উৎপাদন চলছে, নির্মাণ হচ্ছে নতুন কারখানা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের মিরসরাই অংশে নির্মাণাধীন ও উৎপাদনে থাকা কয়েকটি কারখানা -ছবি : সমকাল
প্রকাশ: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০
কয়েক বছর আগেও অধিকাংশ এলাকা থাকত সাগর থেকে আসা নোনাজলের নিচে। কিছু অংশে পানি না থাকলেও অতি লবণাক্ততার কারণে ফসল ফলত না। তাই কয়েক হাজার একর এলাকার কিছু জায়গায় শুধু মাছ চাষ হতো। শুষ্ক মৌসুমে ছিল গবাদি পশুর বিচরণক্ষেত্র। সময়ের ব্যবধানে সেই অঞ্চলটিই এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চলে রূপ নিয়েছে। বলছি বঙ্গোপসাগরের তীরঘেঁষে অবস্থিত চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড উপজেলা এবং ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় গড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের কথা।
একসময় পাঁচ হাজার একর জমি ঘিরে বাংলাদেশের প্রথম অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা শিল্পাঞ্চলটি এখন ৩৩ হাজার ৮০০ একরের প্রথম পরিকল্পিত শিল্পনগর, যার একটি বড় অংশ গড়ে উঠেছে সাগর থেকে জেগে ওঠা জমিতে। এরই মধ্যে এখানে শিল্পকারখানা স্থাপন করে বাণিজ্যিক উৎপাদনে গেছে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। শিগগিরই উৎপাদন যাচ্ছে আরও ২২ প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া অনেক শিল্পকারখানা স্থাপনের প্রক্রিয়া বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে। সম্প্রতি শিল্পনগরটি সরেজমিন ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে।
শিল্পনগরটিতে চার একরজুড়ে প্রিকাস্ট হাই-পারফরম্যান্স কংক্রিট (পিএইচসি) পাইল উৎপাদনের কারখানা স্থাপন করেছে টিকে গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান সামুদা কনস্ট্রাকশন। বিনিয়োগ করা হয়েছে ৯১ লাখ ৬১ হাজার ডলার। সেখানে মোট কর্মসংস্থান হবে ২৭৫ জনের। বর্তমানে কাজ করছেন ১৫০ জন। প্রতিষ্ঠানটি গত বছরের ২৮ আগস্ট বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে।
কারখানাটি পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, সেমি অটোম্যাটিক পদ্ধতিতে পুরোদমে পিএইচসি পাইল উৎপাদন কার্যক্রম চলছে। প্রতি বছর ৩ লাখ ২৪ হাজার পিস পাইল উৎপাদন করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তাদের। কারখানার কর্মীরা বলেন, বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাইলিং করে সেখানেই রড, সিমেন্ট, বালু, খোয়া ও অন্যান্য উপাদান দিয়ে পাইল নির্মাণকাজ শেষ করা হয়। এ ক্ষেত্রে পাইল নির্মাণকাজটি মাটির নিচে সম্পন্ন হওয়ায় যথাযথ মান নিশ্চিত নিয়ে সংশয় থাকে। তাই উন্নত বিশ্বে কারখানায় পিএইচসি পাইল উৎপাদন করে যন্ত্রের মাধ্যমে তা নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করা হয়। এর যথাযথ মানও নিশ্চিত করা যায়।
জানা গেছে, ১৯৭০-এর দশকে পিএইচসি পাইল প্রথম উদ্ভাবন করা হয় জাপানে। এটি যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইতালি, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশেও বড় বড় স্থাপনায় ব্যবহারের জন্য আমদানি হচ্ছে। উচ্চ ভবন কিংবা ব্রিজ, গভীর সমুদ্রবন্দরে জেটি নির্মাণসহ অন্যান্য বড় স্থাপনাতেও এ ধরনের পাইল প্রয়োজন হয়।
এ প্রসঙ্গে টিকে গ্রুপের পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রায় ১০ বছর আগে ব্রিজ বা বহুতল ভবন ধরে রাখার জন্য রিইনফোর্সড লোহার খাঁচা ব্যবহার করা হলেও এখন কারখানায় তৈরি পিএইচসি পাইল ব্যবহার করা হয়। এর ব্যবহার প্রতিদিন বাড়ছে, কারণ এটির ব্যবহার টেকসই অবকাঠামো নিশ্চিত করে। একই সঙ্গে খরচও কম। বর্তমানে তাদের কারখানায় প্রতিদিন ৯, ১০ ও ১২ মিটার লম্বা বিভিন্ন আকারের ৪০০ পিস পাইল তৈরি হচ্ছে।
তিনি বলেন, চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ করপোরেশনসহ কিছু কোম্পানির কাছে ২৫ হাজার পিস পাইল বিক্রি করেছেন তারা। করপোরেশনটি বাংলাদেশের কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। পাশাপাশি তারা নিজস্ব অবকাঠামো তৈরিতেও এ পাইল ব্যবহার করছেন।
তিনি বলেন, কারখানায় তৈরি পিএইচসি পাইলে খরচ কম। প্রচলিত পদ্ধতিতে পাইলিং কার্যক্রমে দিনে হয়তো দুই থেকে তিনটি করা সম্ভব। এতে শ্রমিক ব্যয় বেড়ে যায়। কিন্তু কারখানার পাইল ব্যবহার করা হলে এক দিনে ২০০টি পর্যন্ত পাইলিং কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব। এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করলে পিএইচসি পাইল ব্যবহারে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ খরচ কম হবে বলে দাবি করেন তিনি।
এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের মিরসরাই অংশে প্রসাধনসামগ্রী ও পিইটি বোতল উৎপাদনে কারখানা স্থাপন করেছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ম্যারিকো বাংলাদেশ। তাদের কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, ম্যারিকোর ভ্যালু অ্যাডেড হেয়ার অয়েলের পণ্য উৎপাদন শুরু হয়েছে। ১০ একর জমিতে গড়ে ওঠা কারখানাটি বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানিটির তৃতীয় কারখানা।
ম্যারিকো বাংলাদেশের পরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) রাশেদ বিন এহশান বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে তারা ভ্যালু অ্যাডেড হেয়ার অয়েলের পণ্য উৎপাদন করছেন। এজন্য ২২০ কোটি টাকার বিশাল বিনিয়োগ নিয়ে বিভিন্ন ধাপে ব্যয়ের পরিকল্পনা রয়েছে ম্যারিকোর। ইউনিটটির মাধ্যমে স্থানীয়দের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হয়েছে।
এদিকে আগামী নভেম্বরের মধ্যে ম্যান মেইড ফাইবারের (এমএমএফ) কাঁচামাল উৎপাদনে যাচ্ছে চট্টগ্রামভিত্তিক টিকে গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মডার্ন সিনটেক্স লিমিটেড। প্রথমবারের মতো তারা পলিয়েস্টার স্টেপল ফাইবার (পিএসএফ) এবং পলিথিন টেরেফথালেট (পেট) চিপস– এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল উৎপাদন করবে। এ জন্য ১ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে মডার্ন সিনটেক্স লিমিটেড নামের একটি কারখানা স্থাপনের কাজ শেষ পর্যায়ে।
মডার্ন সিনটেক্সের জেনারেল ম্যানেজার সফল বড়ুয়া জানান, আগামী নভেম্বর থেকে তারা উৎপাদন শুরু করবেন। বাজারে অন্য যারা একই পণ্য উৎপাদন করে তারা সবাই মিলে আগামী বছরের শুরু থেকে চাহিদার প্রায় অর্ধেক পূরণ করতে পারবে। এর ফলে বাংলাদেশের বছরে প্রায় ৬৫ মিলিয়ন ডলারের মতো সাশ্রয় হবে। এটি দেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করবে।
মডার্ন সিনটেক্সের কর্মকর্তারা জানান, তারা গ্যাস সংযোগ পেয়েছেন। তবে উৎপাদন কাজের জন্য ভবিষ্যতে পানির নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ পাবেন কিনা, তা এখনও বলতে পারছেন না তারা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের প্রকল্প পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ফারুক সমকালকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটির গ্যাসের সমস্যা সমাধান করা হয়েছে। কিন্তু খুব বেশি পানির প্রয়োজন হবে– এমন চাহিদার কথা জানানো হয়নি। প্রয়োজন অনুসারে সরবরাহের ব্যবস্থা বর্তমানে রয়েছে। ভবিষ্যতেও অসুবিধা হবে না।
বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরিতে চট্টগ্রামের মিরসরাই অংশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে ১০০ একর জমির ওপর কারখানা স্থাপন করছে বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। কারখানাটি তৈরিতে ১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কারখানার অবকাঠামো নির্মাণের কাজ জোরেশোরে চলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরের শেষ নাগাদ পরীক্ষামূলক বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদন শুরু করতে চানা তারা। একই সঙ্গে আগামী বছরের মাঝামাঝি পর্যায়ে বৈদ্যুতিক গাড়ি বাজারে ছাড়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড মূলত ম্যাঙ্গো টেলিসার্ভিসেসের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান প্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ী এ মান্নান খান। তিনি বলেন, ৩০ বছর ধরে প্রযুক্তি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। সারা বিশ্বে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনে এগিয়ে আছে। এ জন্য আমরা এই ব্যবসায় যুক্ত হয়েছি। দেশেই দূষণমুক্ত গাড়ি উৎপাদন এখন সময়ের দাবি। পুরোনো অটোমোবাইল খাত ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে। পরিবেশের কথা বিবেচনায় এর জায়গা নিচ্ছে বৈদ্যুতিক গাড়ি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজে তৈরি হবে গাড়ির মূল কাঠামো (বডি)। এতে সেডান কার, এসইউভি (স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকল), মাইক্রোবাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও বাসের মূল কাঠামো তৈরি করা হবে। এই কারখানা করতে খরচ হচ্ছে ৫৫০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ লিথিয়াম ব্যাটারি লিমিটেড নামের কারখানায় তৈরি হবে লিথিয়াম ব্যাটারি। এই কারখানাও বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজের। কারখানাটিতে তৈরি ব্যাটারি ২, ৩ ও ৪ চাকার বৈদ্যুতিক গাড়িতে ব্যবহার করা যাবে। পাশাপাশি সোলার, ডেটা সেন্টার, ইউপিএস, বিটিএসসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসব ব্যাটারি ব্যবহার করা যাবে। এই কারখানা তৈরিতে খরচ হচ্ছে ৭৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ম্যাঙ্গো টেকনোলজিস লিমিটেড নামের অন্য কারখানায় তৈরি হবে মোটর, মোটর নিয়ন্ত্রণ ও চার্জিংয়ের ব্যবস্থা। এ কারখানা তৈরিতে খরচ হবে ১৪০ কোটি টাকা।
এ মান্নান খান আরও জানান, বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ যে বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরি করবে, তা হবে বাংলাদেশের নিজস্ব ব্র্যান্ডের। এতে এক বছরে দুই চাকার ৬০ হাজার, তিন চাকার ৪০ হাজার ও চার চাকার ৩০ হাজার গাড়ি উৎপাদন করা যাবে। কর্মসংস্থান হবে দেড় হাজার মানুষের। পরে প্রকল্পের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়লে পাঁচ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) জানিয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের জমি পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর কারখানা পুরোপুরি চালু হলে ১৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে। একই সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত পণ্য দেশের চাহিদা মেটানোর পর রপ্তানি করে প্রতি বছর প্রায় ২৫ বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের প্রকল্প পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ ফারুক সমকালকে বলেন, এরই মধ্যে যারা কারখানা স্থাপন করেছে তাদের বিদ্যুৎ-গ্যাস ও অন্যান্য সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পুরো শিল্পনগরে গ্যাস সরবরাহ এবং সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ নিশ্চিতে আলাদা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। আগামী দুই বছরের মধ্যে এসব কাজ সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
- বিষয় :
- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর