ধারাবাহিক
একদা সোভিয়েত ইউনিয়নে

সোভিয়েত ছাত্র রাজনীতির প্রতিনিধিত্বকারী দল কমসোমলের পোস্টার
হাসনাত আব্দুল হাই
প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
পর্ব : ২
তারপর তাদের মাথায় বুদ্ধি এলো, লাগেজ দুটো কেবিনে এনে উঁচু করে ধরে বলল যারা মালিক তারা যেন শনাক্ত করে, নচেৎ এয়ারপোর্টের লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড গুদামে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দু’জন ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, “আমার, আমার!” সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। হোসেন সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, “বাঙালি ছাত্রগুলো একত্র হলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। দেশে যেমন দলবেঁধে হইচই করে, জটলা বেঁধে গুলতানি করে, বিদেশে গিয়েও তাই। দেশের সম্মান, সুনাম রাখার কথা ভাবে না একটুও। রাশিয়ায় এখন অনেক ছাত্র যাচ্ছে সেদেশের স্কলারশিপ নিয়ে। বামপন্থি হলেই হলো, মেরিট বিচার করছে না, রেকর্ড দেখছে না। পার্টির সুপারিশ থাকলেই হলো। যতবার রাশিয়া যাই, দেখছি তো তাদের।” আমি বললাম, “ফেল করছে তারা? ড্রপআউট হয়ে ফিরে আসছে? তা হলে তো লজ্জার কথা।”
হোসেন সাহেব বলেন, “সবাই না, কেউ কেউ। সব ভালো ছাত্র তো যায় না ওখানে পড়তে। মনে হয়, রাশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও বিদেশি ছাত্রদের একটু নমনীয় চোখে দেখেই নম্বর দেয়।” তারপর তিনি একটু থেমে বলেন, “ছাত্রদের কেউ কেউ ছুটিতে ইউরোপ গিয়ে জিন্স, মেয়েদের নাইলন সক্স, হাই হিল জুতো, মার্লবোরো সিগারেট, রাশিয়ায় দুষ্প্রাপ্য এসব জিনিস কিনে কালোবাজারে বিক্রি করে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে আফ্রিকান ছাত্ররা ওস্তাদ, খুব বেপরোয়া তারা।”
আমরা কথা বলছি আর ঘামছি। প্লেনের এয়ারকন্ডিশনার খুব একটা কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে না। হয়তো বয়সের ভারে ক্লান্ত, অবসন্ন। আমরা গরম কাপড় পরে বসে আছি। আগস্ট মাস বাংলাদেশে গরমই। কিন্তু আমরা যে দেশে যাচ্ছি সেখানে শীত শুরু হয়ে গেছে। আমরা সেটা জেনে প্রস্তুত হয়েই যাচ্ছি। তার মাশুল দিতে হচ্ছে এখন প্লেনের ভেতর বসে। দেখলাম ছাত্ররা ওপরে এয়ারকন্ডিশনারের নব ঘোরাতে ঘোরাতে হইচই শুরু করেছে একযোগে, ডাকাডাকি করছে এয়ার হোস্টেসদের। এয়ার হোস্টেসরা মরিয়া হয়ে ঘোরাচ্ছে নব, তাদের কারও কারও গলায় তখনও ছাত্রদের দেওয়া ফুলের মালা। এখন তারা নাজেহাল হচ্ছে তাদের হাতেই। বুকে এন্ড ব্রিকব্যাট, দুটোই জুটেছে তাদের কপালে। কপাল! ছেলেদের কেউ কেউ তাদেরকে বুবুস্কা বলে সম্বোধন করছে। আমি কথাটার অর্থ জানি না। হোসেন সাহেব ব্যাখ্যা করে বললেন, “রাশিয়ান ভাষা। তারা হোস্টেসদের দাদি-নানি বলে ডাকছে। এমনিতে আদরের ডাক। কিন্তু ওরা মশকরা করছে ওদের বয়স আর বপু দেখে।”
আমি বললাম, “খুব অভদ্র তো। ওদের দেশে যাচ্ছে, সৌজন্যবোধ নেই নাকি?”
হোসেন সাহেব বললেন, “বাঙালিরা একসঙ্গে হলে সব ভুলে যায়। তখন নিজেদের ফুর্তিটাই বড় হয়ে ওঠে।”
আমি বললাম, “ওদেশে যাবার পরও এমন করে ওরা?”
হোসেন সাহেব বললেন, “সবাই হয়তো অমন করে না। কিন্তু শুনেছি অনেকেই করে একত্র হলে। এক-একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ইনস্টিটিউটে অনেক বাঙালি পড়ে তো এখন। তাদের অ্যাসোসিয়েশন আছে, দলাদলি, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ঝগড়াঝাটিও আছে। লিটল বাংলাদেশ গড়ে তুলেছে তারা রাশিয়ার ক্যাম্পাসে।”
একটু পর ঝাঁকুনি দিতে দিতে প্লেন টারমাক দিয়ে অগ্রসর হলো। ঝাঁকুনি খেয়ে হোসেন সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, “প্লেনের শক এবজর্বার নেই নাকি? পাছার হাড় ভেঙে যাবার জোগাড়!”
তার পাশে থেকে রহমান সাহেব বললেন, মনে হচ্ছে পুরোনো প্লেন। দেখছেন না ভেতরে কোনো চাকচিক্য নেই।
আমি বললাম, “শুনেছি খুব নির্ভরযোগ্য এই প্লেন। একই মডেল অনেক দিন থেকে চলছে।”
হোসেন সাহেব বিজ্ঞের মতো বললেন, “রাশিয়ায় সব যন্ত্রপাতিই তাই। মডেল বদলায় না।”
আমি বললাম, “কেন বদলাবে, যদি একই মডেল ঠিকভাবে কাজ করে? সেদেশে তো কম্পিটিশন নেই যে প্রতি বছর মডেল বদলাবে কাস্টমার আকৃষ্ট করার জন্য।”
হোসেন সাহেব বললেন, “আপনি বলেছেন এই প্রথম রাশিয়া যাচ্ছেন। কিন্তু সেখানে যাবার আগেই দেখি তাদের হয়ে কথা বলছেন।” তার স্বরে কৌতুক। তারপর বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কি ছাত্রজীবনে বাম রাজনীতি করতেন, স্যার?”
দেখলাম, তিনি এই প্রথম আমাকে স্যার বলছেন, হয়তো তার প্রশ্নের প্রচ্ছন্ন শ্লেষের ধার একটু ভোঁতা করার জন্য।
আমি বললাম, “ছাত্রজীবনে আমি কোনো দলের রাজনীতি করিনি। আমাদের সময় ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি ছিল না। থাকলেও পেছনে থেকে কাজ করত তারা। যখন ১৯৬০-এর দিকে তারা প্রকাশ্যে চলে এলো, আমি তাদের কোনোটিতে যোগ দিইনি। আমি বরাবরই স্বাধীনচেতা, বলা যায় মুক্তকচ্ছ। এখন পর্যন্ত তাই আছি। ভবিষ্যতেও এর হেরফের হবে বলে মনে হয় না। আপনি যা ভাবছেন তা সত্যি নয়। আমি মার্ক্সবাদী নই কিন্তু সমাজতন্ত্রের মূল আদর্শে বিশ্বাস করি। মার্ক্সের আগে আরও অনেকে সমাজতন্ত্রের রূপরেখা বলে গিয়েছেন। কেউ কেউ নিজের পরিমণ্ডলে তা বাস্তবে রূপ দিতেও চেয়েছেন।”
“কিছু যদি মনে না করেন, কী সেই মূল আদর্শ?”
আমি বললাম, “শোষণহীন সমাজ; যেখানে সব শ্রেণির মানুষের সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ বা ব্যবস্থা আছে।”
হোসেন সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “রাশিয়ায় তারা সেই সমাজ গড়ে তোলার মহাযজ্ঞ শুরু করেছে অক্টোবর বিল্পবের পর থেকে। কিন্তু পারছে না।”
আমি বললাম, “কী করে জানলেন?”
হোসেন সাহেব হেলান দিয়ে বললেন, “বামপন্থি নেতা হিসেবে আমি দুইবার রাশিয়া গেছি। এ নিয়ে তিনবার হবে। প্রতিবারই হতাশ হয়েছি। সেদেশে বিপ্লবের পরও শ্রেণিভেদ আছে, সেই কারণে বৈষম্যও চোখে পড়ার মতো।”
আমি বললাম, “প্রতিবার কতদিনের জন্য ছিলেন? কোথায় ছিলেন?”
হোসেন সাহেব বললেন, “সাত দিন, দশ দিন। এই এবার যেমন আমরা ৯ দিনের জন্য যাচ্ছি। আমি গিয়েছিলাম মস্কো, লেনিনগ্রাদ, কিয়েভ, তিবলিসি।”
আমি বললাম, “অল্প ক’দিনের সফরে, বিশেষ করে কন্ডাক্টেড ট্যুরে কি ভেতরের খবর পাওয়া যায়? সবই তো পাখির চোখে দেখা, বার্ডস আই ভিউ।”
হোসেন সাহেব কিছু বলতে যাচ্ছিলেন এই সময় স্থির দাঁড়িয়ে থাকা প্লেন থরথর করে কেঁপে উঠল, এমন জোরে যে মনে হলো টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়বে। বুঝলাম এখন টেক অফ করবে, তার প্রস্তুতি।
একটু পর এরোফ্লোটের টিইউ ১৫৪ ফ্লাইট আকাশে উড্ডীন হলো।
- বিষয় :
- ধারাবাহিক
- হাসনাত আব্দুল হাই