জাতিসংঘ সনদের আলোকে বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হলেও তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ধীরগতিতে সম্পন্ন হচ্ছে। ২০১৫ সালে এই আইনের আলোকে যে বিধি হয়েছে, সেই বিধি অনুযায়ী বাজেটে বরাদ্দ রাখার কথা থাকলেও সেটি নেই, মনিটরিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার, সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করা বড় চ্যালেঞ্জ। পারিবারিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবেও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আইনগত সুরক্ষা জরুরি। ২৯ অক্টোবর রাজধানী ঢাকার তেজগাঁওয়ে সমকাল সভাকক্ষে 'প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ বাংলাদেশে বাস্তবায়ন পরিস্থিতি পর্যালোচনা' প্রতিপাদ্যে এক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকগণ এসব কথা বলেন। উইমেন উইথ ডিজঅ্যাবিলিটিজ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (ডব্লিউডিডিএফ), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও সমকাল যৌথভাবে এ বৈঠকের আয়োজন করে



মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম চৌধুরী
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় অনগ্রসর জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করে। অনেক সময় একক মন্ত্রণালয় হিসেবে আমরা অনেক কিছু করতে পারি না। যেমন- প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা আইন অনুসারে প্রবেশগম্যতার ইস্যুর কথাই যদি বলা হয়, তাহলে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা, যোগাযোগ ব্যবস্থায় যেসব বাহন রয়েছে, সেগুলো অনেকটাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহায়ক নয়। যেকোনো আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় যখন আমাদের ডাকা হয়, তখন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে এই বার্তাটি দিয়ে দিই। মেট্রোরেলের এক সভায় আমি গিয়েছিলাম। সেখানে এই বিষয়গুলো যখন এসেছিল, তখন আমাদের বক্তব্য ছিল যে, যাঁরা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার এবং যাঁরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, তাঁদের চলাচলের জন্য ব্যবস্থা রাখতে হবে। আমাদের দেশের গণপরিবহনের ব্যবস্থাপনা অতটা ভালো না।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ১২টি ক্যাটাগরিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের একটি ডাটাবেজ তৈরি করে সংরক্ষণ করছে। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গেলে এই তথ্য পাওয়া যাবে। আমাদের ডাটাবেজের ২৯ লাখ ২০ হাজার ২০৬ ব্যক্তির তথ্য সংরক্ষণ করা আছে। আমরা প্রাথমিকভাবে চিন্তা করছি যে, একটি ডাটাবেজ থাকলে এর সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সুযোগ-সুবিধার সংযোগ ঘটাতে পারব। এই ডাটাবেজে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের এলাকাভিত্তিক তথ্য পাওয়া যাবে। এটি আগে ছিল না। প্রতিবন্ধিতা নিয়ে আমাদের আইনি কাঠামো আছে। এখন যেটি প্রয়োজন, সেটি হলো আইনের বাস্তবায়ন। শ্রুতিলেখক নীতিমালার বিষয়ে আমরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে মতামত দিয়েছি। এছাড়া প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় শ্রুতিলেখকদের বিষয়ে নির্দেশনা থাকে। শ্রুতিলেখক নীতিমালা না এলেও, কিছুদিন আগে আমাদের একটি নিয়োগ পরীক্ষায় এ বিষয়ে নির্দেশনা পাঠিয়েছিলাম। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতা প্রক্রিয়া বর্তমান সরকারের আমলেই সর্বপ্রথম চালু হয়। শুরুতে মাত্র এক লাখ ভাতাভোগী ছিলেন। তখন ২০০ টাকা দিয়ে সেই ভাতা শুরু হয়েছিল। বর্তমানে ভাতাভোগীর সংখ্যা ২৪ লাখ ৬৫ হাজারের মতো। এর মধ্যে এক লাখ হচ্ছে শিক্ষাভাতা। শিক্ষা শেষে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য আমরা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি। আমাদের এতিম প্রতিবন্ধী প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেখানে তাদের জন্য উপযোগী বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এগুলো আমরা মাঝে মাঝে পর্যালোচনা করে দেখি যে, নতুন কোনো চাহিদা তৈরি হয়েছে কিনা। যেমন- আগে মোবাইল সার্ভিসিংয়ের প্রশিক্ষণ ছিল না, আমরা সেটি অন্তর্ভুক্ত করেছি। এছাড়া আইটিবিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণও যুক্ত করা হয়েছে। আমরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের জন্য এটুআইয়ের সহযোগিতায় চাকরি মেলার আয়োজন করে থাকি। ইআরসিপিএইচ নামে গাজীপুরে আমাদের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেখানে প্রতিনিয়ত দৃষ্টি ও অন্যান্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে স্থানীয় গার্মেন্টস কোম্পানিগুলোর সহযোগিতায় বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেখানে অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে চাকরির ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয়। সামনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতার পরিমাণ বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে।

ফারজানা নাজনীন তুলতুল
জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সনদটি মূলত তাদের জন্য একমাত্র আন্তর্জাতিক দলিল হিসেবে পরিচিত। এই দলিলটি অনুসমর্থনে যে ক'টি দেশ শুরুর দিকে অগ্রগামী ছিল, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এই সনদের আলোকেই সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ ও নিউরোডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন ২০১৩ পাস করেছে এবং সে অনুযায়ী বিধিও হয়েছে। এছাড়া ২০১৯ সালে আইন এবং বিধিমালার আলোকে আমরা একটি কর্মপরিকল্পনাও পেয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের সবার বক্তব্য হলো- প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে এতকিছু হওয়ার পরও তাঁদের উন্নয়ন প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। এর কারণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, সিআরপিডির কার্যকর বাস্তবায়ন তাঁরা দেখতে পারছেন না। এমনকি আইনের সঠিক বাস্তবায়নও তাঁরা দেখতে পারছেন না। প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইনের আলোকে যে কমিটিগুলো গঠন করার কথা রয়েছে, সেগুলো গঠিত হয়নি অথবা যেসব জায়গায় কমিটি হয়েছে তারাও ঠিকমতো প্রতিবেদন পাঠাচ্ছে না। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে একাধিকবার সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়কে আধাসরকারি পত্র দেওয়া হয়েছে। এতে কমিটিগুলোর কার্যক্রম বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে বলা হয়। একইসঙ্গে কমিটিগুলোতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বলা হয়। তবে কমিটিগুলো থেকে আমরা যে একেবারে সুফল পাচ্ছি না তা কিন্তু নয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, যাতায়াত, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে যোগাযোগ ও প্রবেশগম্যতার অধিকার সুনিশ্চিত করার বিষয়ে মানবাধিকার কমিশন সবসময় সজাগ দৃষ্টি রাখে। মানবাধিকার কমিশনের ১২টি বিশেষ কমিটির মধ্যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কমিটি রয়েছে। এই কমিটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। কমিশনের চেয়ারম্যান এই কমিটিতে সভাপতিত্ব করেন এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরাই এই কমিটিতে রয়েছেন। তাঁদের সুপারিশের আলোকে কমিশন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্নিষ্ট অথরিটির কাছে সুপারিশ পেশ করেন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর একটি দাবি হচ্ছে, সিআরপিডির ৩৩নং ধারা অনুযায়ী মনিটরিং কমিটিকে কার্যকর করা। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০০৯ সালে এই মনিটরিং কমিটি গঠন করলেও এই কমিটির কোনো অস্তিত্বই এখন দেখা যাচ্ছে না। এটি মানবাধিকার কমিশনের নজরে এলে, কমিশনের পক্ষ থেকে দু'বার পত্র পাঠানো হয়। তবে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে মনিটরিং কার্যকর হওয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। মানবাধিকার কমিশন মনে করে, সব ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে তাঁদের ধরন ও কর্মক্ষমতা অনুযায়ী যথাযথ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা উন্নয়নের ব্যবস্থা করলে তাঁরা কর্মে নিযুক্ত হতে পারবেন। তাঁদের সেই সুযোগটি দিতে পারলে তাঁরাও দেশের জিডিপির উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবেন এবং তাঁদের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন হবে।

দেখা যায়, ধর্ষণের শিকার কিংবা নির্যাতনের শিকার প্রতিবন্ধী নারী বিশেষ করে বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী নারীদের আইনগত সহায়তার বিষয়ে যেটি হচ্ছে, তা হলো- এসব নারীর যখন সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়, তখন তাঁদের সাহায্য করার জন্য 'সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটার' দরকার হয়। যাঁরা পেশাদার সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টাপ্রেটারের কাজ করে থাকেন, তাঁদের একটি সম্মানীর ব্যাপার থাকে। এক্ষেত্রে দেখা যায়, ভুক্তভোগীকেই সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটার জোগাড় করতে হয়। তাঁর পক্ষে সবসময় সম্ভব হয় না এসব পেশাদার ব্যক্তিকে আনা। যদিও অনেক সংগঠন এসব সহায়তা দিয়ে থাকে, সেখানেও ফান্ডের সমস্যা থাকে। এ বিষয়ে সমাজসেবা মন্ত্রণালয় এবং আইন ও বিচার বিভাগের মধ্যে সমঝোতা থাকা প্রয়োজন। এ সমস্ত মামলার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী যখন আদালতের কাছে আবেদন করবে বা আদালত বিষয়টি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠায় এবং মন্ত্রণালয় যদি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারপ্রেটার দিতে পারে, তাহলে ভুক্তভোগীর অনেক কষ্ট লাঘব হবে। তাঁদের বিচারপ্রাপ্তিতে অনেকখানি সুবিধা হবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যাতায়াত, যোগাযোগ এবং অবকাঠামোতে প্রবেশগম্যতার বিষয়টি সব সময়ের দাবি। এদেশের কোনো ভবনই প্রতিবন্ধীদের প্রবেশগম্য নয়। প্রবেশগম্য মানেই শুধু র‌্যাম্প স্থাপন নয়। আরও অনেক বিষয় আছে। সব ধরনের প্রতিবন্ধিতার বিষয়টিকে খেয়াল রেখে তাঁদের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে।


শিরীন আক্তার
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা আইন সিআরপিডির আলোকে হয়েছে। এই আইনে একটু ফাঁক রয়েছে। প্রতিবন্ধী নারীদের বিষয়টি এখানে উপেক্ষিত। এই আইনের আলোকে ৬৪ জেলায় কমিটি করার কথা ছিল। অথচ অনেক জেলা প্রশাসক এটি জানেনই না। এছাড়া প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঙ্গে, বিশেষ করে বাক ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঙ্গে কোনো অন্যায় হলে, সেটিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কেননা তাঁরা দোষীকে শনাক্ত করতে পারেন না। এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকেই ইশারা ভাষা জানা লোক জোগাড় করতে হয়, যা ব্যয়বহুল। অনেকে এই ব্যয় বহন করতে পারেন না বলে বিচার পান না। এ কারণে থানা এবং আদালতে ইশারা ভাষা জানা ব্যক্তিদের নিয়োগ করতে হবে।



নাসিমা আক্তার
বাজেটে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বরাদ্দ রাখার কথা থাকলেও সেটি নেই, মনিটরিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই। আমরা চাই, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনে যাঁরা আছেন, তাঁদেরও এই জায়গায় অংশগ্রহণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। কারণ আমার চাহিদা আমিই ভালো বলতে পারব। আমার প্রতিবন্ধী ভাই-বোনেরা কী চাচ্ছেন, সেটি আমার কাছ থেকেই শুনতে হবে। আমাদের বিষয়টি কেবল সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় দেখে। আমরা কোনো বিষয়ে যখন অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ে যাই, আমাদের স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয় যে, সেই মন্ত্রণালয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সঙ্গে কোনো কাজ নেই। তাঁরা আমাদের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করতে বলেন। শুধু সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মধ্যেই কি আমরা সীমাবদ্ধ? তা কিন্তু নয়। আমার শিক্ষার অধিকার আছে, স্বাস্থ্যের অধিকার আছে, কর্মসংস্থানের অধিকার আছে, তাহলে আমি কেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভর করে থাকব? আমার মনে হয়, এ বিষয়টি নিয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। এদেশে একটিও গণপরিবহন নেই যেখানে আমি আমার সুবিধা মতো ব্যবহার করতে পারব। আমি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে উবারে করে এসেছি। এটি আমার মতো প্রতিবন্ধী নারীর জন্য ব্যয়বহুল। এই বিষয়টিও আমাদের দেখতে হবে। সর্বোপরি, প্রবেশগম্যতা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু। প্রতিবন্ধীদের মধ্যে নারী আরও বেশি পিছিয়ে রয়েছে। কিন্তু এদেশের প্রতিবন্ধী সুরক্ষা আইনে নারীর কথা বলা নেই। দেশের জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালার ৩৯ নং অনুচ্ছেদে প্রতিবন্ধী নারীর কথা বলা আছে। কিন্তু সেই অনুচ্ছেদ বাস্তবায়নে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই প্রতিবন্ধী নারীর চাওয়াটাকে গুরুত্ব সহকারে দেখা দরকার। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসতে হবে।


সুশান্ত কুমার দাশ
ইউএনসিআরপিডির সনদে যতগুলো ধারা আছে, তার মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তার কথা বলা আছে। প্রতিবন্ধী মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি সরকারকে জোরালোভাবে দেখতে হবে। দৈনন্দিন জীবনে একজন মানুষের যতটুকু খাদ্য প্রয়োজন, সে অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্রয় ক্ষমতা নেই। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেরই ৬০ টাকা বা ৭০ টাকায় চাল কেনার ক্ষমতা নেই। এদেশের অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি দারিদ্র্যের সীমারেখার নিচে বাস করে। এদেশের দুই কোটি ৪০ লাখ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধিতার শিকার। জরিপ করলে বোঝা যাবে কতজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আয়ের সঙ্গে যুক্ত আছেন, কতজন নেই। এসব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, তাঁদের চিকিৎসা, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিনিয়ত যে দরকার, এ বিষয়ে দেশের নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়ন করতে হলে দেশের প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে আলাদা আলাদা বরাদ্দ রাখতে হবে। আমরা প্রতি বছরই সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসি। সেখানে আমরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উপযোগী বাজেট রাখার দাবি জানাই। কিন্তু দেখা যায়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় চেষ্টা করলেও অর্থ মন্ত্রণালয় সেভাবে সহযোগিতা করেনি। আগামী বাজেটে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ অন্য মন্ত্রণালয়গুলোর উচিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বিষয়টি লক্ষ্য রাখা। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতা ৮৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। যে দেশে এক কেজি তেলের দাম ২২০ টাকা, সেখানে একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি তাঁর সামান্য মাসিক ভাতায় ঠিকভাবে চলতে পারবেন না। তাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শুধু ভাতা প্রদানই নয়, তাঁদের আয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। আমি প্রতিবন্ধী হিসেবে আয় করতে চাই, ভাতা চাই না। আমার জন্য সেই পরিবেশটা কি আছে? গণমাধ্যম তাদের লেখনি ও প্রচারণার মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দাবি-দাওয়ার বিষয়টি সবার সামনে তুলে ধরতে পারে। এটি যদি গণমাধ্যম করে, তাহলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়ন হবে, এটি আমরা বিশ্বাস করি। আমি দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনে কাজ করছি। অনেক সাংবাদিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন, তাদের পক্ষে লিখেছেন। কিন্তু একটি প্রচারমাধ্যমে আমাদের নিয়ে কটাক্ষ করা হয়েছে। আমি জোরালো আবেদন জানাই, এ ধরনের প্রচার যেন সেই টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করে। আমরা চাই গণমাধ্যম আমাদের পাশে থেকে যেন সহযোগিতা করে।


বশির আল হোসাইন
২০১৩ সাল থেকে জাতীয় তৃণমূল প্রতিবন্ধী সংস্থা ইউএনসিআরপিডির বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে। প্রায় সব জেলা থেকে অন্যান্য সংস্থার সহযোগিতায় তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এসব কাজে দীর্ঘদিন ধরে ব্লাস্ট সহযোগিতা করছে। মূলত প্রতিবেদন তৈরির কাজ করি আমরা। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় বলছি, এর মধ্যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩ করা হলেও এই আইনের অধীনে ৫টি স্তরের কমিটিগুলো সক্রিয় নয়। প্রতিবছর এ কমিটিগুলোর প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও তারা তা করছে না। সমাজসেবা অধিদপ্তরের অনেকেই জানেন না যে কমিটি রয়েছে বা তাদের কাজ কী। জেলা কমিটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে 'ডিসি' দায়িত্ব পালন করলেও অন্য ৪০-৪৫ কমিটির মিটিং একসঙ্গে করেন। সেখানেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারের বিষয়গুলো আসে না। রাজধানী ঢাকাতে যেসব 'শহর সেবা কার্যক্রম' আছে, সেসব সুবিধা অনেকেই পাচ্ছেন না। কারণ, বেশিরভাগ কার্যক্রম ভাড়া বাড়িতে করা হয়, ওইসব জায়গায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সহজে যেতে পারেন না।


নাসরিন মনসুর
২০১৩ সালে প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষায় যে আইন পাস হয়েছে, তার কোনো কার্যকারিতা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এ বিষয়ে আমরা সরকারের কাছে আমাদের কিছু সুপারিশ জমা দিয়েছি। এর মধ্যে একটি দাবি হলো- সব প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জরিপ হওয়া দরকার। একইসঙ্গে জনশুমারিও সঠিকভাবে পরিচালনা করা দরকার। জনশুমারিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সঠিক সংখ্যা বের করা দরকার। অনেক সময় দেখা যায়, যাঁরা জনশুমারি করতে যান, তাঁরা এই বিষয়টি এড়িয়ে যান। আবার অনেক পরিবারও প্রতিবন্ধী কাউকে সামনে আনতে চায় না, তাঁদের কথা বলে না বা লুকানোর চেষ্টা করে। পরিবারেও প্রতিবন্ধীরা অবহেলার বস্তু হয়ে যায়। হাসপাতাল, আদালত, থানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ইশারা ভাষা ব্যবহার করার লক্ষ্যে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে সেখানে এ ভাষা জানা ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে, যাতে বাকপ্রতিবন্ধীদের কথা সহজে বোঝা যায়। যানবাহন, রাস্তাঘাট, ওভারব্রিজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, আদালত, দুর্যোগকালীন আশ্রয়কেন্দ্র, কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ সবখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ বৈষম্যের শিকার হন। কিন্তু সেদিকে আমরা তেমন একটা দৃষ্টি দিই না। এজন্য সরকারের উচিত তাদের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া। পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। আমাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতে সংশ্নিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া বাইরের কারও ঢোকার অনুমতি নেই। আমাদের দাবি, ক্ষেত্র মতো যুক্তিসংগত কারণে পারিবারিক পরিবেশে বিশেষ যত্ন ও পরিচর্যাবঞ্চিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিশেষত মানসিক অবস্থাজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য প্রতিষ্ঠানভিত্তিক পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ তাঁরা অনেক সময় আইনের সহায়তা নিতে গেলে হেনস্থার শিকার হন, তাঁদের সঙ্গে ভালো ব্যবহারও করা হয় না। অনেক সময় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাষাটাও পুলিশ বুঝতে চায় না। সে কারণে যাঁরা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ জানেন, তাঁদের রাখা যেতে পারে, যাতে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা তাঁদের কথাগুলো সহজভাবে বলতে পারেন।


সেলিনা আক্তার
'প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১' নামে একটি আইন আছে। এই আইনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংজ্ঞা এবং তাঁদের কীভাবে চিহ্নিত করা হবে, এই বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ছয়টি ক্যাটাগরি করা হয়েছে। এগুলো হলো- বাকপ্রতিবন্ধী, শারীরিকপ্রতিবন্ধী, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, মানসিকপ্রতিবন্ধী এবং বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধী। আইনে যেভাবে বলা হয়েছে, আসলেই কি সেভাবে তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে? তৃণমূল পর্যায়ে এখনও অনেক পরিবারে এ ধরনের একজন সন্তান এলে তাকে সমাজের আর দশজনের কাছ থেকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়। তাঁরা এই সন্তানকে কলঙ্ক হিসেবে বিবেচনা করে। যদি সরকারি পর্যায়ে এই ধরনের মানুষের জন্য ভালো বরাদ্দ করা হয়, তাহলে তাঁদের উন্নয়ন করা সম্ভব। আমাদের সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদে সকল নাগরিকের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া ২৮নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী সকলের সমান অধিকার রয়েছে। অন্যদিকে, প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইনে বলা আছে, জাতীয় পর্যায়ে তিনটি কমিটি থাকবে। সেই কমিটিগুলো সক্রিয় আছে কিনা অথবা আদৌ কোনো কমিটি করা হয়েছে কিনা- সেটিরও কোনো মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নেই। আমাদের আইন তো করা হয়, কিন্তু তার বাস্তবায়ন এবং মনিটরিং যদি না করা হয়, তাহলে যত আইনই থাকুক না কেন কোনো কাজে আসবে না। এসব আইন বাস্তবায়নের জন্য তদারকি খুবই জরুরি। এই আইনে জাতীয় সমন্বয় কমিটি, নির্বাহী কমিটি এবং জেলা কমিটির কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে, ২০১৩ সালে প্রণীত আইনে জাতীয় পর্যায়ে পাঁচটি কমিটি করার কথা বলা হয়েছে। এই কমিটিগুলো আদৌ করা হয়েছে কিনা, কমিটিগুলোর কার্যক্রম কী এবং সাধারণ মানুষের দ্বারপ্রান্তে তারা যাচ্ছে কিনা- এগুলো নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিগণ পিছিয়ে পড়বেন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এ বিষয়ে টাস্কফোর্স কমিটি ছিল। এই কমিটি এখন ধরতে গেলে নেই। হারিয়ে যাওয়া শিশু ও মামলার আসামি শিশুদের জন্য কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই। এ বিষয়ে অনেকদিন ধরে আলোচনায় ছিল যে, পুরান ঢাকায় পরিত্যক্ত একটি সম্পত্তি আছে, সেখানে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সুন্দর একটি আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা হবে। এই আলোচনা এখন আর নেই। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের অধীন আশ্রয়কেন্দ্র এবং সেইফ হোমগুলোতে নির্যাতনের শিকার প্রতিবন্ধী মেয়েরা আসে। তাঁদের সেখান থেকে রিলিজ করার পর কোথায় পুনর্বাসন করা হবে, এ বিষয়ে পর্যাপ্ত সরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্র নেই। দেখা গেল, একজন হারিয়ে যাওয়া বা নির্যাতনের শিকার বাকপ্রতিবন্ধী তাঁর ঠিকানা বলতে পারছেন না। তখন তাঁকে হয়তো স্বল্পমেয়াদে কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে দেওয়া হলেও, পরবর্তীকালে দীর্ঘমেয়াদে তাঁকে কোথায় দেওয়া হবে সে বিষয়ে পর্যাপ্ত কোনো ব্যবস্থা নেই। এ ব্যবস্থা রাখা খুবই জরুরি। বর্তমানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাতা যেটি দেওয়া হচ্ছে, সেটি যথেষ্ট নয়। এখানে তাদের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো দরকার, সমাজ যেন তাঁদের বোঝা মনে না করে। কোনো পরিবারে এ ধরনের পিছিয়ে পড়া সন্তান জন্মালে নারীকেই দোষারোপ করা হয়। দেখা যায়, এই সন্তানের জন্য তাঁর পরিবারই ভেঙে যায়। বাবাও কোনো দায়িত্ব নেন না। বলা হয়, মায়ের কারণে এই বাচ্চার জন্ম হয়েছে, তাই মাকেই এই বোঝা বহন করতে হয়। তাই মাকে যদি এই দায়িত্ব নিতে হয়, এক্ষেত্রে তাঁকে সেই সহায়তা কে দেবে? এই বিষয়টিকে চিহ্নিত করা দরকার। এক্ষেত্রে ঘরের সন্তান ঘরেই নির্যাতনের শিকার হয়। কাজেই এই বিষয়গুলো মনিটর করতে হবে।

রেজাউল করিম সিদ্দিকী
চলতি বছরের ২৫ আগস্ট প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদ বা সিআরপিডি 'কনক্লুডিং অবজারভেশন' দিয়েছে। এতে সুনির্দিষ্টভাবে ৭০টি সুপারিশ করা হয়। মূলত সরকারকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করার জন্যই এ সুপারিশগুলো দেওয়া হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে তাঁদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুললে তাঁরা দেশের উন্নয়নে শামিল হতে পারবেন। দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হবে। এছাড়াও, নিবন্ধ ১-৪ এ (সাধারণ নীতি ও বাধ্যবাধকতা) কমিটি সুপারিশ করে যে রাষ্ট্রীয় পক্ষ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার এবং সুরক্ষা আইন ২০১৩-এর পর্যালোচনা করে আইন, নীতি, কৌশল এবং কর্মপরিকল্পনাগুলোকে কনভেনশনের সঙ্গে কার্যকরভাবে সামঞ্জস্য করতে, যার মধ্যে প্রতিবন্ধী নারীর জন্য বিধানগুলো নিশ্চিত করা হয়। সাধারণ মন্তব্য নং ৭ (২০১৮) এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, কমিটি সুপারিশ করে যে রাষ্ট্রপক্ষ তাদের প্রতিনিধি সংস্থার মাধ্যমে, নারী ও প্রতিবন্ধী শিশুসহ সমস্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কার্যকর অংশগ্রহণ এবং অর্থপূর্ণ পরামর্শের জন্য আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়ন করবে। আর্টিক্যাল ৫ এ (সমতা এবং অ-বৈষম্য) লিঙ্গ, বয়স, জাতিগত, ধর্ম, বর্ণের ভিত্তিতে বৈষম্যের একাধিক ধরনসহ কনভেনশনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতিবন্ধিতাভিত্তিক বৈষম্যকে নিষিদ্ধ করার জন্য সংবিধান ও ২০১৩ সালের সংবিধান এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার এবং সুরক্ষা আইন পর্যালোচনা এবং সংশোধন করার কথা বলা হয়েছে। কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অথবা মনোসামাজিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্যমূলক এমন সমস্ত আইন ও নীতি বাতিল করার কথা বলা হয়েছে। দেরি না করে বৈষম্যবিরোধী আইন (২০১৫) গ্রহণ করা এবং নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। আর্টিক্যাল ৬ এ (প্রতিবন্ধী নারী) প্রতিবন্ধী নারী এবং মেয়েদের প্রতি বৈষম্যের একাধিক এবং আন্তঃবিভাগীয় রূপ মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করা, বিশেষ করে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অন্তর্গত প্রতিবন্ধী নারী, কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত নারী, বুদ্ধিবৃত্তিক অথবা মানসিক প্রতিবন্ধী নারী, প্রতিবন্ধী শরণার্থী; এবং লিঙ্গ, বয়স, জাতিগত, ভাষাগত এবং ধর্মীয় পটভূমি দ্বারা তথ্য সংগ্রহ করার কথা বলা হয়েছে। তাদের অধিকার রক্ষা করতে সমস্ত আইন ও নীতি সংশোধন করতে হবে। নিবন্ধ ৭ এ (প্রতিবন্ধী শিশু) বলা হয়েছে, পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ, মানবিক, প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক সংস্থানসহ প্রতিবন্ধী শিশুদের অধিকারের প্রচার ও সুরক্ষার জন্য একটি জাতীয় কৌশল তৈরি করতে হবে। নিবন্ধ ৮-এ (সচেতনতা) কমিটি সুপারিশ করে যে, সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচার অভিযান চালাতে হবে। সমান আইনি ক্ষমতা প্রয়োগের কথাও বলা হয়েছে। কমিটি সুপারিশ করে যে, ১৮৭২ সালের চুক্তি আইন, ১৮৮২ সালের সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, ১৯২৮ সালের হিন্দু উত্তরাধিকার (প্রতিবন্ধিতা অপসারণ) আইন এবং অন্য সমস্ত আইন ও নীতি বাতিল করতে হবে, যা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের, বিশেষ করে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি, প্রতিবন্ধী নারীদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় না। নিবন্ধ ৩১ এ কমিটি জাতীয় জনশুমারি এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় দ্বারা পরিচালিত প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ সমীক্ষায় সংখ্যালঘু অন্তর্ভুক্তসহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিনিধি সংস্থাগুলোর সঙ্গে অর্থপূর্ণভাবে পরামর্শ এবং অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছে। ষষ্ঠ পর্যায়ক্রমিক প্রতিবেদন যেন ২০২৯ সালের ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে জমা দেওয়া হয়।


তাজুল ইসলাম
ব্লাস্ট-ডব্লিউডিডিএফসহ অন্যান্য সংগঠন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। আপনারা জানেন যে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক সেই সনদ বাংলাদেশ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ সনদের একটি পক্ষ। ২০১০ সালে প্রথম একটি ইনিশিয়াল রিপোর্ট দেওয়া হয় জাতিসংঘের প্রতিবন্ধী অধিকারবিষয়ক কমিটির কাছে। সেই রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক অবজারভেশন দিয়েছে ওই আন্তর্জাতিক কমিটি। আমরা যেটিকে বলি বাস্তবায়নের কিছু দিকনির্দেশনা। এই গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনের মূল উদ্দেশ্যই হলো সেই নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশ কতটা অর্জন করতে পেরেছে, বা বাকিগুলো কীভাবে অর্জন করবে।


আবু সাঈদ খান
আমরা এমন একটি দেশে বসবাস করি, যে দেশে আইন আছে কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। অনেক আন্তর্জাতিক সনদ আছে, যেগুলোতে বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করলেও তা মানা হয় না। বাস্তবায়ন করা হয় না। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার। নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়েও অনেকেই সমাজে কাজ করছেন। প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। জায়গা করে নিয়েছেন। শত লাঞ্ছনা, বঞ্চনার মধ্য দিয়ে তাঁদের বেড়ে উঠতে হয়, পথ চলতে হয়। দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার, সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করা বড় চ্যালেঞ্জ। পারিবারিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবেও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অথচ মানুষ হিসেবে তাদের অধিকার বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে সংবিধানেও দিকনির্দেশনা রয়েছে। তাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারবিষয়ক সনদ বাস্তবায়ন খুব জরুরি।
আলোচক
মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম চৌধুরী
উপসচিব, পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) সমাজসেবা অধিদপ্তর
রেজাউল করিম সিদ্দিকী
আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট ও প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক ডিজঅ্যাবিলিটি অ্যালায়েন্স

তাজুল ইসলাম
আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট ও অ্যাডভোকেসি অ্যাডভাইজার, ব্লাস্ট

ফারজানা নাজনীন তুলতুল
উপপরিচালক (অভিযোগ ও তদন্ত), জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

শিরীন আক্তার
চেয়ারম্যান, প্রতিবন্ধী নারী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন (ডব্লিউডিডিএফ)

নাসিমা আক্তার
সভাপতি, প্রতিবন্ধী নারীদের জাতীয় পরিষদ

সুশান্ত কুমার দাশ
সভাপতি, জাতীয় তৃণমূল প্রতিবন্ধী সংস্থা

বশির আল হোসাইন
প্রোগ্রাম ম্যানেজার, জাতীয় তৃণমূল প্রতিবন্ধী সংস্থা

নাসরিন মনসুর
সেক্রেটারি, রোকেয়া সদন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

অ্যাডভোকেট সেলিনা আক্তার
সিনিয়র স্টাফ ল' ইয়ার, আইন ও
সালিশ কেন্দ্র

সঞ্চালক
আবু সাঈদ খান
উপদেষ্টা সম্পাদক, সমকাল

অনুলিখন
সাজিদা ইসলাম পারুল

নিজস্ব প্রতিবেদক

মাজহারুল ইসলাম রবিন
নিজস্ব প্রতিবেদক

ইভেন্ট সমন্বয়
হাসান জাকির
সমকাল