
এ বিভাগে আইনগত সমস্যা নিয়ে পাঠকের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান
আমার বয়স ২৮ বছর। আমি মা-বাবার একমাত্র সন্তান– এমনটাই জানতাম। গত বছর বাবা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি ঢাকা থেকে আমায় ডেকে নিয়ে জানান, তারা আমার আসল মা-বাবা নন। আমার একজন পালক ভাই আছে। বয়স ২৪। তার ক্ষেত্রেও আমার মতো ঘটনা। তবে আমার ভাই যে পালক সন্তান, তা সে আগে থেকেই জানে। টাকা ও সম্পদের প্রতি তার অনেক লোভ। বিভিন্ন অজুহাতে সে অনেক টাকা নষ্ট করেছে। মা-বাবা বাড়ি ও জায়গা আমার নামে দানপত্র করে দিয়েছেন। এ কথা জানতে পেরে আমার ভাই সম্পত্তিতে ভাগের জন্য চাপ দিচ্ছে। বাবা যখন আমার জন্মপরিচয় জানান, তখন আমার ভাই সেখানে উপস্থিত ছিল। এখন সে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে চাইছে। আমার স্বামী ও শ্বশুরবাড়িতে তা জানিয়ে দেবে; পুলিশকে জানাবে বলে ভয় দেখাচ্ছে।
মা-বাবা বৃদ্ধ, অসুস্থ। সম্পত্তি না দিলে আমাদের প্রাণনাশের হুমকিও দিচ্ছে। তাকে ভবিষ্যতের জন্য আমার বাবা প্রায় ১০ কাঠা জায়গার ওপর বাড়ি করে দিতে চেয়েছিলেন। সে জন্য যে টাকা তাকে দেওয়া হয়েছে, তাও নষ্ট করেছে। এখন সে জায়গা বিক্রি করার পাঁয়তারা করছে। আমি চাই না, জায়গা বিক্রি হোক। তার সঙ্গে কোনো ঝামেলাও চাই না। এখন আমি এর কী প্রতিকার পেতে পারি?
জাকিয়া আশরাফি, জামালপুর
প্রিয় জাকিয়া
মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী পালক সন্তানরা উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি পায় না। আপনার ক্ষেত্রে জীবদ্দশায় দান করাটা জরুরি। এ ব্যাপারটি আপনার বাবা ভালো করে বোঝেন। তাই আপনাকে সম্পত্তি দান করতে চাইছেন।
পালক ভাই আপনার সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে চাইছে। আপন হোক আর পালক, দুঃখজনকভাবে এ দেশের অনেক ভাই এভাবে বোনদের তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে থাকে। এই বাস্তবতার নিরিখে নারীকে তাঁর সম্পত্তি রক্ষায় সাহায্য করার জন্য বর্তমান আইনেও সাক্ষ্য বা পদ্ধতিগত কিছু নতুন ধারা আনা হলে নারীর উপকার হতো বলে আমি মনে করি। কারণ, জনজীবন ও সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে আইনকে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।
যা-ই হোক, আপনার ক্ষেত্রে যেটি করতে হবে, তা হলো–
১. আপনার বাবা যে দলিলের মাধ্যমে আপনাকে সম্পত্তি দান করে দিয়েছেন তা যদি রেজিস্ট্রি না করা হয়ে থাকে, তাহলে অবিলম্বে তা করতে হবে।
২. এফিডেভিট করলে ভালো হবে; এই এফিডেভিটে লেখা থাকবে আপনি তাঁর পালক সন্তান, আপনি তাঁর অনেক সেবা করেছেন; তাই তিনি আপনার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য আপনাকে সম্পত্তি দান করছেন। তবে তিনি আশঙ্কা করেন, আপনার পালক ভাই আপনাকে বঞ্চিত করতে পারে, তাই জীবদ্দশায় রেজিস্টার করা দলিলের মাধ্যমে তিনি আপনাকে এই সম্পত্তি দান করছেন।
৩. আপনার বাবা আপনার ভাইয়ের বিরুদ্ধে একটি জিডি করতে পারেন। যদি তিনি না করেন, এই জিডি আপনিও করতে পারেন। অনেক সময় পুলিশের পদক্ষেপে কাজ হয়ে যায়। তা ছাড়া পরে আদালতে মামলা করতে হলে এই জিডি কাজে লাগবে।
৪. দলিল করার পরপর আপনার জমির রেকর্ড আপনার নামে মিউটেশন করে রাখলে ভালো হয়। তাহলে তৃতীয় পক্ষ ক্রেতা জানবে যে জমিটা আসলে আপনার বাবার পর আপনি পেয়েছেন, ভাই নয়।
৫. সম্পত্তির ভোগ-দখলে আপনি চলে যান; পারলে সেখানে উঠুন, বসবাস করা শুরু করুন; ভাড়াও দিয়ে রাখতে পারেন। এই ভাড়ার রসিদ আপনার কাছে জমি ভোগ-দখলের প্রমাণ হিসেবে থাকবে।
এর পরও যদি আপনার ভাই সম্পত্তি হরণ করার চেষ্টা করে, তাহলে ফৌজদারি অথবা দেওয়ানি আইনে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারেন। দেওয়ানি আইনে আপনি আদালতের কাছে নিষেধাজ্ঞা চাইতে পারেন, যেন আপনাকে আপনার সম্পত্তিতে শান্তিতে থাকতে দেওয়া হয়। ফৌজদারি আইনেও আপনি আপনার ভাইয়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারেন। আপনার সম্পত্তি বেআইনিভাবে তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করার চেষ্টা করলে আপনার বা আপনার বাবার সই নকল অথবা ভুয়া দলিলের সাহায্য আপনার ভাই নেবে। তখন অপরাধ অনুযায়ী দণ্ডবিধির ধারা বসিয়ে ফৌজদারি মামলা করতে পারবেন। আপনি ভাইয়ের বিরুদ্ধে ঝামেলায় যেতে চান না বলেছেন। কিন্তু মনে রাখবেন, জীবনটাই তো ঝামেলাপূর্ণ। নারীকে তাঁর অধিকার সম্পর্কে সোচ্চার হতে হবে। আপনার ‘ভাই’কে বুঝিয়ে দিতে হবে– নিজ সম্পত্তি রক্ষা করার মনমানসিকতা ও শক্তি দুটোই আপনার আছে।
মন্তব্য করুন