শতবর্ষী গ্রামীণ হাট

চলনবিল অঞ্চলের নওগাঁ হাট
প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
গ্রামীণ হাটের টাটকা মাছ, সবজির দোকানে ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়, বস্তাভর্তি ধান, গম বা সরিষার সারি পেরিয়ে হাটের মধ্যখানে গোল হয়ে বসে সাপ খেলা দেখা, তাবিজ-কবজ বিক্রির দৃশ্য। সেই সঙ্গে সুর তুলে হাটের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে কয়েকজন ফেরিওয়ালার বিষ-বেদনার মলম, দাঁতের মাজন, ইঁদুর-ছারপোকার বিষ বিক্রির দৃশ্য তো রয়েছেই। পাশাপাশি ডালপালা ছড়ানো হাটের বিশাল বড় বট-পাইকড়ের গাছের তলায় কাঠের টুলে বসে নরসুন্দরের দুই হাঁটুর কেপচিতে মাথা আটকিয়ে চুল কাটার মধুর কষ্ট এখনও কাউকে না কাউকে মনের অজান্তেই হাসায়।
সরকারি তালিকা অনুসারে, তাড়াশে অন্তত ২৭টি ছোট-বড় হাট রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি শতবর্ষী। করতোয়া নদীর কূলঘেঁষা নওগাঁ গ্রামে অবস্থিত নওগাঁ হাট, বারুহাঁস হাট, বড় দীঘির পাড়ের উলিপুর হাট, বিনসাড়া হাট, উত্তর তাড়াশের গুল্টাহাট অন্যতম। একেকটি হাটে সারি করা শনের দোচালা ছোট ছোট বেড়া ছাড়া ঘর, মাঝে প্রকাণ্ড বট বা পাইকড় গাছের নিচে পসরা বসিয়ে দোকানিদের বেচাকেনার চিরায়িত বাংলার গ্রামীণ হাটের এ দৃশ্য তাড়াশের প্রাচীন হাটগুলোয় এখনও কিছুটা হলেও দেখা যায়।
এখনও তাড়াশের হাট এ জনপদের মানুষের কাছে গুরুত্ব বহন করে। কারণ ৬০ থেকে ৮০, এমনকি নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলনবিলের পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, নাটোরের গুরুদাসপুর, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া এবং তাড়াশ এলাকায় ধান, পাট, গম, সরিষার মতো বিবিধ ফসল বেচাকেনায় নৌপথকেন্দ্রিক বেশ কয়েকটি নৌ-বন্দরকেন্দ্রিক প্রসিদ্ধ ব্যবসাস্থল। যেমন উল্লাপাড়ার ঝিঁকড়া, তাড়াশের নওগাঁ, চাটমোহরের হান্ডিয়াল বা হাড়িয়াল বন্দর প্রাচীনকালেই গড়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় চলনবিল অধ্যুষিত সিরাজগঞ্জের তাড়াশে নওগাঁ, বারুহাঁস, উলিপুর বিনসাড়া, গুল্টাহাটের মতো গ্রামীণ হাটগুলো একুশ শতকে এসেও কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক চাকা সচল, সরকারি রাজস্ব আদায়সহ জনকল্যাণে এলাকায় বিশেষ অবদান রাখছে।
সম্প্রতি প্রায় প্রতিটি সাপ্তাহিক হাটের জায়গা বিভিন্নভাবে দখলের কারণে প্রাচীন হাটের জায়গা সংকুচিত হয়ে এসেছে। এসব জায়গা দখল করে অনেক স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ হয়েছে। সাপ্তাহিক এ হাটগুলোর জৌলুস ফিকে হয়ে আসছে। তারপরও ইতিহাস-ঐতিহ্য আর অর্থনৈতিক অবদান বিচারে আজও গ্রামীণ হাটের প্রতি গ্রামের মানুষের টান রয়েই গেছে।
বারুহাঁস হাট প্রতিষ্ঠার সঠিক দিন-তারিখ জানা যায় না। তবে অধ্যক্ষ আব্দুল হামিদ সম্পাদিত ‘চলনবিলের ইতিকথা’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, তাড়াশের বারুহাঁস গ্রামে প্রায় ৪০০ বছর আগে মোগল আমলে তিনটি ইমামবাড়া নির্মিত হয়। এ কারণে তখন থেকেই স্থানটি প্রসিদ্ধ হয়। সমাগম হতে থাকে অনেক লোকজন। এ গ্রামে এখনও একটি ইমামবাড়ার ভগ্নাংশ বিদ্যমান রয়েছে। ১৮ শতকের শেষের দিকে এখানে সোম ও শুক্রবার সাপ্তাহিক হাট বসান; যা এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যে ওই সময় জৌলুসপূর্ণ হয়ে ওঠে।
বর্তমান হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কের তাড়াশের মহিষলুটি থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দক্ষিণে নওগাঁ গ্রামে করতোয়া নদীর তীরে নওগাঁ হাটের অবস্থান। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৫২৬ সালে গৌড়াধিপতি সুলতান নসরত শাহের রাজত্বকালে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এরপর থেকে নওগাঁ এলাকায় জনবসতি বেড়েছে, সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যও। করতোয়া বিধৌত নওগাঁ গ্রামটির আয়তনও অনেক বড়। তাই প্রাচীনকালে মানুষের প্রয়োজনেই হাটটি গড়ে ওঠে। বিরাট এলাকাজুড়ে সপ্তাহে প্রতি বৃহস্পতিবার হাট বসে। হাটটি ধান, পাট, গম, সরিষার মতো মৌসুমি ফসল কেনাবেচার জন্য প্রসিদ্ধ। মূলত তাড়াশ পার্শ্ববর্তী উল্লাপাড়া, সীমান্তে থাকা পাবনার ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর এবং নাটোর জেলার গুরুদাসপুর উপজেলার শতাধিক গ্রামের মানুষ তাদের প্রয়োজনে নওগাঁ হাটে আসে। এ হাটে সব ধরনের বাঁশ-কাঠের আসবাব, হরেক রকম মৃৎপাত্র, বাঁশ-বেতের তৈরি কুলা, চালুন, খৈ-চালা, খালই, টুপরি, টোপা, সরবেশ, পলোসহ হরেক রকমের সাজসজ্জার গৃহস্থালি জিনিস। এ ছাড়া পাওয়া যায় বড় মাছ, মাংস, দই, ঝুড়ি, মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা, কদমা। আরও পাওয়া যায় গোটা হলুদ, মরিচ, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য।
বিনসাড়া হাট তাড়াশের অন্যতম প্রসিদ্ধ হাট। প্রতি সপ্তাহের রোববার এবং বুধবার বসে। মূলত দেশভাগের সময়ে এ হাটটির যাত্রা শুরু হয়। প্রায় শতবর্ষী হাটটি এলাকার মানুষের প্রয়োজনে এক সময় জৌলুসপূর্ণ হাটে রূপ নিয়েছিল। বড় আকারের চারটি বট গাছের তলায় হরেক রকম ক্রেতা-বিক্রেতার অবস্থান। এখনও আগের মতোই নানা কৃষিপণ্য বিক্রি হয়। তবে আগে নৌকা, গরু বা মহিষের গাড়িতে করে কৃষক হাটে তাদের কৃষিপণ্য আনলেও এখন বিনসাড়া হাটের চারদিকে পাকা সড়ক নির্মিত হওয়ায় জনদুর্ভোগ আর নেই। ইতোমধ্যে হাটের অনেক জায়গা দখল হয়েছে। হাটের সরকারি জায়গায় স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ, হাটের পাশের খাল দখল ইত্যাদি কারণে বিনসাড়া হাটটি অতীতের সৌন্দর্য হারিয়ে এখন ছোট শহরের আকার ধারণ করেছে।
- বিষয় :
- গ্রামীণ হাট
- শতবর্ষী হাট