পুরোনো ফুলের গন্ধ
ফুলের গন্ধ, স্মৃতির ভার

আফসানা বেগম
প্রকাশ: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
পড়ার টেবিলে ভূগোল বইটা খোলা। ফ্যানের বাতাসে একটা পাতা বারবার ফরফর করে বাম থেকে ডানের দিকে রওনা দেয়। তাই পেপার ওয়েট হিসেবে বইয়ের কোণে একটা সাদা-কালো বেড়ালের বাচ্চাকে মাথায় আদর করে বসিয়ে রাখা। মাগরিবের নামাজ-পরবর্তী নিস্তব্ধতা চারদিকে। জানালার বাইরে সন্ধ্যা নেমে যাওয়ায় বাগানের বাতি জ্বলে উঠেছে। আর সেই আলোয় আত্মাহুতি দেবার জন্য যে পিপীলিকাদের পাখা গজিয়েছে, তারা উত্তেজিত ওড়াউড়ি আরম্ভ করেছে। মশা থেকে বাঁচতে মা জানালা বন্ধের নির্দেশ দিলেও, খোলা জানালার পাশে টেবিলের ভূগোল বইয়ের সামনে আমি উজ্জ্বল লাল নেইল পলিশের শিশি হাতে বসে আছি, পাখাওলা যে পিঁপড়াটা টেবিলে আধা সেকেন্ডের জন্য এসে বসবে তার গায়ে ঝপ করে একটা দাগ দিয়ে দেব। তারপর অপেক্ষা করব সে আবার আসে কিনা। দিনের পর দিন অপেক্ষা, প্রতি সন্ধ্যায় অধীর অপেক্ষা… রঙের পোঁচ বসানো পিঁপড়ে আর কোনোদিন ফিরে আসেনি। আসে না। হয়তো কোনোদিকে উড়ে যায়, হয়তো মরে যায়। ফিরে আসার মতো জীবন তার হাতে থাকে না।
কখনও গন্ধ পেতেও হয় না নাকে, কেবল কল্পনাই গন্ধ পাইয়ে দেয়। যখন মাকে দরকার, স্মৃতিতে তার গন্ধ অবিরাম সঙ্গ দেয়। মানুষ মূলত হ্যালুসিনেশনে বিশ্বাসী। সে যেন আমার কাছে আজও বসে আছে। চলে গেছে দিন, তবু আলো রয়ে গেছে। মানুষের কাছে পুরোনো দিনের আলো-অন্ধকার থাকে, গন্ধও থাকে। তাই মনে মনে সে চলে যেতে পারে পুরোনো সেই ফুলটির কাছে; যার গন্ধ আজও নাকে লেগে আছে। অন্যের স্মৃতিও নিজের স্মৃতি হয়ে যায় কখনও। সেই পুরোনো বাদামি হওয়া ফুলের গন্ধ কিংবা ভূতপূর্ব গন্ধের হাত ধরে। একবার নীলক্ষেত থেকে পুরোনো বইয়ের ভেজা ভেজা গন্ধ থেকে বাছাই করে এক উপন্যাস নিয়ে এলাম। মিডনাইট’স চিলড্রেন। ভারতীয় পরিবারের কুসংস্কারের বর্ণনায় যখন বুঁদ, পৃষ্ঠা ওলটাতেই মনটা বদলে গেল। মধুর এক ধাক্কার মতো দেখি চ্যাপটা হওয়া এক ফুল সেখানে ঘুমিয়ে আছে। গোলাপ। হয়তো কোনো একদিন লাল টুকটুকে রং ছিল তার। ধীরে আর খুব সাবধানে হাত ছোঁয়ালাম। পাপড়িগুলো শক্ত হয়ে একটার সঙ্গে আরেকটা প্রায় আটকে গেছে। পাপড়ির প্রান্তে লালচে রঙের রেখা, আদি গাত্রবর্ণের ছিটেফোঁটা সেখানেই আছে কেবল। লালচে প্রমাণটুকু ছাড়া বাকিটুকু বাদামি, ম্যাড়মেড়ে খয়েরি বা কালো। পৃষ্ঠার সঙ্গে লেপ্টে দু’দিকেই নিজের ছাপ ফেলেছে। তার গাঢ় ছবির নিচে বাক্যাংশ পড়াও সম্ভব না। তাই পড়া রেখে ফুলটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ছোট্ট বোঁটা দুই আঙুলে ধরে ফুলটা চোখের সামনে একবার ঘড়ির কাঁটার দিকে তো আরেকবার ঘড়ির কাটার উল্টোদিকে ঘোরালাম। পুরোনো এক রকমের বাক্সবন্দি গন্ধ নাকে লাগল। শুকনো গোলাপের পাপড়ির গন্ধ অনেকটা গোলাপজলের মতো হয়ে যায়। সেই গন্ধে পোলাও বা ফিরনি খাওয়ার ইচ্ছে জাগে। খানিকক্ষণ দেখার পরে মাথায় কল্পনা সাজাতে থাকি, হয়তো কেউ তার নিজের টবের গাছে ফোটা অতি আদরের প্রথম বা একমাত্র গোলাপটিকে অতি যত্নে পড়তে থাকা উপন্যাসের মধ্যে গুঁজে রেখেছে। শুধু নিজের গাছের ভাবছি কেন, হতে পারে প্রিয় কেউ গোলাপটা তাকে দিয়েছে। সে ফেলতে পারেনি, বইয়ে গুঁজে রেখেছে। ফেলতে পারেনি কারণ, যে দিয়েছে সে এমন কেউ যে একটা গালি দিলেও ফেলা যায় না, উপহারের ফুল তো দূরের কথা। আর তোড়া না দিয়ে একটা মাত্র ফুল কেউ কখনও কাউকে দেয়? তাও আবার লাল রঙের। কিন্তু সে কই, তারপর সে কি তার হলো নাকি হারিয়ে গেল? পুরোনো ফুলটাকে নাকের কাছে নিয়ে এই তথ্য জানার কৌতূহলের কাছে নিজেকে নিরুপায় লাগে। ফুলসমেত বইটা যখন পুরোনো এক গাদা খবরের কাগজের সঙ্গে ফেরিওলার ঝুড়িতে উঠেছেই, তবে কি একদিন যার এত মূল্য ছিল জীবনে, তার স্পর্শলাগা স্মৃতিময় ফুলটাকে ঠিকানাবিহীন বিসর্জন দেওয়া অত সহজ ছিল? কিংবা তার আর কোনো মূল্য ছিল না জীবনে? কৌতূহলে পাতা উলটাই। শেষ পাতায় ওপরের দিকে ছোট অক্ষরে নাম লেখা, চঞ্চল। এই বইয়ের মালিক তবে চঞ্চল। ফুলটা নিশ্চয় চঞ্চলকে কেউ দিয়েছিল? সামনের দিকের পাতায় যাই, উৎসর্গের পরের পাতায় ছোট্ট করে লেখা, ‘তোমাকে’। এত তাড়া ছিল, একটা শব্দের বেশি লেখা যায়নি? নাকি প্রেরক-প্রাপক গোপন রাখার কায়দা! এই তুমিটা কি চঞ্চল, নাকি সে-ই অন্য কাউকে দিয়েছে? হতে পারে চঞ্চল বইয়ে ফুল সযত্নে রেখে অন্য কাউকে দিয়েছে, হতে পারে চঞ্চলকেই কেউ ফুলসহ দিয়েছে, আবার হতে পারে… অনেক কিছুই হতে পারে। ফুলটা নাকের কাছে ধরে তার আদি চেহারার কথা ভাবতে থাকি। প্রস্ফুটিত, বাতাসে দোল খাওয়া, হাসি হাসি আনন্দমাখা… আচ্ছা, কেবল নেতিবাচক ভাবনাই এলো কেন মাথায়? এমনও তো হতে পারে যে তুমিটাকে বইটা দেওয়া হয়েছিল সে চঞ্চল বা অন্য কেউ, তারা একজন আরেকজনকে পেয়ে গেছে। একসঙ্গেই এখন তারা সংসারের বন্ধনে আবদ্ধ, ছোট-বড় গোটা দুই-তিনেক সন্তানও আছে তাদের। সংসারের সুখ আর জটিলতা নিয়ে তাদের জীবন সকাল থেকে রাত ঘুরপাক খাচ্ছে। এটাই যদি ইতিবাচক ভাবনা হয়, তা না হয় হলো, কিন্তু একটা মানুষকে দিন-রাত কাছে পাওয়ার পরে পনেরো কি বিশ বছর আগে তার দেওয়া বই আর বইয়ের পাতার ভেতরে শুকানো চ্যাপ্টা ফুলের আর কতটা মূল্য থাকে? ফসিলের মতো প্রেম-কাতরতার দিনগুলোর স্মৃতি বহনকারী ফুলটা দৈনন্দিন ব্যস্ত জীবনে কি বাহুল্য হয়ে ওঠে না? অন্যদিকে একটি একটি করে দিন এগোতে এগোতে কত কত স্মৃতি জমে, জীবন হয়ে দাঁড়ায় স্মৃতির জাদুঘর। এই জাদুঘর বয়ে চলাও হয়তো কখনও ঝক্কি। জীবনের গতিময়তার কাছে কোনো কিছুর গুরুত্ব চিরকাল থাকে না। সে হোক শুকনো ফুল বা বয়সী মানুষ। একদিন যে শুকনো ফুলটি হাতের মুঠোয় নিয়ে চোখ বুজে আবেগে ভাসা যেত, কখনও একাকিত্বে পৃষ্ঠা উল্টে গোপনে তাকে একনজর দেখে স্মৃতির সাগরে ডুব দিয়ে আসা যেত, বহমান জীবনের নানা উত্তেজনার কাছে সেই আবেগ হেরে যায় একসময়। নিত্যনতুন বাণিজ্যের কারণে এখন ভার্নিশে মোড়া পুরোনো ফুল মেলে, ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখা যায় বাড়িতে। সেই ফুলে পুরোনো গন্ধ লেগে থাকা না। তাই সে ফুল সৌন্দর্য বাড়ায়, স্মৃতিকাতরতা বয়ে আনে না। আজকাল তাজা ফুলের ক্ষেত্রেও প্রায় তাই– জিনগত প্রযুক্তির গবেষণা তাকে দেখনসুন্দর আর দীর্ঘসময় ফুলদানিতে তাজা রাখার পদ্ধতি আবিষ্কার করছে, কিন্তু গন্ধ নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। ফুলে গন্ধ নেই সে তো ভাবতেও পারি না… একসময়ের জরুরি অনেক কিছু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাওয়াই নিয়তি।
- বিষয় :
- পুরোনো ফুলের গন্ধ
- আফসানা বেগম