আজকের শিশুই আগামীর কর্ণধার। তাদের স্বাভাবিক বিকাশে প্রয়োজন খেলাধুলা ও শরীরচর্চা। কিন্তু দিন দিন খেলার মাঠ ও বিনোদন পার্ক বিলুপ্তির পথে। শিশুদের কাছে এখন এগুলো স্বপ্নে পরিণত হচ্ছে। ফলে দেশে বেড়ে গেছে গ্যাং কালচার। এই অবক্ষয় ঠেকিয়ে আগামী প্রজন্ম গড়ে তুলতে হলে রাজধানীর প্রতিটি ওয়ার্ড ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ গড়ে তোলা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা খুবই জরুরি। গত ১৭ জুলাই রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকাল সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন বিশিষ্টজন। 'বার্ষিক জাতীয় বাজেটে শিশুদের জন্য বরাদ্দ ২০২২-২৩ এবং শিশুদের জন্য স্বপ্নের পার্ক ও খেলার মাঠ' শীর্ষক এ বৈঠকের আয়োজন করে দৈনিক সমকাল, আরবান প্রোগ্রাম, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ এবং আর্টিস্টিক কমিউনিকেশন।
এম এ মান্নান
এমন কোনো সমাজ নেই, যে সমাজে শিশুরা বঞ্চিত হচ্ছে না। তারা সব অবস্থ্থাতেই বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে এবং আমাদের দেশেও হচ্ছে। অথচ ভবিষ্যৎ শিশুদেরই হাতে। তাই তাদের সুস্থভাবে গড়ে তুলতে হবে। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার উপজেলা পর্যায়ে শেখ রাসেল স্টেডিয়ামসহ মাঠের ব্যবস্থ্থা করছে। সেখানে শিশুরা খেলতে পারে। আরও ব্যবস্থ্থা করা হচ্ছে। কোথাও কোনো সরকারি ব্যবহারহীন পরিত্যক্ত জায়গা থাকলে তা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়কে জানালে এবং আবেদন করলে আমার মন্ত্রণালয় তা খেলার মাঠ হিসেবে বরাদ্দ বা অনুমোদন দেওয়ার চেষ্টা করবে।


নজরুল ইসলাম
শিশুদের বিকাশে সরকার বিভিন্ন ফেডারেশনের মাধ্যমে খেলাধুলার আয়োজন করে আসছে। ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শিশুদের তুলে আনা হচ্ছে। বিভাগীয় পর্যায় থেকে ঢাকায় এনে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাদের জাতীয় পর্যায়ে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ঢাকাসহ সারাদেশে ছয়টি ক্রীড়াকেন্দ্র রয়েছে। এসব ক্রীড়াকেন্দ্র এবং স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে শিশুদের ক্রীড়াসামগ্রী দেওয়া হচ্ছে। শিশুদের ক্রীড়া প্রতিভা অন্বেষণ করা হচ্ছে। যেসব মাঠ হারিয়ে গেছে, সেগুলো পুনরুদ্ধারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যা সংস্কারের প্রয়োজন তা সংস্কার করা হচ্ছে। স্কুল-কলেজের যেসব ক্যাম্পাসে মাঠ আছে তা শিশুর উপযোগী করা হচ্ছে।


মো. মুহিবুজ্জামান
রাজধানীর মানুষকে স্বস্তি দিতে এবং জলবায়ুর অভিঘাত রুখতে উন্মুক্ত স্থান বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত খেলার মাঠ তৈরি করতে না পারলে এবং সেখানে শিশুদের খেলার সুযোগ করে দিতে না পারলে তাদের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। শিশুদের জন্য সুস্থ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থারও কাজ করতে হবে। যে যার জায়গা থেকে কাজ করলে মাঠ রক্ষা করা সম্ভব। এ জন্য সমন্বয় প্রয়োজন।



সৈয়দ ইমামুল হোসেন
আমাদের সময়ে গ্রামের এমন কোনো স্কুল ছিল না, যেখানে মাঠ ছিল না। এখন স্কুুলের মাঠ হারিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে স্কুল-কলেজ অনুমোদনের সময় খেলার মাঠের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা রাখা হয়েছে কিনা, তা দেখে আমরা অনুমোদন দিচ্ছি। শিশুদের বড় অংশ অটিস্টিক থাকে, তারা স্কুলে যেতে ভয় পায়। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে বিনোদন প্রয়োজন। আমরা সে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। ঢাকা শহরে আড়াই কোটি মানুষ, কিন্তু এখানে সরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়েনি এবং যেগুলো আছে সেখানে মাঠ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানেরও জায়গা আমরা হারিয়ে ফেলছি। নগরায়ণে আমরা শিশুদের অধিকার ভূলুণ্ঠিত করেছি। কিন্তু আমাদের শিশুর বিকাশে প্রয়োজন মানবিক মূল্যবোধ।
আমরা চেষ্টা করছি প্রতিটি শিশু যেন তার অধিকার ফিরে পায়, সুস্থভাবে বিকাশের সুযোগ পায়।

চন্দন জেড গমেজ
শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলা, খেলার মাঠ ও পার্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামাঞ্চল, ইউনিয়ন, উপজেলা এবং জেলা শহরের শিশুদের খেলার মাঠ, বিনোদন এবং  খেলাধুলার কিছুটা সুযোগ থাকলেও আরবান বা সিটি করপোরেশনের শিশুদের এ সুযোগ নেই বললেই চলে, বিশেষ করে ঢাকার শিশুদের। ধনী ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিশুদের এ সুযোগ কিছুটা থাকলেও বস্তির শিশু, দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের পরিবারের শিশুদের কাছে খেলার মাঠ ও বিনোদন পার্ক একটি স্বপ্ন। দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সিটি করপোরেশন এলাকায় শিশুদের জন্য সরকারি বিনোদন পার্ক ও খেলাধুলার স্থান ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। এদিকে সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর খুব বেশি আছে বলেও মনে হয় না। ফলে সিটি এলাকার বস্তির শিশুরা খেলাধুলা এবং বিনোদনের সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত, তারা অলস সময় পার করছে। ইভটিজিং, বিভিন্ন ডিভাইস ও মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকছে। তারা শিশুশ্রম, অসামাজিক ও ঝুঁকিপূর্ণ কার্যকলাপে লিপ্ত হচ্ছে। ফলে তাদের পরিপূর্ণ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। 'একটি সুষ্ঠু জাতি গঠনে খেলাধুলা, শারীরচর্চা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড খুবই জরুরি'- গত ১১ মে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার (২০১৩-২১) বিতরণ অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় এ কথাগুলো বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'এটি খুব ভালো সংবাদ নয় যে, রাজধানী ঢাকায় খেলাধুলার জন্য উন্মুক্ত স্থান বা খেলার মাঠের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।' তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকার বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে, যাতে প্রতিটি এলাকায় অন্তত একটি খেলার মাঠ থাকে। সেই সঙ্গে তিনি পিতা-মাতা এবং অভিভাবকদেরও অনুরোধ করেন, যাতে তাঁরা তাঁদের সন্তানদের কিছু সময় উন্মুক্ত বা ফ্রি করে দেন, যাতে তারা খেলাধুলায় মনোনিবেশ করে এবং বিভিন্ন ডিভাইস, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অলস ও বুদ্ধিহীন না হয়। আমরা জানি না, সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে কতদূর অগ্রসর হয়েছে এবং ২০২২-২৩ সালের বার্ষিক বাজেটে এর সামান্যতম প্রতিফলন ঘটেছে কিনা। রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন উন্নয়নকাজের সঙ্গে কমছে শিশুদের খেলার মাঠ। অধিকাংশ মাঠ পুনরুদ্ধারের পরও খেলাধুলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ শিশুরা। গত ২২ বছরে ঢাকায় উন্মুক্ত মাঠের সংখ্যা ১৫০ থেকে নেমে এসেছে ২৪-এরও নিচে। এগুলোর মধ্যে কয়েকটির উন্নয়নকাজ চলছে, আবার কোনোটি পড়ে থাকছে তালাবদ্ধ। ২০১৯ সালে করা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক জরিপ মতে, ঢাকার ২ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় ২৩৫টি খেলার মাঠ রয়েছে (যেখানে প্রয়োজন ২ হাজার ৪০০টি)। এর মধ্যে ১৪১টিই প্রাতিষ্ঠানিক। মাত্র ৪২টি খেলার মাঠ জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। এর মধ্যে দখলে আছে ১৬টি, ১৭টি সরকারি মাঠ, ২৪টি আবাসিক কলোনি মাঠ এবং ১২টিতে ঈদের জামাত ও অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান হয়। বর্তমানে এ সংখ্যা আরও কমেছে বলে জানিয়েছে সংগঠনটি। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, মেয়েদের জন্য পৃথক কোনো খেলার মাঠ নেই। মেয়েরা মাত্র ৭ শতাংশ মাঠে খেলতে পারে। রাজধানীতে উন্মুক্ত ২৪টি মাঠ রয়েছে, যার ১৮টি সিটি করপোরেশনের (উত্তর সিটিতে ৬টি এবং দক্ষিণ সিটিতে ১২টি)। এর মধ্যেও কিছু খেলার মাঠ আবার সংস্কার করা হয়েছে। ফলে মাঠের সৌন্দর্য বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু সেসব মাঠে প্রবেশে সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। সংশোধিত ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রণয়নের অংশ হিসেবে রাজউকের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১২৯টি ওয়ার্ডের ৩৭টিতে কোনো খেলার মাঠ অথবা পার্ক নেই। সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ আরবান প্রোগ্রাম ঢাকা, গাজীপুরের টঙ্গী এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১৬৭ জন ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকের মধ্যে এ-সংক্রান্ত এক জরিপ পরিচালনা করে। এতে সরকারি ও বেসরকারি প্রাইমারি ও মাধ্যমিক স্কুল, জুনিয়র হাই স্কুল, সিটি করপোরেশন পরিচালিত স্কুল, মাদ্রাসা, প্রাইভেট ও কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ছাত্রছাত্রী ছিল। জরিপে উঠে এসেছে, ৪৫ দশমিক ৫ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছে, তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ নেই। ২৫ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধুলার জন্য কোনো সময়-সুযোগ দেওয়া হয় না। ৮১ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছে, চাহিদামতো খেলাধুলার সামগ্রী দেওয়া হয় না। ২৬ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছে, তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বার্ষিক কোনো খেলাধুলার প্রতিযোগিতা হয় না। প্রায় ৬৩ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধুলার জন্য কোনো বিশেষ শিক্ষক নেই। ১২ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছে, সন্তানদের খেলাধুলার প্রতি অভিভাবকদের কোনো আগ্রহই নেই এবং ১৫ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছে, তাদের অভিভাবকরা খেলাধুলার সুযোগ দেন না।
মো. আবু ইউসুফ
আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ। তাই বাজেটে শিশুর জন্য বরাদ্দ নয়, তাদের প্রতি বিনিয়োগ করুন। তাদের উদ্দেশ্যে সঠিক বিনিয়োগ করলে ভবিষ্যতে ভালো ফল পাওয়া যাবে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে শিশুদের নিয়ে বাজেট প্রকাশ করা হতো। কিন্তু করোনার কারণে গত তিন বছর ধরে তা প্রকাশ করা হচ্ছে না। সরকার শিশুদের নিয়ে বাজেটে ভালো বরাদ্দ রাখছে। কিন্তু গত ২২ বছরে রাজধানীতে ১৫০টির মতো মাঠ আমরা হারিয়ে ফেলেছি। প্রতিটি এলাকা বা ওয়ার্ডে কমপক্ষে একটি মাঠ থাকা প্রয়োজন। প্রতিটি মাঠেই যেন শিশুরা খেলার সুযোগ পায়।



মঞ্জু মারীয়া পালমা
শিক্ষা যেমন জাতি গঠনে কাজ করে, তেমনি খেলার মাঠ ও বিনোদন আদর্শ মানুষ গড়ে তোলে। পড়ালেখা শিশুর মানসিক বিকাশ সাধন করে, আর খেলাধুলা মানসিক ও শারীরিক উভয় বিকাশ সাধন করে। তাই পড়াশোনার পাশাপাশি প্রতিটি শিশুর খেলার জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে। নগরায়ণে মাঠ দখল হয়ে যাচ্ছে। মাঠ উন্নয়নের পরে তা জাল দিয়ে আটকে দেওয়া হচ্ছে। সেখানে প্রভাবশালীদের শিশুরা খেলতে পারলেও গরিব শিশুরা খেলতে পারে না। আমাদের বস্তিবাসী শিশুদের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে, যেন কোনো শিশু রাস্তায় পথশিশুর পরিচয়ে না থাকে। তাদের পড়াশোনাসহ সব নাগরিক সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। ১৮ বছরের আগে যেন কোনো মেয়ে শিশু এবং ২১ বছরের আগে কোনো ছেলের বিয়ে না হয়। তাদের মেধা বিকাশে সবাইকে কাজ করতে হবে।


সিরাজুল ইসলাম
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) চ্যালেঞ্জ রয়েছে। রয়েছে কিছু আশার বাণীও। সবাই নগর সরকারের কথা বলছেন। যেহেতু নেই, তাই সমন্বয় প্রয়োজন। ডিএসসিসি মেয়র প্রতিটি ওয়ার্ডেই নূ্যনতম একটি খেলার মাঠ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছেন। ড্যাপ আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে। আমরা যেখানেই প্রয়োজনীয় জমির হদিস পাচ্ছি, সেখানেই খেলার মাঠ বা পার্ক সৃষ্টির উদ্যোগ নিচ্ছি। জলবায়ু-উদ্বাস্তু প্রায় দুই হাজার মানুষ প্রতিদিন রাজধানীতে থেকে যাচ্ছে। ফলে দিন দিন রাজধানীতে জনসংখ্যার হার বাড়ছে। পুরান ঢাকার চিত্রও একই। পুরান ঢাকায় জায়গা নেই। কখনও নির্দেশনা আসে- একেক ওয়ার্ডে একটি বা দুটি পার্ক দরকার। কিন্তু জমি পাব কোথায়? সেটা কিন্তু কেউ বলছেন না। একেকটা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অনেক জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। উদাহরণস্বরূপ আধুনিকায়নের জন্য নগরীর পান্থকুঞ্জ পার্কেও চারপাশ টিন দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল। কিন্তু কাজ থেমে থাকায় পুরো পার্ক পরিণত হয়েছিল জঙ্গলে। সাড়ে তিন বছর পর নকশা বদলে পার্কটি ব্যবহারের উপযোগী করার নির্দেশ দিয়েছেন ডিএসসিসি মেয়র। কারওয়ান বাজার মোড়ের এই পার্কটির নকশায় নানা উন্নয়নমূলক কাজের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু পার্কের একটি অংশে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা উড়াল সড়কের দুই থেকে তিনটি খুঁটি বসবে। মেয়রের নির্দেশে আগের পরিকল্পনা থেকে তাঁরা সরে এসেছেন। আপাতত পার্কের ভেতরে জন্মানো আগাছা পরিস্কার করে এটি নগরবাসীর ব্যবহারের উপযোগী করা হবে।
দেওয়ান আবদুল মান্নান
আজ জনপ্রতিনিধি হয়ে অপরাধী হয়ে থাকি, শিশুকে মাঠ দিতে পারি না। তারা খেলার জায়গা পায় না এবং ঘরের মধ্যে ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে বসে থাকে। দিনে দিনে নগরে মানুষ বাড়ছে কিন্তু এক ইঞ্চি মাঠ বাড়েনি। সিটি করপোরেশন ইচ্ছে করলে কোনো জমি অধিগ্রহণ করতে পারে না। নতুন মাঠ তৈরি করতে পারে না। সিটি করপোরেশন শুধু পুরোনো মাঠ সংস্কার করতে পারে। নতুন মাঠ করতে হলে রাজউকসহ সরকারের অন্য সংস্থার দ্বারস্থ হতে হয়। তাতেও নতুন মাঠ তৈরি করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। আগে যে খোলা মাঠ ছিল তা ব্যক্তি বা সরকারের অন্য সংস্থার ছিল। সময়ের পরিবর্তনে তাও দখল হয়ে গেছে।


ডা. আবদুল্লাহ শাহরিয়ার
রাজধানীর ৯০-৯৫ শতাংশ মা সন্তানের খাওয়া নিয়ে চিন্তায় থাকেন। তাঁরা চান, সন্তান শারীরিকভাবে সুস্থ হোক। কিন্তু কেউ চান না, তাঁদের সন্তান মানসিকভাবে সুস্থ থাকুক, বিকশিত হোক। অনেক ক্ষেত্রে দেখেছি, শিশুদের চেয়ে সংসারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তির চিকিৎসায় তাঁরা টাকা খরচে আগ্রহী। শিশুদের ক্ষেত্রে আগ্রহ নেই। করোনাকালে এও দেখেছি, ১৬ বছরের সন্তান হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছে। কারণ, এখনকার বেশিরভাগ শিশু অনলাইন ব্যবহারে ব্যস্ত। তারা নিজেদের প্রতি যত্নশীল নয়। এমনকি পরিবারের অভিভাবকরাও সচেতন নন। আবার শিশু বিকাশ কেন্দ্র বলতে অনেকেই মনে করেন, এখানে বোধহয় সব অসুস্থ শিশুই আসে। অথচ শিশু বিকাশ কেন্দ্রে সুস্থ শিশুরাও যে কাউন্সেলিং বা চিকিৎসাসেবা নিতে পারে- এ ধারণা নেই। অভিভাবকদের জানানো উচিত, শিশুদের মনোজাগতিক বিকাশ অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে আধুনিক শারীরিক শিক্ষা হলো- শিশুর ব্যক্তিসত্তার পূর্ণ বিকাশের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক ও শিক্ষাশ্রয়ী একটি প্রচেষ্টা। শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য দৈহিক, মানসিক ও সামাজিক দিকের বৈশিষ্ট্য এবং প্রয়োজন অনুযায়ী খেলাধুলার শিক্ষাসূচি প্রণয়ন জরুরি। রাজধানীর হাসপাতালগুলোর শিশু ওয়ার্ডে 'প্লে-কর্নার' করার পরিকল্পনা নেওয়াও খুব জরুরি।
ওয়াহিদা বানু
শিশুদের জন্য শিশুবান্ধব দেশ গড়তে হবে। আমরা প্রতিটি নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিতে শিশুদের জন্য বাজেটের কথা উল্লেখ করে থাকি। তাদের বিকাশে যেন কাজ করা হয়। শিশুরা খেলাধুলা করলে আত্মমর্যাদা, সাংস্কৃতিক চেতনা, মানবিক মূল্যবোধ বাড়ে। তাই তাদের সুষ্ঠু বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি বন্ধ পার্ক-মাঠ খুলে দিতে হবে, যাতে সেখানে শিশুরা খেলাধুলার সুযোগ পায়। এ ছাড়া প্রতিটি স্কুুলে ক্রীড়া, সংগীত ও চারুকলা শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।


মাহফুজা জেসমিন
আমরা খেলার মাঠ নিয়ে কথা বলি, কিন্তু আমাদের ক্রীড়াশিক্ষক নেই। গানের শিক্ষক নেই। চারুকলা শিক্ষক নেই। আমরা উন্নয়নের কথা বলি, উন্নয়ন হচ্ছে তা দেখতে পাচ্ছি। শিশুর বিকাশে বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নেই। শিশুর বিকাশে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বাড়াতে হবে। এটি শুধু স্কুলের ওপর ছেড়ে দিলে হবে না, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে তা বাড়াতে হবে।



মোস্তফা কামাল মল্লিক
রাজধানীর ১৩৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪১ ওয়ার্ডে কোনো পার্ক নেই। উন্নয়নের নামে আমাদের এ পার্কগুলো একটা সবুজ রঙের খাঁচা দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। হাজারীবাগে যে মাঠটি হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালে এই মাঠেই নির্বাচনী জনসভা করেছিলেন। এখন যদি সেই মাঠটিতে যান, হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন, তাহলে ওটাকে এখন আর মাঠ বলা যাবে না। গুলশানে যেসব খালি জায়গা রয়েছে বা বিত্তবানদের বাসার সামনে যে জায়গা থাকে- ঠিক তেমন মনে হবে। হাজারীবাগের ওই মাঠটি প্রায় সব সময় বন্ধ রাখা হয়। টেলিভিশন বা ক্যামেরা দেখলে তা খুলে দেওয়া হয়। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও মাঠ রক্ষার কথা বলেছেন, কিন্তু কাগজে কলমে বাস্তবায়ন দেখি না।
সৈয়দা রত্না
অনেক আগে থেকেই তেঁতুলতলা মাঠ উদ্ধারে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিলাম। বারবার হতাশ হচ্ছিলাম। অবশেষে মাঠ উদ্ধার করা গেছে। তবে আগে থেকেই সরকারের সহযোগিতা পেলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হতে হতো না। শিশুদের জন্য মাঠ রক্ষা করতে গিয়ে যেসব বিষয় লক্ষ্য করেছি, এর মধ্যে অন্যতম- শিশুদের বিকাশে সরকারের বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ আছে। অনেক শিশু সুবিধা ভোগও করছে। কিন্তু কলাবাগান রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র হলেও এখানের শিশুদের সৌভাগ্য হয়নি। ৫০ শিশু এ আন্দোলনে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল। তবে এ আন্দোলন প্রকাশ করেছি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। কবিতা-গান-কথা ছিল আন্দোলনের ভাষা। শিশুরা সংস্কৃতি চর্চার মধ্য দিয়েই মাঠ রক্ষা আন্দোলনে সক্রিয় ছিল।
ভারত চন্দ্র গৌড়
শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য উন্মুক্ত প্রান্তরে খেলাধুলার প্রয়োজনের কথা  সবাই বলে থাকেন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো- দেশের সর্বত্র, বিশেষ করে রাজধানীতে শিশুদের জন্য খেলার মাঠগুলোর বেশিরভাগই দখল হয়ে গেছে। সেখানে গড়ে উঠেছে বহুতল ভবন, কোথাও বা বাণিজ্যিক কেন্দ্র। অনেক মাঠই চলে গেছে বস্তির পেটে, অনেক মাঠ পরিত্যক্ত। আমাদের শিশুরা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবো। তাই সুস্থ-স্বাভাবিক জাতি গড়তে শিশুদের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ প্রয়োজন। তাদের খেলাধুলা, শারীরিক চর্চা, বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে।


গোলাম মোর্শেদ
আমার জন্ম হাজারীবাগ এলাকায়। আমি হাজারীবাগ পার্কেই খেলাধুলা করতাম। অথচ এখন এটা খাঁচার মতো। এ মাঠে ২৫০-৩০০ জন খেলতে পারতাম। মাঠটা এতই বড়, এক পাশে ছেলেরা খেলাধুলা করলেও অন্য পাশে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান হতো, সমাবেশ হতো। ২০১৯ সাল থেকে কোনো কারণ ছাড়াই মাঠটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায় বলাইশিমুল ইউনিয়নে ১০০ একর বা এরচেয়েও বেশি খাসজমি থাকলেও শতবর্ষের প্রাচীন বলাইশিমুল খেলার মাঠে আশ্রয়ণ প্রকল্প করা হচ্ছে। কোনো কিছুতেই প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি না পড়লে তা রক্ষা করা যায় না। হয়তো সেখানের মানুষের আন্দোলন এখনও প্রধানমন্ত্রী জানেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ জানিয়ে বলছি, শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে এই খেলার মাঠ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই ওই আশ্রয়ণ প্রকল্প যেন অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়া হয়।


আবু সাঈদ খান
শিশুর বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিদ্যালয় ও মাঠ দরকার। সরকার বিদ্যালয় করতে পেরেছে, খেলার মাঠ করতে পারেনি। যা ছিল তাও কমে যাচ্ছে। দিন দিন বেদখল হয়ে যাচ্ছে। বিপণিবিতান হচ্ছে, ভবন হচ্ছে। কয়েক দিন আগে তেঁতুলতলা মাঠ নিয়ে আন্দোলন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তা উদ্ধার হলেও অনেক মাঠই দখল করে নেওয়া হচ্ছে। আবার অনেক মাঠে ধনীর সন্তানরা খেলতে পারলেও ঢুকতে পারে না গরিবের সন্তান, বস্তিবাসী। অথচ সবার জন্য বাংলাদেশ। সব শিশুর জন্যই বিদ্যালয় ও মাঠ প্রয়োজন।

সুপারিশ
জাতীয় বাজেটে শিশুদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
বেদখল হওয়া মাঠগুলো উদ্ধার করে সংস্কারের মাধ্যমে সব শিশুর জন্য ব্যবহার উপযোগী করতে হবে।
তালাবদ্ধ হাটহাজারী মাঠসহ সব খেলার মাঠ শিশুদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে।
মেয়ে শিশুদের জন্য পৃথক খেলার মাঠের ব্যবস্থা করতে হবে।
খেলার মাঠ বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প সফল করতে সরকার, স্থানীয় সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।
শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সরকারি প্রতিশ্রুতিগুলো রক্ষা ও সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করতে হবে।
প্রতিটি বিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্রীড়া, সংগীত ও চারুকলা শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।
দেশের সব খেলার মাঠ যেন আর কখনও সরকারি বা বেসরকারি প্রয়োজনে ব্যবহার না করা হয়।
নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায় বলাইশিমুল ইউনিয়নের শতবর্ষের প্রাচীন বলাইশিমুল খেলার মাঠে নির্মাণাধীন আশ্রয়ণ প্রকল্প অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে হবে।
খেলার মাঠগুলোয় শুধু উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুদের অংশগ্রহণ নয়, বরং বস্তিবাসী ও নিম্ন আয়ের পরিবারের শিশুদের অংশগ্রহণও নিশ্চিত করতে হবে।
প্রধান অতিথি
এম এ মান্নান
মন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়
বিশেষ অতিথি
নজরুল ইসলাম
অতিরিক্ত সচিব, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়
মো. মুহিবুজ্জামান
অতিরিক্ত সচিব, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়

সৈয়দ ইমামুল হোসেন
অতিরিক্ত সচিব, শিক্ষা মন্ত্রণালয়

মূল প্রবন্ধ

চন্দন জেড গমেজ
সিনিয়র ডিরেক্টর, অপারেশনস অ্যান্ড প্রোগ্রাম কোয়ালিটি, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ

মো. আবু ইউসুফ
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

স্বাগত বক্তব্য

মঞ্জু মারীয়া পালমা
ডেপুটি ডিরেক্টর, আরবান অ্যান্ড রুরাল ক্লাস্টার, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ

আলোচক

সিরাজুল ইসলাম
প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন

দেওয়ান আবদুল মান্নান
১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন

ডা. আবদুল্লাহ শাহরিয়ার
অধ্যাপক, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট

ওয়াহিদা বানু
নির্বাহী পরিচালক, অপরাজেয় বাংলাদেশ

মাহফুজা জেসমিন
সভাপতি, চিলড্রেন অ্যাফেয়ার্স জার্নালিস্ট নেটওয়ার্ক (সিএজেএন)

মোস্তফা কামাল মল্লিক
সহসভাপতি, সিএজেএন

সৈয়দা রত্না
সমাজকর্মী

ভারত চন্দ্র গৌড়
শিক্ষক, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ ও ফিফার সাবেক রেফারি

গোলাম মোর্শেদ
শিশু প্রতিনিধি

সঞ্চালক
আবু সাঈদ খান
উপদেষ্টা সম্পাদক, সমকাল

সার্বিক তত্ত্বাবধানে
মীর রেজাউল করিম
অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড ক্যাম্পেইন কো-অর্ডিনেটর, আরবান প্রোগ্রাম, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ

জাকির হোসেন রোবেল
অপারেশনস হেড, আর্টিস্টিক কমিউনিকেশন

অনুলিখন
সাজিদা ইসলাম পারুল

লতিফুল ইসলাম
স্টাফ রিপোর্টার, সমকাল

উপস্থিত ছিলেন যোয়ান্না ডি'রোজারিও, টেকনিক্যাল ম্যানেজার, আরবান প্রোগ্রাম, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ রনেট লিও গমেজ, টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর, আরবান প্রোগ্রাম, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ

বিষয় : শিশুর সুস্থ বিকাশ

মন্তব্য করুন