- গোলটেবিল
- সামাজিক নিরাপত্তা কার্যকরে সেবাকে স্থানীয়করণ করতে হবে
সামাজিক নিরাপত্তা কার্যকরে সেবাকে স্থানীয়করণ করতে হবে

সরকার জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়ন করেছে। কিন্তু সরকারের এসব কার্যক্রম কেন্দ্রীয়ভাবে কার্যকর করায় সফলতা আসছে না। সরকারের এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী আর স্থানীয়করণ করে সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলে সংস্কার আনতে হবে। এসব ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ের বাস্তবতার আলোকে তৃণমূলের অংশগ্রহণে সংস্কার করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের সামাজিক নিরাপত্তায় জোর দিতে হবে। জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়নের সময় স্থানীয় পর্যায়ে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সরবরাহ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে জনমুখী সংস্কার কার্যকর করতে জনপ্রশাসনের সঙ্গে জনগণের অংশগ্রহণকে যুক্ত করতে হবে। গত ২৮ নভেম্বর সোমবার দৈনিক সমকাল ও রূপান্তর আয়োজিত 'সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল ও অগ্রগতি' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। সুইজারল্যান্ড সরকারের অর্থায়নে রূপান্তর বাস্তবায়িত করোনা অতিমারিতে জরুরি পুনর্বাসন উদ্যোগ প্রকল্পের আওতায় এ গোলটেবিলে রূপান্তর গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়
শেখ মো. মনিরুজ্জামান
সরকারের সঙ্গে এনজিওগুলো সমন্বিত কাজ করলে প্রকৃত উপকারভোগীরা সুবিধা পেত। সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল নিয়ে এনজিওগুলোর কাজ করার সুযোগ থাকলে সেবা প্রদানে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে বলে আমি মনে করি। সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধাপ্রাপ্তি ও মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকা থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল অনেক পিছিয়ে আছে। কিন্তু যার যেটা প্রয়োজন, তাকে সেই সুবিধা দেওয়া যাচ্ছে না; প্রকৃত দরিদ্র নির্ধারণ হচ্ছে না। প্রতিটি উপজেলায় যদি একটি তালিকা করা যেত, তাহলে তাদের ইউনিক আইডির মাধ্যমে সাহায্য করা যেত। যারা সরকারি অনুদান পায়, তাদেরও চিহ্নিত করা যেত। তাদের পুনরায় এনজিওগুলো অনুদান না দিয়ে বাকিদের দিতে পারত বা তালিকা ধরে অতিদরিদ্রদের স্বাবলম্বী করতে কাজ করতে পারত।
খুলনা অঞ্চলসহ দক্ষিণাঞ্চলে উপকূলে মানুষ সব সময় ঝুঁকির মধ্যে থাকে। তাদের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সব ধ্বংস করে দেয়। তাদের সাময়িক সহযোগিতার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। হিজড়া শ্রেণির লোকদের ভাতার ব্যবস্থা এবং শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া রোধে কাজ করছে সরকার। এখনও সরকারের অনুদান প্রদানে নির্দিষ্ট কর্মকর্তা তেমন নেই। অনেক উপজেলায় সমাজসেবা কর্মকর্তা না থাকলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে কাজ করতে হয়। ইউনিয়ন চেয়ারম্যানরাও সঠিকভাবে কাজ করেন না। চৌকিদাররাই মূলত এ কাজ করে থাকেন। এ ক্ষেত্রেও সরকারি অনুদান প্রদানে অসুবিধা হয়।
এ কে এম মাসুদ আলী খান
সরকার জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়নের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এই সংস্কার কাঠামো চারটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছে। জীবনচক্রের সঙ্গে ঝুঁকির সম্পর্ক, সেবার গুণগত মান, সেবাগ্রহীতাদের অন্তর্ভুক্তি এবং এসব বিষয়ের সমন্বয় সাধন। এসব ক্ষেত্রে সংস্কার স্থানীয় পর্যায়ের বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে করতে হবে। অর্থাৎ কৌশলপত্র বাস্তবায়নে সংস্কারের স্থানীয়করণ করতে হবে। জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলের সংস্কার কর্মসূচি তৃণমূলের বাস্তবতায় সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের সামাজিক নিরাপত্তায় জোর দিতে হবে। ক্রমাগত ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস আর লবণাক্ততায় খুলনাঞ্চলে ব্যাপকতর সামাজিক নিরাপত্তার জোরালো চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গরিব মানুষের চিরাচরিত সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও নারীদের প্রতি সমাজের অসমতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণ। টিকে থাকার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির প্রতি এসব প্রান্তিক মানুষের নির্ভরশীলতা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলের এ বাস্তবতায় জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে সংস্কার জরুরি। এর আগে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল প্রণয়নের সময় স্থানীয় পর্যায়ে সবার অংশগ্রহণ ছিল না। কর্মসূচি সফল করতে নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণমূলকভাবে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হবে। সরবরাহ ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে জনমুখী সংস্কার কার্যকর করতে জনপ্রশাসনের সঙ্গে জনগণের অংশগ্রহণকে যুক্ত করতে হবে।
এ সময় তিনি সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে তৃণমূল জনগোষ্ঠীর অসহায়ত্বের ধরন ও মাত্রা অনুধাবন করে বাস্তবতার আলোকে কর্মসূচি গ্রহণ, জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট মোকাবিলায় নতুন কর্মসূচি গ্রহণ, জীবনচক্রকেন্দ্রিক অসহায়তা ও ঝুঁকি নিরসন কর্মসূচি, খুলনা সিটি করপোরেশনের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মকৌশল, স্বাস্থ্য ও জলবায়ুকেন্দ্রিক কর্মসূচি, জাতীয় বাজেটে স্থানীয় সুপারিশ বাস্তবায়ন, সরবরাহ ব্যবস্থা বৃদ্ধি, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি অভিজ্ঞতার প্রাধান্য, সুশাসনের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কেন্দ্রে ও স্থানীয় পর্যায়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মূল্যায়ন গ্রহণ করার সুপারিশ করেন।
ড. মোকতার হোসেন
জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল সম্পর্কে এখনও অনেক সরকারি কর্মকর্তা, এমনকি জনপ্রতিনিধিরাও অবহিত নন। ফলে সমাজে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৭.৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে। বৈশ্বিক অর্থনীতির অবস্থার কারণে এ অর্থবছরে নতুন কোনো ভাতা যুক্ত করা হয়নি। ২৬২ উপজেলায় ১০০ শতাংশ বয়স্ক ভাতা করা হয়েছে; বাকি উপজেলাগুলোকেও দ্রুত আওতাভুক্ত করা হবে। সমাজের বিধবা, প্রতিবন্ধীদের ভাতা দেওয়া হচ্ছে। বেদে আর হিজড়াদেরও ভাতা দেওয়া হচ্ছে। হিজড়া ও ভিক্ষুক পুনর্বাসনে বাজেট দেওয়া হচ্ছে। পরিচয়হীন শিশুদের জন্য শিশু মণিনিবাস এবং পরে শিশু পরিবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সমাজের ১ কোটি ১০ লাখ মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনা হয়েছে। যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে এবং সেবা খাতগুলোকে মজবুত করতে সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা। জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বিশাল প্রভাব সামাজিক নিরাপত্তায় পড়ে। উপকূলীয় অঞ্চলে যে সহযোগিতা করা হয় তা যথেষ্ট নয়। এ অঞ্চলের মানুষ অনেক ঝুঁকিতে আছে। তাদের প্রধান সমস্যা পানি সমস্যা। সরকারের খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচিতে তাদের জন্য পরিকল্পনা আছে। সরকারি অনুদান দিতে কোনো নির্দিষ্ট আইডি নেই। সরকারের বিভিন্ন অনুদানে ভুয়া ব্যক্তিরা অনুদান পাচ্ছে। এটি বন্ধ করা যাচ্ছে না। সরকারের ২৩টি মন্ত্রণালয় ১২২টি ভাতা প্রদান করে। এখানে অর্থের অপব্যবহার অনেক হচ্ছে। তবে এখন মোবাইলে ভাতার টাকা পাঠানোর কারণে ভাতাভোগীদের কষ্ট কমানো হয়েছে। ক্যান্সার ও দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত রোগীদের জন্য সরকার অনুদান দিচ্ছে। জেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে দ্রুততার ভিত্তিতে তাদের এ অর্থ দেওয়া হয়। সরকারের সকল কার্যক্রম অপেশাদার লোক দিয়ে করানো হয় না। তবে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় সব ব্যক্তিকে আনতে সবার তথ্য কালেক্ট করে ইউনিক আইডি প্রণয়নের মাধ্যমে স্বচ্ছতা আনা হবে।
পারভেজ সিদ্দিকি
সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের অনেক সংস্থা ও বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। কিন্তু তারা সবাই নিজেদের মতো করে কাজ করছে। তাদের নিজেদের মধ্যে সমন্বয় নেই। প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের চাহিদা বেশি। কিন্তু সেখানে এনজিও কম। আবার কাজ করলে সমন্বয় নেই। তাই প্রান্তিক সুবিধাভোগী মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এনজিওগুলোকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে হবে। সর্বোপরি সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
ওয়াজেদ ফিরোজ
সামাজিক নিরাপত্তা খাতে রাষ্ট্রের এত বড় উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও অনেকেই আস্থা-অনাস্থার দোলাচলে থাকে। কারণ, কেন্দ্র থেকে আমাদের এত বড় জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ কার্যক্রম সেবার মধ্যে নিয়ে আসা অনেক জটিল আর অপেশাদার। আমাদের যে নীতিগুলো আছে, সেগুলোর সমন্বয় জরুরি। এত বড় জনগোষ্ঠীকে সেবার মধ্যে আনতে ধাপে ধাপে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। সেখান থেকে বের হতে হলে কার্যক্রম সেবা স্থানীয়করণ করতে হবে। কর্মসূচিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে। আমাদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি নয়। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী বা সেবা প্রক্রিয়াকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। আমাদের নগর আর গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিকল্পনামাফিক গড়ে তুলতে হবে। আমাদের নগরায়ণ খুব দ্রুত আকারে হচ্ছে, যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিকল্পনা করা যাচ্ছে না; এলোমেলো উন্নয়ন হচ্ছে। বড় বড় অবকাঠামো হচ্ছে নগরকেন্দ্রিক। আবার গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন হলে সেখানেও নির্দিষ্ট পরিকল্পনায় হচ্ছে না। আর গ্রামীণ উন্নয়ন কাঠামোর পরিকল্পনা থাকলেও সেটা টেকসই না। গ্রামের উন্নয়ন হয় ইউনিটভিত্তিক ইউনিয়ন পর্যায়ে। কিন্তু পাশের ইউনিয়ন, উপজেলা আর জেলার সঙ্গে পরিকল্পনামাফিক উন্নয়ন না হওয়ায় তা টেকসই হচ্ছে না। নগর উন্নয়ন আর গ্রামীণ উন্নয়নের সমন্বয় করতে হবে। নগরের উন্নয়ন করতে করতে এমন অবস্থা তৈরি হচ্ছে, যেন গ্রাম হারিয়ে ফেলছি। আমাদের স্থানীয় সরকার সহযোগী প্রোগ্রাম তৈরি হয়েছে আরও ১৮-১৯ বছর আগে। যার এখন প্রয়োজন ও গুরুত্ব সময়োপযোগী নয়। কিন্তু এখনও গ্রামীণ উন্নয়ন সবকিছুর স্থানীয় সরকার সহযোগী প্রোগ্রামের আলোকেই হচ্ছে। আবার পরিকল্পনা হয়েছে এত বড় জনগোষ্ঠীর ভৌগোলিক দুর্যোগ জলবায়ু পরিবর্তনের চিন্তাকে বাদ দিয়ে। কিন্তু আমাদের কোনো অঞ্চলে একেক সময় বন্যা হয়, কোনো অঞ্চলে জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা হয় আবার কোনো অঞ্চলে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। দুর্যোগের সময় ও ধরন আলাদা। তাই সবাইকে সামাজিক নিরাপত্তায় আনতে যুগোপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
শামসুল হুদা বাদল
শুধু সামাজিক উন্নয়ন নয়, যে কোনো ধরনের উন্নয়নে কর্মসূচিতে পরিকল্পনা গ্রহণ করা সহজ। কিন্তু মূল জায়গাটা পরিকল্পনার বাস্তবায়নে জনসম্পৃক্ততা আর গণতন্ত্রীকরণের চ্যালেঞ্জ, সেটা আমরা পূরণ করতে পারিনি। সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলে আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি কিন্তু স্থানীয়ভাবে সম্পৃক্ত করিনি। সমাজের সবাইকে নিরাপত্তা দিতে স্থানীয় সরকারকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে একটি কাঠামো তৈরি করতে হবে। আর এতে সিভিল সোসাইটির পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় মূল নিয়ন্ত্রক তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে।
তোফাজ্জল হোসেন মঞ্জু
২০১৫ সালে অনুমোদিত আমাদের জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলটি যথেষ্ট শক্তিশালী। প্রতিটি মন্ত্রণালয় পৃথকভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। কিন্তু স্থানীয়ভাবে এত বড় প্রভাবশালী কৌশলটি জানে না। এ নীতির মাধ্যমে এটি সামাজিক নিরাপত্তা সংগঠিত হবে, তা স্থানীয়ভাবে জানানোর বা সচেতনতার কোনো উদ্যোগও নেই। স্থানীয় পর্যায়ে বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে সরকারি কর্মকর্তারাও জানেন না। সরকারি উদ্যোগে এ কৌশলপত্র অনুযায়ী কেন্দ্রীয়ভাবে কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় কিন্তু স্থানীয়ভাবে জানেই না। পরিকল্পনাটি প্রণয়নের পাঁচ বছর পার হলেও এটি এখনও রাজধানীর বাইরে যেতে পারেনি। স্থানীয়ভাবে বাস্তবতার আলোকে পরিকল্পনা যেটি দরকার সেটি এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। তাই সমাজের সকল স্তরে নিরাপত্তা পৌঁছে দিতে স্থানীয়ভাবে গুরুত্ব দিয়ে কৌশলপত্রটি আরও সংযোজন করতে হবে। স্থানীয়ভাবে গুরুত্ব দিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
শিক্ষাবিদ শরীফ শামসির
বাংলাদেশ যখন উন্নয়নের ধারায় আছে, তখন তৃণমূলের মানুষ অত্যন্ত নিঃস্ব ও বঞ্চিত। দেশের জলবায়ু আঘাতপ্রাপ্ত দক্ষিণাঞ্চলের মানুষগুলো সামাজিক নিরাপত্তায় অনেক পিছিয়ে। তারা বারবার ঘূর্ণিঝড়ে আবাস হারিয়ে নিঃস্ব। তাদের শুধু ভাতার ব্যবস্থা করলে হবে না, তাদের সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনতে হবে। দেশে সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলে আর্থিক অসচ্ছল মানুষ নির্ধারণে গণতান্ত্রিকভাবে চিহ্নিত করতে হবে। প্রান্তিক পর্যায়ে দারিদ্র্য বিমোচন বা সামাজিক নিরাপত্তার জন্য প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, এনজিওর মাধ্যমে দায়িত্ব নিয়ে তালিকা করতে হবে। সেখানে উপজেলা পর্যায়ে তালিকা অনুযায়ী ভাগ করে সুর্নিদিষ্ট দায়িত্ব নিয়ে তাদের সামাজিক নিরাপত্তায় কাজ করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তার জন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যত ধরনের বাজেট আছে সেগুলোর আন্তঃসমন্বয় করতে হবে। প্রতিটি খাতে সুনির্দিষ্টভাবে বাজেট দিতে হবে। স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি বাজেটে আনতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তার চাহিদা আছে তাদের চিহ্নিত করে তাদের পরিকল্পনামাফিক দায়িত্ব নিতে হবে। না হলে টাকা বরাদ্দ হবে কিন্তু উন্নয়ন হবে না। সর্বোপরি, সামাজিক নিরাপত্তাকে যে দৃষ্টিকে দেখা হোক না কেন, তাকে যদি উন্নয়ন গণতন্ত্র আমাদের সামগ্রিক নিরাপত্তার স্বার্থে দেখা না হয় তাহলে উন্নয়ন টেকসই হবে না।
রফিকুল ইসলাম খোকন
আমরা তৃণমূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সরাসরি কাজ করি, লক্ষ্য করি মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তার জন্য জাতীয় বাজেটের বরাদ্দ প্রদানে সমন্বয়হীনতা রয়েছে।
এ জন্য সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে স্থানীয় পর্যায়ের বাস্তবতার আলোকে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। তৃণমূলের মানুষ যেন বঞ্চিত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষার জন্য গৃহীত নিরাপত্তা কর্মসূচিতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলে লোকালাইজেশন তথা 'স্থানীয়করণ'কে গুরুত্ব দিতে হবে। আবার এ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তার জন্য জাতীয় বাজেটে ১৭ শতাংশ বাজেট রাখা হয়েছে। কিন্তু এসব বরাদ্দ বিতরণ আর সমন্বয় নিয়ে প্র্রশ্ন আছে। সরকারের ২৪টিরও বেশি বিভাগের মাধ্যমে এসব বরাদ্দ বিতরণ হয়। একেকজন পাঁচ-সাতটা প্রতিষ্ঠান থেকে অনুদান পাচ্ছেন। ফলে সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি হচ্ছে। তাই সামজিক নিরাপত্তার বাজেট বিতরণে কেন্দ্রীয় একটি তালিকার মাধ্যমে করলে সমন্বয়হীনতা দূর হবে। একজনের নাম একাধিক তালিকায় থাকবে না; সবাইকে সামাজিক নিরাপত্তায় আনা যাবে। আমাদের যে সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল আছে মাঠ প্রশাসনের অনেকেই সেটা জানে না। কারণ এর প্রচার কম।
শাহাদাত হোসেন বাচ্চু
আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠী উন্নয়নের স্রোতধারায় সংযুক্ত হচ্ছে, তাতে যেন কোনো নাগরিক পরিত্যক্ত না হয়। রাষ্ট্রের সবার সামাজিক নিরাপত্তা সর্বক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে। সরকারকে পরিকল্পনা নিতে হবে কোন কোন গোষ্ঠীকে সরকারি সুরক্ষার আওতায় সংযুক্ত করতে চায়। সবাই যেন সামাজিক নূ্যনতম সুরক্ষা পায়। একজন জনগণও যদি মনে করে রাষ্ট্র তাকে পরিত্যক্ত করছে, তা হলে তার ফলাফল পাবে না।
আবু সাঈদ খান
দেশ অনেক এগিয়ে গেছে, কিন্তু সঙ্গে বৈষম্যের সংখ্যাও বেড়েছে। শহরে আর গ্রামের মধ্যে বেড়েছে বৈষম্য। জাতির মধ্যে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, যাতে আর মানুষ বঞ্চিত না হয়। তৃণমূলে যারা আছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তারাও যেন খেতে পায়, তাদের যেন না খেয়ে না থাকতে হয়। চিকিৎসা পায়। তাদের সন্তান যেন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়। সরকার, রাষ্ট্র, জনগণ, নাগরিক সমাজ, এনজিও বিভিন্ন পর্যায়ে যারা কাজ করছেন সবাই মিলে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। উন্নয়ন মানে কেবল মেগা প্রজেক্ট নয়, উন্নয়ন মানে হচ্ছে সামগ্রিক উন্নয়ন। জীবন মানে উন্নয়ন কীভাবে করা যায়। বঙ্গবন্ধুর সবচয়ে বড় স্বপ্ন হচ্ছে, সবাই মিলে এগিয়ে যাওয়া। তাই আমরা সবাই মিলে কীভাবে এগোতে পারি সে ভাবনা করতে হবে। আমাদের যে জনগোষ্ঠী তার কোনো অংশে যেন কোনো কিছুর কম না থাকে। জনশক্তির কোনো অংশ যেন দুর্বল না থাকে। সব জায়গায় উন্নয়ন ও আলো যেন পড়ে। সেই ক্ষেত্রে দরকার হচ্ছে সমন্বয় সুশাসন সামগ্রিক উন্নয়ন ভাবনা।
আলোচক
শেখ মো. মনিরুজ্জামান
মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব)
এনজিওবিষয়ক ব্যুরো
ড. মোকতার হোসেন
পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা)
সমাজসেবা অধিদপ্তর
ওয়াজেদ ফিরোজ
নির্বাহী পরিচালক, ডেমক্রেসিওয়াচ
তোফাজ্জল হোসেন মঞ্জু
উন্নয়ন গবেষক
শিক্ষাবিদ শরীফ শামসির
সাবেক পরিচালক, মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র
পারভেজ সিদ্দিকি
নির্বাহী পরিচালক, ফিল্ম ফর পিস ফাউন্ডেশন
শামসুল হুদা বাদল
উন্নয়ন গবেষক
রফিকুল ইসলাম খোকন
নির্বাহী পরিচালক, রূপান্তর
শাহাদাত হোসেন বাচ্চু
পরিচালক, রূপান্তর
মূল প্রবন্ধ
এ কে এম মাসুদ আলী খান
নির্বাহী পরিচালক, ইনসিডিন
সঞ্চালক ও সভাপতি
আবু সাঈদ খান
উপদেষ্টা সম্পাদক, সমকাল
অনুলিখন
লতিফুল ইসলাম
নিজস্ব প্রতিবেদক
সমন্বয়
হাসান জাকির
হেড অব ইভেন্ট, সমকাল
মন্তব্য করুন