নলেন গুড়ের সুবাস
ছবি এঁকেছেন ফাইয়াজ হোসেন
গল্প লিখেছেন দিলারা মেসবাহ
প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫০
আকাশ ছোঁয়া হিমালয় ডিঙিয়ে উত্তরা বাতাস বইছে গোটা বাংলায়। বিশেষ করে উত্তরের জনপদে। গৃহস্তের ঘরে নতুন দিন, একটুখানি সুখের খবর।
শহুরে মহুয়া এসেছে পঞ্চকোশি গাঁয়ের মামাবাড়ি। নলেন গুড়ের টানে। মামা সুরুজ মৃধা দিলদরাজ মানুষ। খুশিতে আটখানা। ‘ভাগ্নি আসচে আমার, মেলা খুশি। পরামানিকের মোকাম থেকা নলেনগুড়ের আস্ত ভাড় আনবোনে। দেখিস মহু।’
মতিজান মামি পাকঘরে মাটির খোলা, ডেকচি সাজাতে মহাব্যস্ত। পুলি-পিঠা, দুধচিতুই হবে। নলেন গুড়ের পায়েস হবেই হবে। কাকপক্ষী জাগেনি। মিহি কুয়াশা শিমের বেগুনি ফুলের গায়ে। মামার হল্লা, ‘মহু, দেখ কাঁচা খেজুর রসের ঠিলা আনছি।’
মতিজান এখন জ্বাল দিতে উনুনে বসাবেন। পঞ্চকোশি গাঁয়ের মানুষ জনের অনেকে জানে, বাদুড় মুখ দেওয়া কাঁচা রস খেলে নিপা ভাইরাস হয়। সর্বনাশা। মরণ হয়! গত বছর সলপের মিন্তু মাঝির মরণ হলো।
মীর চাচা সারা সন্ধ্যা খেজুরে গুড়, নলেন গুড়ের রূপকথা শোনালেন। এতো সুন্দর গোছমিছিল করে গল্প করেন চাচা! মহুয়ার মনে আনন্দ ধরে না। মৌরি গুঁড়া মাখানো মুড়ির মোয়া মুঠোয়।
‘জানিস মা ভারতবর্ষে বহুবছর আগে থেকে নলেন গুড়ের কদর ছিলো। গবেষকরা বলেন। পুরোনো অভিধানে ‘ণরকু’ শব্দটা পাওয়া
যায়। এর অর্থ কাটা।
গ্রামের নাপিতের ভাত কাপড়ের জোগান দেয় নরুন। নরুন দিয়ে চুল, দাঁড়ি, কাটার কাজটি চলে। শব্দের শিকড়সমেত টান দিলে কতো যে মজার মজার বিষয় জানা যায়!
খেজুর গাছের ছাল কেটে কেটেই তো মিঠা রস পাওয়া যায়।
নলেন গুড় হয়। নবান্নের দিন, পিঠা পঞ্চকোশী সড়কের দুই পাশে ঝাকড়া চুলের খেজুর গাছের সারি।
কোনো কোনো গাছে গাছি ভায়েরা গাছের ছাল বাকল কাটছে খুব যত্নে আর কৌশলে। দারুণ সব কায়দা কানুন। বাঁশের চোখা নলি বা নল বসানো হয়েছে। রাতভর টুপটাপ রসের ফোঁটা ঝরবে মাটির হাঁড়ির পেটের ভিতর। কতো রকমের গুড় যে হয় বাংলাদেশে। চাচা বলেন রসিয়ে রসিয়ে। যেন গুড়ের মেলা নবান্নের দিনে।
‘গুড় হয় পাটালি, দানা, ঝোলা, ভেলি, চিটা, হাজারী, নলেন বুঝেছিস মহুয়া। এটাও জেনে রাখিস নল, কলসি চুন দিয়ে সাফ করে গাছিরা। দড়াগাছা, লম্বা হাঁসুলি কাত্তিকের শুরু থেকে গোছগাছ করতে হয়। রস নামানো, জ্বাল দেওয়া কতো নিখুঁত শিল্প যে মা।’
রুমকিদের উঠোনে রস জ্বাল দেওয়া হচ্ছে, সুবাস নেচে বেড়াচ্ছে মাতোয়ারা বাতাসে। মামা বড়ো এক বোয়াল মাছ এনেছেন। থলে
থেকে লেজ বেরিয়ে আছে। উঁকি দিচ্ছে শর্ষে শাক, লাউ শাকের ডগা।
মোড়া টেনে পাকঘরের দাওয়ায় বসলেন। তাঁরও বেশ কয়েকটা খেজুর গাছ আছে। মধু গাছি সেগুলোর রস নামায়। মামা কলরব করে কথা বলেন, “মহু গুড়ের গল্প শোন, বলি তোকে, টানা তিন দিন রস নিঙড়ে নেওয়ার পর বেচারি রোগাসোগা গাছটাকে একটু জিরান বা বিশ্রাম দেওয়া লাগে। শুকনা শরীরটা তো ফানা ফানা করি আমরাই। আহারে! জিরেনের পর যে রস ঝরে সেই রসের গুড় অতি উত্তম, ‘জিরান কাটা’ পাটালিগুড়। মোকামের সেরা।
এরপর দিন যে রস ঠিলায় টুপটুপ করে ঝরে, সেটা হচ্ছে দ্বিতীয় দিনের রস ‘দো কাট’। তিনদিনের দিনের রস ‘ঝরা রস’।”
মহুয়ার আনন্দ হিম রসের সুবাসের সাথে বুঝি একাকার।
সুকুমার রায় মনে পড়ে মহুয়ার–
‘পোলাও ভাল কোর্মা ভাল,
মাছপটোলের দোলমা ভাল,
কিন্তু সবার চাইতে ভাল-
পাউরুটি আর ঝোলা গুড়।’
মামা ‘ভালরে ভাল’ বলতে বলতে গাঁদাফুল ভরা রোদ ভাসা উঠোনের দিকে হেঁটে যান। রুহিদের কলাঝোপের পাশ কাটিয়ে
রস জ্বালের সুবাস তখনও নেচে নেচে বেড়াচ্ছে বাতাসে! n
- বিষয় :
- গল্প