- গোলটেবিল
- কন্যাশিশুকে স্বপ্ন দেখাতে হবে
কন্যাশিশুকে স্বপ্ন দেখাতে হবে

অনলাইনে আয়োজিত 'বাংলাদেশ কন্যাশিশুর অধিকারে অগ্রগতি :কভিড-১৯-এর প্রভাব' শীর্ষক জাতীয় সংলাপে বিশিষ্টজন বলেন, কৈশোর না পেরোতেই কন্যাশিশুরা হারিয়ে ফেলে স্বপ্ন। তাই বাংলাদেশের কন্যাশিশুর উন্নয়ন; তাদের অধিকার রক্ষায় স্বপ্ন ভাঙা যাবে না। গত ১২ জুন যৌথভাবে এ সংলাপের আয়োজন করে চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ ও দৈনিক সমকাল। চাইল্ড রাইটস অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন ইন বাংলাদেশ মূলত শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন ১০টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত একটি জোট। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এ কোয়ালিশনের সচিবালয় হিসেবে কাজ করছে। সদস্য অন্য সংগঠনগুলো হলো- একশনএইড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম, চাইল্ড রাইটস গভর্ন্যান্স অ্যাসেমব্লি, এডুকো বাংলাদেশ, জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম, প্লান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশ, টেরে ডেস হোমস নেদারল্যান্ডস এবং ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ।
নাসিমা বেগম এনডিসি
জন্ম থেকেই কন্যাশিশুরা বৈষম্যের শিকার। লেখাপড়ার স্বপ্নও অধরা থেকে যায় অভাবের সংসারে। দুর্যোগ-মহামারিতেও তাদের ওপর খড়্গ নেমে আসে। বাল্যবিয়ের শিকার হয় অনেকে। কৈশোর না পেরোতেই হারিয়ে ফেলে স্বপ্ন। তাই বাংলাদেশের কন্যাশিশুর উন্নয়ন; তাদের অধিকার রক্ষায় স্বপ্ন ভাঙা যাবে না। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রেই কন্যাশিশুরা বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয় না। খাওয়া-দাওয়া, পোশাক-পরিচ্ছদ এমনকি সামাজিক মর্যাদায়ও তারা অবহেলা, বঞ্চনার শিকার হয়ে থাকে। শিশু সুরক্ষার জন্য শিশু নীতিমালা, শিশু অধিকার আইন থাকলেও তা কাজে আসছে না। এ জন্য পরিবার থেকেই তাদের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে; লালন করতে হবে। তাদের স্বপ্ন দেখাতে হবে। সবার জন্য যেন সুরক্ষিত পথ থাকে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। সবাইকে নিয়ে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ গড়ে তুলতে হবে। মূল্যবোধের যে অবক্ষয় হয়েছে, সেটা ভাঙতে হবে। মূল্যবোধ তৈরির জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে। ছেলেদের বলতে হবে, মেয়েদের দিকে যেন তারা অন্য নজরে না তাকায়। ছেলেদের বোঝাতে হবে, যেন তারা সাইবার বুলিংয়ের মতো কাজ না করে। তারও যে একটা বোন আছে- সেটা যেন তারা ভুলে না যায়। আইন করে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হবে না। সহিংসতা প্রতিরোধে পুরুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। একই সঙ্গে সমাজ পরিবর্তনে পরিবার থেকে শুরু করে প্রতিটি স্তরে নিজ উদ্যোগে কাজ করতে হবে।
নীনা গোস্বামী
আজকের কন্যাশিশুরা অনেক দূর এগিয়ে এসেছে। তারা তাদের অধিকারের কথা বলতে পারে। ভয়েজ রেইজ করতে পারে। সেসব কন্যাশিশুর অধিকার, বাধাগুলো নিয়ে যিনি বলতে পারেন, তিনিই তাদের সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখাতে পারেন। শুধু স্বপ্ন দেখানোই নয়; কন্যাশিশুর জন্য সুন্দর সমাজ, সুন্দর চলার পথ তৈরি করতে হবে। নারী শিক্ষার অবারিত পথ তৈরি করতে হবে, যেন তারা স্বাধীনভাবে চলতে পারে।
মাহমুদুল কবিরকন্যাশিশু নির্যাতন ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সিভিল সোসাইটি হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে যে প্রমাণগুলা আছে সেগুলো সবার সামনে তুলে ধরা। যাঁরা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আছেন, তাঁদের কাছে বিস্তারিত তুলে ধরে, যাতে ব্যবস্থা নিতে পারেন। দেশের ৪০ শতাংশ শিশু। সরকারের বিভিন্ন সোসাইটি শিশুদের জন্য অনেক কাজ করে। করোনার সময় আমরা দুর্যোগের মধ্যে গেছি। এখন কাজ হচ্ছে এগুলো থেকে উত্তরণ ঘটানো। আমাদের সিভিল সোসাইটি সরকারসহ পরিবার থেকে সবার কাছে শিশুদের ভবিষ্যৎ কীভাবে আরও উন্নত করতে পারি, তা তুলে ধরে কাজ করছে।
মাইমুনা সৈয়দ আহমেদবাংলাদেশ সরকার কন্যাশিশুর অধিকার রক্ষা ও তাদের উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। গত পাঁচ বছরে শিক্ষায় কন্যাশিশুর হার বেড়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় কন্যাশিশুর অভিগম্যতা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। পাঠ্যক্রমে জেন্ডার বৈষম্যমূলক বেশ কিছু কনটেন্ট বাদ দেওয়া হয়েছে; শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে এবং আইএলও সনদ নম্বর ১৩৮ অনুমোদন করা হয়েছে। তারপরও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা এখনও চলছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছে কন্যাশিশুরা। এ সময় সবচেয়ে বেশি ঘটেছে শিশু ধর্ষণ। ২৪৭ কন্যাশিশু (৫৫ শতাংশ) ধর্ষণের শিকার হয়। হত্যা করা হয় ১০৬ (২৪ শতাংশ) কন্যাশিশুকে। এ ছাড়াও সহিংসতার শিকার কন্যাশিশুর মধ্যে ৪৭ দশমিক ১০ শতাংশ নির্যাতন, ৩৩ দশমিক ৭ শতাংশ যৌন হয়রানি, ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ পারিবারিক সহিংসতা ও ৫ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও মানসিক শাস্তির শিকার হয়। কন্যাশিশুর অধিকার পরিস্থিতিতে দেখা যায়- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ঝুঁকিপূর্ণ কর্মক্ষেত্র, যৌন শোষণ ও পাচার, অনলাইনে যৌন হয়রানি ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে কন্যাশিশুর ওপর। কয়েকটি কেস স্টাডি তুলে ধরা হলো- ব্ল্যাকমেইলের জেরে কীটনাশক পান করে চলতি বছরের ২৪ এপ্রিল রাতে এক মাদ্রাসাছাত্রী আত্মহত্যা করেছিল। ৩ বছরের এক শিশুকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে সৎবাবা শহীদুল ইসলামের বিরুদ্ধে। গত ১৩ মে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ওই শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। চলতি বছরের ১৫ মার্চ সমকালে ছাপা হয়েছে, শিশু গৃহকর্মীকে নির্যাতনের অভিযোগে এক দম্পতিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ভুক্তভোগী শিশু অভিযোগ করে জানায়, সে কোনো কাজ না পারলেই লাঠি দিয়ে মারধর করত ওই দম্পতি। গত ১৮ মে রাত ১০টায় মাদ্রাসায় পড়ূয়া মেয়েকে (১৬) তার নিজ বাড়ির কক্ষে আটকে নির্যাতন করা হয়।
ড. নুরুন নাহার
পরিকল্পনা কমিশন সরকারের বিনিয়োগকে মনিটর করে। যেসব মন্ত্রণালয় নারী ও শিশুর উন্নয়নে কাজ করে, সেসব কাজ আমরা মনিটর করি। কোন প্রকল্পটা উপকারী, সেগুলো দেখি। সুবিধাভোগী কারা, এ বিষয়গুলোকে আমরা অগ্রাধিকার দিই। নারী ও শিশুর উন্নয়নে পরিকল্পনা নির্বাচনে আমরা আরও সচেতন থাকতে পারি। পরিকল্পনা প্রণয়নে ডকুমেন্টেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কার জন্য পরিকল্পনাটা নেওয়া হচ্ছে, তারা কীভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হবে এসব বিষয় যত ভালোভাবে ডকুমেন্টে আসবে, ততই ভালো হবে।
ড. শেখ মুসলিমা মুন
যে কোনো দুর্যোগে নারী ও শিশুরা ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আর এতে নারীরা বিশেষ করে কন্যাশিশুরা বেশি ক্ষতির শিকার হয়। ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগ হলেও বেশি ক্ষতির শিকার হয় নারী। সবাইকে নিরাপদে পৌঁছে দিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করে নারী ঘর থেকে বের হয়। তারা যখন আশ্রয়কেন্দ্রে যায়, তাও নারীবান্ধব নয়। সেখানে টয়লেটসহ সবকিছু নারীর অনুকূল নয়। করোনার সময়েও নারীরা বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের অনেকে পরিবারের আপনজনের কাছ থেকে নির্যাতনের শিকার হয়। এসব ঘটনায় তারা পরিবারের অন্য সদস্যকে বলতেও পারে না। এ সময় নারীদের বাল্যবিয়ের ঘটনা বেশি ঘটেছে। তাদের অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার কারণে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আর কম বয়সে বিয়ের কারণে তারা ভবিষ্যতে নানান শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হবে। ফলে আগামী প্রজন্মে এর প্রভাব পড়বে। নারীরা ঘরের মধ্যে শুধু নয়; বাইরেও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। গণপরিবহনেও নারীরা তাঁদের সিটে বসতে পারছেন না। আবার মেয়েরা তাঁদের পরিবারের সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
দেবী চন্দ
সুস্থ জাতি ও সুস্থ দেশ গঠনে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই তার টিকা দেওয়া নিশ্চিত করে সরকার। মাতৃত্বকালীন কমিউনিটি ক্লিনিক ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মাধ্যমে মায়ের সেবা দেওয়া শুরু হয়। মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে নানান কর্মসূচি আছে সরকারের। করোনাকালীন নারীরা বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আমরা নির্যাতিত নারী-শিশুদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করেছি। ইউনিয়ন সেবাকেন্দ্রে তাদের শারীরিক ও মানসিক সেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে মেয়েরা একাই স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে সব বিষয়ে কথা বলতে পারে। তারা এখানে শারীরিক ও মানসিক পরামর্শ নিচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ করা হচ্ছে। উঠান বৈঠকের মধ্য থেকে মায়েদের সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করা হচ্ছে। মেয়েদের নানান সমস্যা নিয়ে কথা বলা হচ্ছে। স্যাটেলাইট ক্লিনিকের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে তাদের সমস্যা শোনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফ্যামিলি ক্লিনিকের মাঠকর্মী ও উপজেলা স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে সাইবার বুলিংয়ের পর নারীদের মানসিক সাপোর্ট দেওয়া হয়ে থাকে। মা ও শিশুর কল্যাণে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে নাটিকাসহ অনেক প্রোগ্রাম প্রচার করা হচ্ছে।
কাশফিয়া ফিরোজ
প্লান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের আগামী ১০ বছরের কর্মপরিকল্পনা তৈরি করার সময় আমরা বিভিন্ন পর্যায়ের অংশীদারদের পরামর্শ নিয়েছি। আমরা কিশোর-কিশোরী ও যুবকদের মত নিয়েছি। এই মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পেরেছি, আমাদের তরুণদের মধ্যে সহিংসতার ভয় প্রবলভাবে কাজ করে। সম্প্রতি প্লান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এই সহিংসতার ভয় নিয়ে একটি জরিপ করে। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ কিশোরী বলেছে, তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন রকম কটূক্তির শিকার হয় এবং তাদের বাবা-মাকে জানায়। সহিংসতার ভয়ে ৬২ শতাংশ মা তাদের মেয়েদের স্কুলের পিকনিকে যেতে দেন না। এই সহিংসতার ভয়েই ৫৪ দশমিক ১ শতাংশ বাবা তাদের মেয়েদের প্রাইভেট টিউশনে যেতে দেন না। স্কুলে খেলার প্রতিযোগিতায় মেয়েদের অংশগ্রহণ করতে দেন না ৪৭ দশমিক ৮ শতাংশ মা। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে দেন না ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ মা। এর ফলে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে ৯০ দশমিক ২ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী। ৩ দশমিক ৫ শতাংশ কিশোরী আত্মহত্যার চেষ্টা করে সহিংসতার ভয়ে। জনপরিসরে ৮১ দশমিক ৬ শতাংশ মেয়ে হয়রানির শিকার হয়। সহিংসতার শিকার এসব মেয়ের মধ্যে ৩৫ দশমিক ৯ শতাংশ কোনো প্রতিবাদ করে না। ৭২ দশমিক ৪ শতাংশ মেয়ে বাইরে যেতে ভয় পায়। করোনাকালীন যেমন বেড়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার, তেমন বেড়েছে মেয়েদের প্রতি কটূক্তি ও হয়রানি। ৫৬ দশমিক ৬ শতাংশ মেয়ে জানিয়েছে, তারা সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছে। জাতি হিসেবে আমরা নারীর ক্ষমতায়ন করার যতই চেষ্টা করি; সহিংসতার ভয় তাদের অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবেই। যতদিন এই সহিংসতার ভয় থেকে আমরা আমাদের মেয়ে, নারী ও তরুণদের বের করে নিয়ে আসতে না পারব, ততদিন তারা অগ্রসর হওয়ার পথে বাধাগ্রস্ত হবে।
নাসিমা আক্তার জলি
আমাদের সুন্দর সমাজ গড়তে সামাজিক সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে হবে। এখনও পরিসংখ্যান বলছে, আমাদের দেশে ৩৪ লাখ শ্রমজীবী শিশু আছে। এদের মধ্যে গৃহকর্মে ১১ লাখ মেয়েশিশু নিয়োজিত। তাদের অনেকেই ঠিকঠাক মজুরি পায় না। পেলেও সেটা ৫০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে। জাতিসংঘ শ্রম আইন, বাংলাদেশের শ্রম আইন থাকলেও তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। ফলে শিশুশ্রম বাড়ছে। শিশুদের শতভাগ প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা নিশ্চিত হচ্ছে না। তাদের অনেকে ভর্তি হয়েও স্কুলে যায় না। পরিবারের মধ্যেই নানান কাজ করে। আবার একটি শিশু স্কুলে না গিয়ে আরেকটা শিশুকে লালন-পালন করছে। কারণ মা অন্যের বাড়িতে কাজ করছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২১ সালে ১১২৭ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যা ২০২০ সালের চেয়ে ৭৪ শতাংশ বেশি। অনেক পরিবার এসব ঘটনায় মামলা করেছে। করোনাকালীন ২৭২ জন কন্যাশিশু আত্মহত্যা করেছে। প্রেমের সম্পর্কে প্রতারিত, নির্যাতনের শিকার হয়ে আর হতাশার কারণে তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। বর্তমানে অনেকে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে, যা দৈনিক ৩৪-৪০ জন। করোনাকালীন ১৫ লাখ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এ সময়ে ১২ শতাংশ নারী নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব ঘটনায় বছরের পরে বছর মামলাগুলো ঝুলে থাকে। পরিবারকে আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হয়। এ কারণেও নির্যাতনের সংখ্যা বাড়ছে। নির্যাতনকারীরা প্রভাবশালীদের আশ্রয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। নারী-শিশু নির্যাতন বন্ধে নির্যাতনকারীদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আশ্রয় বন্ধ করতে হবে। শিশুদের সুরক্ষায় শিশু অধিদপ্তর গঠনের আলোচনা দীর্ঘদিন যাবৎ হচ্ছে। এখন সময় এসেছে শিশুদের সুরক্ষায় শিশু অধিদপ্তর গঠন করার।
ফাতেমা আক্তার
বর্তমান সমাজে বাল্যবিয়ে একটি ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার অভাবে এটি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি একটি ক্লাবে কাজ করি। ক্লাবের মাধ্যমে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সচেতনা তৈরিতে কাজ করি। আমরা বাল্যবিয়ে নিয়ে কাজ করতে এর কয়েকটি কারণ খুঁজে পেয়েছি। বাল্যবিয়ের প্রথম কারণ দারিদ্র্য। পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করতে না পেরে পিতা তাঁর মেয়েকে অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেন। সামাজিক কারণেও বাল্যবিয়ে হয়ে থাকে। যৌতুক প্রথার কারণে অনেকে অল্প বয়সী মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেন। রাষ্ট্র সব মেয়ের শিক্ষা নিশ্চিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। করোনার কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চলের পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের সচ্ছল করতে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
মোহসিনা আক্তারবাংলাদেশে বেশিরভাগ মেয়ের বিয়ে হয় ১২ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। বিয়ের ১৩ মাসের মধ্যেই ৬৫ ভাগ কন্যাশিশু গর্ভ ধারণ করে। এক বছরের মধ্যে সন্তান জন্ম দেয়। ফলে অল্প বয়সে সন্তান নেওয়ায় নবজাতকসহ মা নানা রকম অসুখ-বিসুখের সম্মুখীন হয় ও পুষ্টিহীনতায় ভোগে। শিশু তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। তাই বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে প্রথমেই পরিবারের অভিভাবক মা-বাবাকে সচেতন করে তুলতে হবে। কাজিকেও বিষয়টি জানাতে হবে। ইউনিয়নভিত্তিক বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে হবে। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে পরিবারের শিশু সন্তানকে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে যুক্ত রাখতে হবে। সঠিক জন্ম সনদ দেওয়া হচ্ছে কিনা, এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন কার্যকর করতে হবে। গ্রামে কেউ বাল্যবিয়ে দিতে চাইলে ও বাল্যবিয়ে করলে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তাহলে অন্যরাও বাল্যবিয়ে দিতে ভয় পাবে। একই সঙ্গে শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে বিরত রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে ইয়ুথ গ্রুপের সবাইকে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে। ২০২১ সালে আমাদের ঘোড়াঘাটেই ইয়ুথ গ্রুপের স্বেচ্ছাসেবী তরুণরা ৮টি বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে আমরা বাধার সম্মুখীন হয়েছি। অনেক বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে গিয়ে দেখতে পাই, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের সুপারিশে বাল্যবিয়ে সম্পন্ন হয়। তাই তরুণদেরই এগিয়ে আসতে হবে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে। আমরা যেমন 'বাল্যবিয়েকে না বলি, শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ি' স্লোগানে কাজ করছি; তেমনি সব স্থানে তরুণদের কাজ করতে হবে।
শিরীন আক্তার রাশা
মেয়েরা জন্মের পর পরিবার থেকেই বৈষম্যের শিকার হয়। তারা পরিবারের ছেলে শিশুর চেয়ে অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। ছেলে সন্তান যখন পড়াশোনার সুযোগ পায়, তাদের পরিবারের বাইরে পড়াশোনার জন্য পাঠানো হয়। একজন মেয়েকে শুধু নারী হওয়ার জন্য পড়াশোনার জন্য ঘরের বাইরে পাঠানো হয় না। পরিবারের অনেকেই চিন্তা করে, মেয়ে শিশুকে পড়াশোনা করালে সেটা উৎপাদনমুখী হবে না। আবার তারা বাইরে গেলে নির্যাতনের শিকার হবে। সমাজ ও পরিবার তাদের ট্যাবুর কারণে মেয়েদের শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। করোনাকালীন অনেক মেয়েকে অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের যদি ছেলেদের মতো পড়াশোনা করার সুযোগ দেওয়া হতো, তাহলে তাদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হতো না। এ সময় তিনি বলেন, সব মেয়েকে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। মেয়েশিশু জন্মের পরেই জন্মনিবন্ধন কার্ড নিশ্চিত করতে হবে। যাতে জন্মনিবন্ধন কার্ডে বয়স বাড়িয়ে অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়ার সুযোগ না থাকে। ঝরে পড়া কন্যাশিশুদের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে, যাতে তারা কারিগরি শিক্ষা নিয়ে উৎপাদনমুখী হতে পারে। তাদের স্বপ্ন দেখাতে হবে- মেয়েরাও পারে। তারা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর চালাচ্ছে। রাষ্ট্রের উন্নয়নে অবদান রাখছে।
মাহফুজা জাহান মুন্নী
গ্রামাঞ্চলে থাকা কন্যাশিশুরা ক্রয়ক্ষমতার বাইরে থাকায় স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে পারে না। ফলে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে তারা। মনস্তাত্ত্বিক সমস্যাসহ তিনটি সমস্যার মুখোমুখি হয় এসব কন্যাশিশু। এ ছাড়া বয়ঃসন্ধিকালে ও যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে অধিকাংশ কিশোরীর জ্ঞানের অভাব থাকায় গ্রামাঞ্চলে গর্ভপাত, মাতৃমৃত্যু, ঋতুস্রাব সম্পর্কিত নানা জটিলতা দেখা দেয়।
সুরমী বেগ
আমাদের সমাজে মেয়েদের পড়াশোনার হার বেড়েছে। কিন্তু করোনাকালীন ও পরবর্তী সময়ে আমাদের এলাকায় অনেক মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। করোনার পর আমাদের পরিবারের খরচ চালানো কঠিন হয়ে গেছে। সেখানে এখন পড়াশোনা করা যেন বিলাসিতা। পরিবারের পক্ষ থেকে টিউশন ফি, পরীক্ষার ফি, খাতা-কলমের টাকা জোগাড় করা সম্ভব হয় না। অনেক ছেলেরও পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। তারা পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করে পরিবারকে সহযোগিতা করছে। এ ছাড়া আমাদের আদিবাসীদের নিজেদের ভাষায় বই নেই। আমাদের গ্রাম থেকে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় দূরে হওয়ায় প্রাথমিক শিক্ষার পর তারা আর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যাচ্ছে না। আবার কাছের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমাদের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার সুযোগ পায় না। এখন আমাদের শিশুদের শিক্ষার নিশ্চয়তা দিতে হবে। পরিবারগুলোকে উৎসাহিত করতে স্বাবলম্বী করে তুলতে হবে।
আদুরী বাস্কে
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একজন কন্যাশিশু হিসেবে আমার বেড়ে ওঠা খুব সহজ ছিল না। আমাদের অঞ্চলের প্রত্যেক কন্যাশিশুকে নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়। সামাজিক সুরক্ষার মধ্য দিয়ে আমরা সহজেই বেড়ে উঠতে পারি না। এর মধ্যে অন্যতম বাধা হলো শিক্ষা গ্রহণ। প্রতিকূলতা মোকাবিলা করেই আমাদের উচ্চশিক্ষার স্তর পার করতে হয়। এ ছাড়াও রয়েছে সচেতনতার অভাব, দারিদ্র্য, পারিবারিক দুরবস্থা, সামাজিক মূল্যবোধের অভাব ও অন্যের কাছে প্রাপ্যতার মূল্যায়ন না পাওয়া। এর পরও চাকরি না পাওয়া আরেকটি বড় বাধা। তাদেরই একজন আমি। আমরা কীভাবে এসব সমস্যা থেকে বের হতে পারি? এ জন্য সরকারে বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। সরকার যেন আদিবাসীদের জন্য প্রথম শ্রেণির চাকরির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা চালু করে। মা ও কন্যাশিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে।
রওনক সামিয়া
বর্তমানে নারী-শিশু নির্যাতনের অন্যতম মাধ্যম সাইবার বুলিং। করোনাকালীন প্রথম ছয় মাসেই ৮২৭ জন মেয়ে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছে। করোনাকালীন আমার এক কাছের বান্ধবী সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়। সে তখন কী করবে বুঝে উঠতে পারেনি। তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে সে বলতে চায় না। এমন ঘটনা অনেক আছে। তারা পরিবারের কাছে সাইবার বুলিং বিষয়ে বলতে চায় না। আবার সরকারি হেল্পলাইনেও ফোন করে তেমন সাড়া পাওয়া যায় না। সাইবার বুলিং বিষয়ে পরিবারের কাছে বললে দোষ মেয়েটার ঘাড়ে পড়ে। তাদের ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দেয় না। সাইবার বুলিং বন্ধে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে ভবিষ্যতে নারী নির্যাতনের অন্যতম মাধ্যম হবে সাইবার বুলিং। সাইবার বুলিং বন্ধে অপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি বুলিংয়ের শিকার মেয়েদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
নিওমা চৌধুরী
বর্তমান সমাজে বাল্যবিয়ে একটি ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার অভাবে এটি আরও বেড়েছে। বিভিন্ন ক্লাবের মাধ্যমে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সচেতনতায় কাজ করছে সেখানকার কিশোর-কিশোরীরা। বাল্যবিয়ের প্রথম কারণ দারিদ্র্য। পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করতে না পেরে বাবা তাঁর মেয়েকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেন। সামাজিক কারণেও বাল্যবিয়ে হয়ে থাকে। যৌতুক প্রথার কারণে অনেকে অল্প বয়সী মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেন। রাষ্ট্র সব মেয়ের শিক্ষা নিশ্চিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। রাষ্ট্রকেই মেয়েদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
শেখ রোকন
শিশুর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা এবং তাদের জন্য বসবাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলার অঙ্গীকার সমকালের সম্পাদকীয় নীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। শিশুদের সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে সমকাল কাজ করে যাচ্ছে। শিশুদের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার লড়াইয়ে আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে; অনেকের সঙ্গে পা মেলাতে হবে।
প্রধান অতিথি
নাসিমা বেগম এনডিসি
চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
মূল প্রবন্ধ
মাইমুনা সৈয়দ আহমেদ
সচিবালয় সহকারী সমন্বয়কারী, কোয়ালিশন
আলোচক
নীনা গোস্বামী
পরিচালক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)
মাহমুদুল কবির
কান্ট্রি ডিরেক্টর, টেরে ডেস হোমস নেদারল্যান্ডস
ড. নুরুন নাহার
যুগ্ম প্রধান, আর্থসামাজিক উইং, পরিকল্পনা কমিশন
ড. শেখ মুসলিমা মুন
উপসচিব, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়
দেবি চন্দ
উপসচিব, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়
কাশফিয়া ফিরোজ
পরিচালক, গার্লস রাইটস, প্লান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ
নাসিমা আক্তার জলি
সচিব, জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম
ফাতেমা আক্তার
সভাপতি, শিশু রক্ষা কমিটি, যুব উন্নয়ন ক্লাব, রানীশংকৈল, ঠাকুরগাঁও
মোহসিনা আক্তার
সভাপতি, ঘোড়াঘাট সামাজিক উন্নয়ন সংগঠন, ঘোড়াঘাট, দিনাজপুর
শিরীন আক্তার রাশা
যুব স্বেচ্ছাকর্মী, জলঢাকা, নীলফামারী
মাহফুজা জাহান মুন্নী
কিশোরগঞ্জ
সুরমী বেগ
যুব স্বেচ্ছাকর্মী, ঠাকুরগাঁও
আদুরী বাস্কে
নওগাঁ
রওনক সামিয়া
শিশুকল্যাণ কর্মী, চুয়াডাঙ্গা
নিওমা চৌধুরী
খাগড়াছড়ি
সঞ্চালনায়
শেখ রোকন
সম্পাদকীয় বিভাগ প্রধান, সমকাল
অনুলিখন
সাজিদা ইসলাম পারুল
স্টাফ রিপোর্টার
ও
লতিফুল ইসলাম
স্টাফ রিপোর্টার
মন্তব্য করুন