ঢাকা বুধবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৩

উপকূলে শিশুশ্রমের অভিশাপ

উপকূলে শিশুশ্রমের অভিশাপ

ছবি: ফারহান হোসেন

প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১৮:০০

যখন কোমলমতি শিশুর হাতে থাকার কথা বই, তখন তাদের কাঁধে ওঠে সংসারের বোঝা। ওদের কানে পৌঁছায় না স্কুলের ঘণ্টাধ্বনি। যে বয়সে কাঁধে থাকবে স্কুল ব্যাগ, সে বয়সে ওরা মাথায় বহন করে মাছের ঝুড়ি। কার্যত শিশুশ্রমের বেড়াজালে কাটছে উপকূলীয় অঞ্চলের হাজারো শিশুর জীবন। উপকূলীয় জেলা পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলাসহ বিভিন্ন এলাকার জেলে পরিবারের অসংখ্য শিশুর দিন কাটে এভাবে। আনন্দ-বিনোদন তো দূরের কথা, প্রয়োজনীয় বিশ্রামের সুযোগ নেই তাদের।

 পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার মাছুয়াসহ অনেক মৎস্যকেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, যেসব শিশুর যাওয়ার কথা ছিল বিদ্যালয়ে, তারাই বড়দের সঙ্গে কাজ করছে পুরোমাত্রায়। কেউ সাগর থেকে আসা ট্রলারের ভেতর থেকে মাছ তুলছে, আবার কেউ সেই মাছের দর হাঁকাচ্ছে বিক্রির উদ্দেশ্যে। সেখানে কাজ করা শিশুদের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। ১৪ বছর বয়সী জুয়েল মাছ ধরার কাজ করে। ১০ বছর বয়স থেকেই হাড়ভাঙা খাটুনি তার নিত্যদিনের সঙ্গী। আরেক শিশুশ্রমিক নাঈমের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সে। শুধু জুয়েল ও নাঈম নয়, দারিদ্র্যের বেড়াজালে এভাবে হাজারো শিশুর শৈশব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলে। মোশারফ হোসেনের বাড়ি উপকূলের সংরাইল এলাকায়। বহুদিন অন্যের নৌকায় কাজ করেছেন; এবার নিজেই গড়েছেন জাল-নৌকা। স্কুলে যাওয়ার বয়সী ছেলেকে এখন তাঁর আরও বেশি প্রয়োজন নৌকায়। জাল-নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে গেলে নৌকার গলুইয়ে বৈঠা ধরে বসে থাকার দায়িত্বটা পালন করতে হবে তাঁর ছেলেকে। মোশারফ কখনোই ভাবতে পারেননি ছেলেকে স্কুলে পাঠানোর কথা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার বলেশ্বর নদীসংলগ্ন চরখালি, মাছুয়া, হোগোলপাতি, মাঝেরচর, খেতাচিড়া, কচুবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকার বেশির ভাগ শিশু মাছ শিকারে নিয়োজিত থাকে। ওই এলাকার ছেলেমেয়েদের খুব একটা পড়াশোনার সুযোগ হয় না। বেশ কয়েকজন অভিভাবক জানান, নদীতে না গেলে জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। ছেলেমেয়ে স্কুলে পাঠালে আয় কমে যাবে। পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য শিশুদের অল্প বয়সেই কাজে নামাতে হয়।

উপকূলের প্রান্তিক জনপদের নৌকা বা ট্রলারে কর্মরত বেশির ভাগ শিশু বাবা, চাচা বা বড় ভাইয়ের সঙ্গে মাছ ধরতে যায়। বাবা হাটে মাছ বিক্রি করতে গেলে উত্তাল নদীতে শিশুরাই নৌকার হাল ধরে বা মাছ ধরে। আবার কেউ কেউ সস্তায় শ্রম বিক্রি করে। সরকারের পক্ষ থেকে উপবৃত্তির টাকা, বিনা মূল্যের বই ওদের জন্যও বরাদ্দ থাকে। অনেকে এসব অনুদান নিয়েও পরিবারের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে কাজে নামে। স্কুলের হাজিরা খাতায় নাম থাকলেও দিন কাটে নদীর বুকে।

জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী ১৯১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ১৯৯০ সালের আগস্টে স্বাক্ষর করলেও ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর সাধারণ পরিষদে গৃহীত হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশ এই সনদ গ্রহণ করে। আগের তুলনায় শহর এলাকায় শিশুশ্রম কিছুটা কমলেও উপকূলের চরাঞ্চল ও জেলেপল্লিতে এর মাত্রা অত্যধিক। শিশুদের সুরক্ষায় ১৯৭৪ সালের শিশু আইন সংশোধন করে ২০১৩ সালের ১৬ জুন সংসদে ‘শিশু আইন-২০১৩’ পাস হয়। শিশু আইন ছাড়াও শিশু অধিকার রক্ষায় সরকারের অসংখ্য আইন ও প্রকল্প রয়েছে। এগুলোর মধ্যে জাতীয় শিশু নীতিমালা-২০১১, জাতীয় শিক্ষা নীতিমালা-২০১০ এবং জাতীয় শিশুশ্রম নিরোধ নীতিমালা-২০১০ অন্যতম। এত আইন, নীতিমালা সত্ত্বেও উপকূলে শিশুশ্রম কমছে না।

মঠবাড়িয়া উপজেলার সমাজ উন্নয়ন কর্মকর্তা এমাদুল হক খান বলেন, ‘শিশুশ্রম প্রতিরোধে সরকার ও বিভিন্ন উন্নয়ন সংগঠন নানামুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। তবে উপকূলীয় অঞ্চলে শিশুশ্রমের মাত্রা একটু বেশি, এর কারণ হচ্ছে এখানে অভাবী মানুষের হার বেশি। যার ফলে শিশুরা লেখাপড়া ছেড়ে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নেমে পড়ছে।’

শিশু সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা স্থানীয় সংগঠন হাতেখড়ি ফাউন্ডেশনের সভাপতি সজীব মিত্র বলেন, ‘আমরা মাঠ পর্যায়ে গিয়ে কাজ করি, সেখানে যেটা দেখতে পাই অর্থ সংকটের সময় অনেক পরিবারই খাদ্য জোগানের জন্য শিশুদেরও কাজে লাগিয়ে দেয়। তাদের স্কুলমুখী করতে এখনই সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।’

আরও পড়ুন