ঢাকা মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫

মেঘের বাড়িতে মা

মেঘের বাড়িতে মা

ছবি এঁকেছেন তন্ময় শেখ

গল্প লিখেছেন কামাল হোসাইন ।।

প্রকাশ: ১৭ মে ২০২৫ | ০০:৩৩

এক ছিলাম ছোট্ট আমি। এক ছিল আমার মা। আমরা থাকতাম এক রঙিন পৃথিবীতে। যেখানে সকালের হাওয়ায় মা আমাকে জড়িয়ে ধরতেন, আর রাতে তারা গুনতে গুনতে আমি ঘুমিয়ে পড়তাম মায়ের গানের সুরে।
 হঠাৎ একদিন, মা একদম হালকা হয়ে গেলেন। এতোটাই হালকা যে, এক সকালে দেখি, মা মেঘের সাথে উড়ে গেছেন।
আমি হাত বাড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলাম। মা তখন মিষ্টি করে হেসে বলেছিলেন, আমি থাকবো সোনা, তোমার মনের ভেতর। সব সময়। তখন থেকেই, আমি জানি– মা আর আমি এখন দু’জনেই দুই আলাদা বাড়িতে থাকি। আমি মাটির বাড়িতে, আর মা মেঘের বাড়িতে।
মায়ের মেঘের বাড়িটা খুব সুন্দর।
ওখানে নরম মেঘের বিছানা, আলোর চমৎকার ছোট ছোট কারুকার্যময় জানালা, আর তারাভরা ছোট্ট উঠোন।
আমি যখন খুব কাঁদি, মা মেঘের একটা নরম হাত বাড়িয়ে দেন, যাতে আমি তার স্পর্শ টের পাই। কখনও হাওয়ায় ভেসে আসে মায়ের গানের সুর, কখনও কোনো রাত্তিরে দেখি,
তারার ভিড়ে একটা তারা আলাদা করে টিমটিম করে জ্বলছে। আমি জানি, ওই তারাটাই আমার মা। চুপচাপ আমাকে দেখছেন, মিষ্টি করে হাসছেন। মা কখনও কাছে আসেন হালকা বৃষ্টির ভেতর, কখনও রংধনুর ঝলকে, কখনও সন্ধ্যার নরম হাওয়ায় আমার চুলে বিলি কেটে দিতে।
আর আমি, তখন চোখ বন্ধ করে বলি– মা, আমি তোমাকে অনুভব করি।
তুমি আছো।
তুমি সব সময় আছো।
এভাবেই, আমি আর আমার মেঘের বাড়ির মা রোজ নীরবে গল্প করি।
শুধু সেখানে শব্দ থাকে না।
শুধু ভালোবাসার ভেতর দিয়ে।
মায়ের চিঠি 
আমার সোনা,
আজ মেঘের জানালার পাশ থেকে তোমাকে লিখছি। তুমি যখন জানালার ধারে বসে চুপ করে থাকো, আমি দেখতে পাই। তুমি যখন চোখের কোণে অশ্রু লুকাও, আমি মেঘের হাত দিয়ে তোমার গাল মুছে দিই।
জানো, সোনা, মেঘের দেশে আমি খুব ভালো আছি। তারা আর মেঘেরা মিলে আমার জন্য এক দারুণ রংধনুর দোলনা বানিয়ে দিয়েছে।
আমি সেই দোলনায় দুলতে দুলতে তোমার কথা ভাবি। তোমার ছোট্ট ছোট্ট পায়ের ছাপ, তোমার হাসি–সব এই মেঘের ভেতর সুর হয়ে বাজে। আমি শুনতে পাই।
তুমি যখন ছবি আঁকো, আমি দেখি। তুমি যখন কবিতা লেখো, আমি দেখি। তুমি যখন গল্প বলো, আর আনমনে গান করো, আমি তোমার পাশে বসে চুপচাপ শুনি, মাথায় হাত রাখি। আদর করি। সেই আগের মতো।
সোনা, ভেবো না আমি হারিয়ে গেছি।
আমি তোমার মনের সবচেয়ে গোপন ঘরে, তোমার নিঃশ্বাসের সাথে, তোমার স্বপ্নের রঙের কৌটোয় আমি আছি।
সবসময়। চুপিচুপি।
আর মনে রেখো–
যখনই তুমি একলা অনুভব করবে, হাত বাড়ালেই পাবে মেঘের মতো নরম একটা হাত, ভেবে নিও, সেটা তোমার মায়ের।
তোমার প্রতিটি হাসি, প্রতিটি কান্না, প্রতিটি স্বপ্ন– সব আমি মেঘের খামে ভরে চুমু দিয়ে রাখি।
ভালো থেকো সোনা,
আমার প্রাণের টুকরো,
তোমার মায়ের বুকের ভেতর তুমি চিরকাল বেঁচে আছ। বেঁচে থাকবে।
আমার ভালোবাসা নিও,
তোমার মা।
তার পর থেকে, আমি যখনই খুব একা হয়ে যাই, জানালার কাছে গিয়ে বসি।
হাত বাড়িয়ে দিই আকাশের দিকে, মেঘেরা যেন মায়ের মিষ্টি গন্ধ নিয়ে নেমে আসে আমার কাছে।
কখনও হালকা বাতাস আমার চুলে হাত বুলিয়ে দেয়, কখনও অদেখা কণ্ঠে ভেসে আসে অভয় বাণী– ভয় পেয়ো না, আমি তোমার পাশে আছি।
তারপর থেকে, রোজ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমি মায়ের সঙ্গে কথা বলি মনের ভেতর, খুব গোপনে। জিজ্ঞেস করি– মা, আজ তুমি কেমন আছো?
সঙ্গে সঙ্গেই যেন কান পাতলে পাই মিষ্টি এক হাসির উত্তর–
ভালো আছি, তোমাকে ঘিরেই তো আমার সুখ। আমার আনন্দ। আমার খুশি।
তারপর থেকে, কোনো কঠিন দিন এলে, আমি নিজের বুকের ভেতর হাত রাখি।
আর তখন মনে হয়, মা আমার মনের ভেতর এক টুকরো নরম আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন।
যেখানে আমি চাইলে একটু বিশ্রাম নিতে পারি, একটু কান্না করতে পারি, আবার একটু হাসতেও পারি।
তারপর থেকে, আমি বুঝেছি– মা কখনও হারায় না। মা মিশে থাকেন হাওয়ার গন্ধে, আলোর রেখায়, মন খারাপের বিকেলে আর আনন্দের ঝিকিমিকি চোখে।
তারপর থেকে, আমি আর একা নই। আমি জানি, আমার মা আছেন। আমার গল্পের প্রতিটি অক্ষরে, আমার ছড়ার পঙক্তিতে, আমার স্বপ্নের প্রতিটি রঙে, আমার বুকের ভেতর–
একটা নির্জন, নরম মেঘের বাড়িতে। n

আরও পড়ুন

×