে। ১০ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সময় সকাল ৭টায় সাঁতারের মাধ্যমে শুরু হয় এ প্রতিযোগিতা। এতে বাংলাদেশের চার তরুণের মধ্যে সবার আগে মোহাম্মদ সামছুজ্জামান আরাফাত সাঁতার, সাইক্লিং ও দৌড় শেষ করেন। তাঁর সময় লেগেছে ১১ ঘণ্টা ৩১ মিনিট ৮ সেকেন্ড। আরিফুর রহমানের সময় লেগেছে ১৩ ঘণ্টা ১২ মিনিট ২৩ সেকেন্ড। ১৩ ঘণ্টা ৪১ মিনিট ১৮ সেকেন্ড সময় নিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ সম্পন্ন করেন মিশু বিশ্বাস। শুভ দে সময় নিয়েছেন ১৫ ঘণ্টা ২৮ মিনিট ৩৪ সেকেন্ড। তবে এবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে শীর্ষস্থান অর্জন করা ডেনমার্কের লারস লমহল্ট সময় নিয়েছেন ৮ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট ২৬ সেকেন্ড। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জনকারী সুইজারল্যান্ডের ইয়ারি ক্লেইস ৯ ঘণ্টা ২ মিনিট ১৭ সেকেন্ড এবং চীনের মিয়াও হাও ৯ ঘণ্টা ৯ মিনিট ৫৯ সেকেন্ড সময় নিয়েছেন।

টানা দু’বার সফল আরাফাত

আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে টানা দু’বার সফল হয়েছেন মোহাম্মদ সামছুজ্জামান আরাফাত। প্রথমবার সফল হওয়ার পর তাঁকে নিয়ে ২০২১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর প্রচ্ছদ আয়োজন করা হয়েছিল ‘সাহস’-এর। ২০১৬ সাল থেকে আয়রনম্যান আয়োজনে অংশ নিচ্ছেন তিনি। এ পর্যন্ত পূর্ণ ও অর্ধদূরত্বের ১০টি আয়রনম্যান প্রতিযোগিতা সম্পন্ন করেছেন আরাফাত। তবে এবারের আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সফল হয়ে বাংলাদেশি হিসেবে রেকর্ড সৃষ্টি করলেন সামছুজ্জামান আরাফাত। আরাফাত দুই সপ্তাহ আগে দ্বিতীয়বারের মতো অর্ধদূরত্বের আয়রনম্যান ৭০ দশমিক ৩ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ সম্পন্ন করেছেন ফিনল্যান্ডের লাহটিতে। দুই ঘরানা মিলিয়ে চারটি আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের পদক এখন আরাফাতের ঝুলিতে।

যেভাবে শুরু আরাফাতের

একটু পেছনে ফিরে শুরুর কথা জানতে চাইলে আরাফাত বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই যে খেলাধুলা পছন্দ করতাম তা কিন্তু নয়। খেলাধুলার সঙ্গে খুব ভালোভাবে যুক্তও ছিলাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে মূলত স্পোর্টসের সঙ্গে যুক্ত হই। একসময় পর্বতারোহণকে গুরুত্ব দিতে থাকি। পর্বতারোহণের জন্য প্রশিক্ষণও নিই। এ জন্য লম্বা দূরত্বে দৌড় শুরু করি। ২০১৩ সালে আয়রনম্যান ট্রায়াথলন সম্পর্কে জানতে পারি। এর পর থেকে ধাপে ধাপে আয়রনম্যান ট্রায়াথলনের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে মালয়েশিয়া, ইউরোপ, থাইল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের আয়রনম্যানে অংশগ্রহণ করি এবং তা সফলভাবে সম্পন্ন করি। এতে তাদের দেওয়া নির্ধারিত সময়ের চেয়েও কম সময়ে ইভেন্টগুলো সম্পন্ন করি।’ ২০১৭ সালে আরাফাত দৌড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার এক হাজার কিলোমিটারের বেশি পথ। বাংলাদেশে প্রথম তরুণ হিসেবে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দৌড়ে যাওয়ার এই কৃতিত্ব একমাত্র তাঁরই। ২০১৫ সাল থেকে পরপর সাত বছরে সাতবার বাংলা চ্যানেল সাঁতার কেটে পাড়ি দিয়েছেন তিনি। আয়রনম্যান আয়োজনে প্রথম অংশ নেন ২০১৭ সালে মালয়েশিয়াতে। এরপর ২০১৯ সালে আয়রনম্যান ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে এবং একই বছর মালয়েশিয়া ও ২০২০ সালে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আয়রনম্যান ৭০.৩-এ অংশ নেন আরাফাত।

বেড়ে ওঠা ও বর্তমান ব্যস্ততা

১৯৯০ সালের ১০ জানুয়ারি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর গ্রামে আরাফাতের জন্ম। গ্রামেই তাঁর বেড়ে ওঠা। ২০০৬ সালে মাধ্যমিক পাস করে আরাফাত উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হন ঢাকা কমার্স কলেজে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মার্কেটিংয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। আরাফাতের কর্মজীবন শুরু হয় ২০১৬ সালে; এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে চাকরির মাধ্যমে। ২০১৭ সালে ৩৫তম বিসিএসের নন-ক্যাডারে সমাজসেবা অধিদপ্তরে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। এরপর ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি ব্যাংকটির উপপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।

আরিফুর রহমান, মিশু বিশ্বাস ও শুভ কুমার দের গল্প

আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে এই প্রথম সফল হলেন আরিফুর রহমান। ২০২২ সালে তিনি আয়রনম্যান মালয়েশিয়া সম্পন্ন করেন। দেশে বাংলা চ্যানেল সাঁতরে পাড়ি দেওয়ার রেকর্ড আছে তাঁর। পেশাগত জীবনে আরিফুর রহমান জনতা ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসারের দায়িত্ব পালন করছেন। আরেক প্রতিযোগী মিশু বিশ্বাস। এর আগে তিনটি আয়রনম্যান প্রতিযোগিতা সম্পন্ন করেছেন তিনি। এই প্রথম সফল হলেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে। চলতি বছরের মে মাসে মিশু বিশ্বাস ব্রাজিল আয়রনম্যান সম্পন্ন করেন। তাঁকে নিয়ে ফিচার হয়েছিল ‘সাহস’-এ। মূলত মেন্টাল স্ট্রেস থেকে মুক্তি ও শারীরিক ফিটনেস বজায় রাখার জন্য মিশু রমনা পার্কে হাঁটা শুরু করেন। এভাবেই ধীরে ধীরে শুরু হয় দৌড়। এরপর মাত্র চার মাসে সাঁতার শিখে তিনি বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেন। পাশাপাশি সাইকেলে দক্ষতা অর্জন করে আয়রনম্যান প্রতিযোগিতার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেন তিনি। মিশুর জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। এসএসসি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল, এইচএসসি নটর ডেম কলেজ, ঢাকা এবং বুয়েট থেকে নেভাল আর্কিটেকচার ও মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি করেন। ২০১৪ সালে ৩৩তম বিসিএসের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেন। বর্তমানে মিশু বিশ্বাস ডিবি রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার বা এডিসি হিসেবে কর্মরত। আরেক প্রতিযোগী শুভ কুমার দেরও এটি প্রথম বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ। শুভ ২০২২ সালে আয়রনম্যান মালয়েশিয়া সম্পন্ন করেন। এর আগে বাংলা চ্যানেলও পাড়ি দিয়েছেন একবার। পেশাগত জীবনে শুভ কুমার দে বাংলালিংকের বিপণন বিভাগের কর্মকর্তা।

আগামীর স্বপ্ন

আয়রনম্যান বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে আগামীতে আরও ভালো করার পাশাপাশি সাতবার বাংলা চ্যানেল সাঁতরে পাড়ি দেওয়া আরাফাত সামনের দিনে পাড়ি দিতে চান ইংলিশ চ্যানেলও।

এ ছাড়া খেলাধুলার মাধ্যমে সুস্থ-সবল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেন আরাফাত। সেই সঙ্গে খেলাধুলার বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের ভিত আরও মজবুত করতে চান। সেই লক্ষ্যে কাজও করে যাচ্ছেন। নিজের অফিসিয়াল দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সফল হওয়া এবং ট্রায়াথলন স্পোর্টসের মাধ্যমে সমাজে ফিটনেস সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে তরুণদের খেলাধুলায় আগ্রহী করে তুলতে চান মিশু বিশ্বাস। এতে সমাজে কমে আসবে অপরাধ। স্বপ্ন ছোঁয়া এই আয়রনম্যানদের হাত ধরে নিশ্চয়ই এগিয়ে যাবে আগামীর বাংলাদেশ!