- গোলটেবিল
- কৃষিতে নারী: স্বীকৃতি এবং বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি
কৃষিতে নারী: স্বীকৃতি এবং বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি

কৃষিতে নারীর অবদান বাংলাদেশে এখনও একটি অবহেলিত বিষয়। পারিবারিক উৎপাদনে অংশগ্রহণ করেও তাঁরা পাচ্ছেন না স্বীকৃতি। সর্বোপরি সরকারি নীতি-কাঠামোয় অসামঞ্জস্য, বাস্তবায়নে শৈথিল্য এবং সীমাবদ্ধতা থাকায় উৎপাদন চক্রে অবদান রাখার ক্ষেত্রে নানামুখী সংকট ও ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হচ্ছে নারী কৃষককে। সেই সঙ্গে পুরুষ নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থার পাশাপাশি উপকরণ ঘাটতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ কাঠামোতে অনুপস্থিতি, জমিতে প্রবেশাধিকার না থাকা নারী কৃষকের এ চ্যালেঞ্জকে বাড়িয়ে তুলছে। এ অবস্থায় নারী কৃষকসহ প্রকৃত কৃষক ও খামারিদের হালনাগাদকৃত তালিকা অনুযায়ী প্রণোদনা, বিনাসুদে ও হয়রানি ব্যতিরেকে ঋণ, সরকারি সহায়তা প্রদানসহ বার্ষিক পরিকল্পনা এবং জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্টজন। গত ২০ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁওয়ের দৈনিক সমকাল সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। 'নারী কৃষকের অবস্থা :একটি জনবিশ্নেষণ' শীর্ষক এ বৈঠকের যৌথ আয়োজক সমকাল এবং একশনএইড বাংলাদেশ
মো. সায়েদুল ইসলাম
বাংলাদেশের কৃষি খাতে অর্জনগুলোর প্রধান সারথি নারী কৃষক। বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষির যে অবস্থা, এ ক্ষেত্রেও নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আগে মূলত কৃষিই অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি ছিল। এখনও রয়েছে। কিন্তু জিডিপির অর্থে এটি ক্রমান্ব্বয়ে কমলেও (১২ শতাংশ) শ্রমের ক্ষেত্রে এখনও ৪০ শতাংশের ওপরে। এই যে শ্রমশক্তি, সেখানেও নারীর অংশ বেশি। বীজ সংরক্ষণ থেকে শুরু করে উৎপাদনের সব প্রক্রিয়ায় নারী কৃষকের (৭০ শতাংশ) অংশগ্রহণ রয়েছে। বাংলাদেশ যে কয়টা ক্ষেত্রে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নারীর ক্ষমতায়ন ও কৃষিতে উন্নয়ন। এটি আমার ব্যক্তিগত বিশ্নেষণ। কৃষিশিক্ষায়ও নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। আপনারা জেনে থাকবেন, বঙ্গবন্ধু উন্নত কৃষির জন্য সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। অনাদিকাল থেকে বাংলাদেশের কৃষিতে নারীরা কাজ করে গেছেন, কিন্তু তাঁদের অবস্থার উন্নতি হয়নি। প্রতিদিন মাথাপিছু জমির পরিমাণ কমছে। অন্যদিকে প্রতি বছর ২০ থেকে ২২ লাখ মানুষ বাড়ছে। সব মিলিয়ে ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য নিশ্চিত করা কঠিন কাজ। তবুও আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। বিশ্বের প্রথম ১০টি খাদ্য উৎপাদনে এখন বাংলাদেশের অবস্থান ওপরের দিকে। আমরা পাট উৎপাদনে পৃথিবীতে দ্বিতীয়; ধান উৎপাদনে দ্বিতীয়। পেঁয়াজ উৎপাদনে তৃতীয়তম দেশ। মাছ ও নানা রকম সবজি চাষেও তৃতীয়। আম, আলু, পেয়ারা চাষে প্রথম ১০ দেশের কাতারে বাংলাদেশ। জমি কমে গেলেও বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষিচর্চার কারণে উৎপাদনে এগিয়ে। বর্তমানে কৃষিশিক্ষায় মেয়েরা এগিয়ে এসেছে। আমাদের অনেক বর্গাচাষি উপেক্ষিত। তাঁরা সহায়তা পান না এ কথা সত্যি। এ জন্য হালনাগাদ ডিজিটাল কার্ড সরবরাহ করা হবে। এ কার্ডে প্রতিনিয়ত তথ্য আপডেট করা হবে। এ ছাড়া সব রকম প্রশিক্ষণে ৩০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কৃষিঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সহজীকরণের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে এনআইডি কার্ড দিয়েই যেন ২ লাখ টাকা ঋণ নিতে পারেন কৃষক, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এ ছাড়াও বসতবাড়ির আঙিনায় ১০০টি সবজি চাষের পরিকল্পনা রয়েছে। নারী কৃষকরাই এটি করে থাকেন। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করাই আমাদের লক্ষ্য। নারী কৃষকের উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থার সমন্ব্বিত কার্যক্রম জরুরি।
বলাই কৃষ্ণ হাজরা
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে প্রযুক্তির সহযোগিতায় কৃষকের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে চাই। এ জন্য কৃষিঋণ প্রদানে প্রতিটি জেলা-উপজেলায় কৃষিমেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কৃষিমেলায় ব্যাংকার, কৃষি উদ্যোক্তা, কৃষক ও গণমাধ্যমের সবাই উপস্থিত থাকবেন। এ মেলার মাধ্যমে কৃষক যেন তাঁর কথা সরাসরি বলতে পারেন, সহজে ঋণ পেতে পারেন, সে ব্যবস্থা করাই আমাদের উদ্দেশ্য। শুধু 'এনআইডি' কার্ড নিয়ে ২ লাখ টাকা কৃষিঋণ পাবেন কৃষক। ইতোমধ্যে প্রত্যেক জেলা প্রশাসককে 'ডিও লেটার' দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকারদের সঙ্গে কৃষি কর্মকর্তাদের সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। যখন উৎপাদন বেশি হয়, তখন কৃষক কম মূল্যে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হন। কারণ তাঁদের উচ্চ সুদে বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নেওয়া থাকে। এসব ঋণের বেশিরভাগই ৩০ শতাংশ সুদ দিতে হয়। অথচ সরকার দিচ্ছে ৪ শতাংশ সুদে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের আরেকটি লক্ষ্য হচ্ছে নিরাপদ খাদ্য। নিরাপদ খাদ্য তৈরি করতে গেলে রাসায়নিক ও জৈব সারের পরিমিত ব্যবহার প্রয়োজন।
মো. আনোয়ার ফারুক
দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। গ্রামীণ নারীদের সম্পত্তিতে অধিকার নেই; শহুরে জীবনেই বা কী আছে! বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে বোনদের ভাগ দিতে চান না ভাইয়েরা। সভ্য সমাজেই এ অবস্থা। গ্রামে তো এর অস্তিত্বই নেই। এ জন্য গ্রামীণ নারীর উন্নয়নে 'জমির মালিকানা' নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র্রীয় ও ধর্মীয়ভাবে পরিবর্তন আনতে হবে। কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে সরকারের উদ্যোগ ও উৎসাহের কমতি নেই। ২০১৮ সালে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে কিন্তু বাস্তবায়নে তেমন পরিকল্পপ্পনা গ্রহণ করা হয়নি। তাই নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি মনিটরিং ব্যবস্থা ও বাস্তবায়নে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। কৃষি ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক দিক হলো 'কৃষিবিদ সিড'। দেশি-বিদেশি সবজি, ধান, ভুট্টা, আলুসহ বিভিন্ন জাতের উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের বীজ ব্যবহারে কৃষকের উন্নতি হয়েছে। কৃষি খাতে এখন মেয়েরা এগিয়ে এসেছে। ১৯৮২ সালে বিসিএস ক্যাডারে নারী ছিলেন না। ২০১৩ সালে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ ছিলেন নারী। ২০২১ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার ৪৬০-এ। সর্বক্ষেত্রে এখন নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। কৃষিশিক্ষায়ও নারীরা এগিয়ে আছেন।
এম এম আকাশ
লিঙ্গ অনুযায়ী কিষান-কিষানি আলাদা করা হয়েছে। কিষানি হচ্ছেন পরিবারের সদস্য। 'অ্যাজ অ্যা মেম্বার' তাঁর নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করার প্রতি মনোযোগ থাকে। মনোযোগ থাকে শিশুদের যত্নের ব্যাপারেও। ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাসের প্রতিও তাঁর মনোযোগ আছে। এ বোধশক্তি পুরুষের যতটুকু আছে, তার চেয়ে বেশি থাকে নারীদের। খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে নারীদের বেশি মনোযোগ থাকে 'কিচেন গার্ডেন'-এ। বসতবাড়িতে পরিকল্পিতভাবে টাটকা শাকসবজি, ফলমূল ও অন্যান্য খাদ্যের সহজলভ্য ও উত্তম উৎস এই কিচেন গার্ডেন। তারপর পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ভেঙে নারী যদি আঙিনা বা বাড়ি থেকে বের হতে পারেন, তাহলে তিনি দুই জায়গায় কাজ করতে পারেন। এক. নিজেদের জমি থাকলে সেখানে পুরুষের পাশাপাশি সমানভাবে ফসল উৎপাদন করতে পারেন। আর ফসল উৎপাদনে নিজস্ব কৃষিজমি যদি না থাকে বর্গাজমি নিয়ে তিনি কাজটা করতে পারেন। যদি বর্গাজমি বা নিজের জমিও না থাকে তাহলে তিনি 'নারী শ্রমিক' হিসেবে অন্যের জমিতে কাজ করেন। সুতরাং জমির সঙ্গে নারীর অধিকারের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশে মোট জমির পরিমাণ না কমলেও আবাদি জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। সরকার অল্প জমিতে বেশি ফসল ফলানোর লক্ষ্যে কাজ করছে। জমির সমস্যা সমাধানে 'ল্যান্ড ব্যাংক' খোলা জরুরি। যাঁরা নিজেদের জমি ব্যবহার করতে পারছেন না, তাঁরা এই ল্যান্ড ব্যাংকে জমা দেবেন। এ পদ্ধতিতে সরকার জমিগুলো আওতায় এনে বর্গাচাষিদের দিলে কার্যকর হবে। জমির মালিকও সরকারের কাছ থেকে সুবিধা পাবেন। এ ক্ষেত্রে কৃষকের 'ডিজিটাল কার্ড' লাগবে। তাতে সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত থাকবে। একই সঙ্গে যিনি কার্ড দেখে জমি বণ্টন করবেন, তাঁকে সৎ হতে হবে।
ফারাহ্ কবির
নারী কৃষকদের নিয়ে কাজ বোধ হয় একশনএইড প্রথম থেকেই করছে। আগামী বছর আমরা ৪০ বছরে পা দিচ্ছি। এই ৪০ বছরে সেই চরফ্যাসন, ভোলা, ঢালের চর, চর কুকরি-মুকরি, মনপুরা- এসব জায়গায় কাজ করতে গিয়ে দেখি, খাদ্যের বিষয়টা বারবার এসেছে। খাদ্যের সঙ্গে অধিকারের বিষয়টিও চলে এসেছে। আমরা নারী-পুরুষ উভয়কে নিয়েই কাজ করেছি। মতিয়া আপা যখন কৃষিমন্ত্রী ছিলেন, তখন তাঁকে নারী কৃষকদের কার্ড দেওয়ার বিষয়টি বলেছিলাম। বলেছিলাম তাঁদের স্বীকৃতির বিষয়ে। কারণ স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য তো চাইতে হবে। নারী কৃষক নিজেও জানেন না, তাঁর কী কী অধিকার আছে। তাঁদের স্বীকৃতি আদায় ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে ক্যাম্পেইন বাড়াতে হবে। ভিডিও-অডিও ক্যাম্পেইন, উঠান বৈঠক কিংবা কৃষক, উদ্যোক্তা, সরকারি কর্মকর্তা, সংশ্নিষ্ট এনজিও কর্মী ও বেসরকারি পর্যায়ের সমন্বয়ে মাঝেমধ্যে গোলটেবিল বৈঠক বা পর্যালোচনা সভা আয়োজন করা যেতে পারে। যেসব সুপারিশ উঠে আসবে, তা নিয়ে নীতিমালা প্রণয়ন বা আইন সংশোধন এবং বাস্তবায়নে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করা। বাজারকে কাঠামোগত ও সামাজিকভাবে নারীবান্ধব করা দরকার। কৃষিঋণের ক্ষেত্রে সরকার ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩০ হাজার ৯১১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে অন্তত ৩০ শতাংশ ঋণ যেন নারী কৃষককে দেওয়া যায়, তার জন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন জরুরি।
রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা
বাংলাদেশে নারী উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। শুধু কৃষকই নয়, এ খাতে 'ম্যানেজার' হিসেবেও ভূমিকা পালন করছেন নারী। যাঁদের স্ব্বামী বিদেশে কর্মরত, তাঁরা গ্রামেই খামার দিচ্ছেন। তবে এখনও সংকট আছে। সরকার বা বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা নারীর অবদানের স্ব্বীকৃতি দিচ্ছে; গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু পরিবার ও সমাজ থেকে এখনও মর্যাদা পাননি নারী। নারীর উন্নয়নে সবচেয়ে বড় বাধা এটি। সরকার কৃষকদের ৩১ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। সেই জায়গা থেকে ৩৮ শতাংশ ঋণ দেবে সরকারি ব্যাংক আর ৬২ শতাংশ ঋণ দেবে নির্দিষ্ট বেসরকারি ব্যাংকগুলো। অথচ নানা জটিলতার কারণে কৃষকরা ঋণ পাচ্ছেন না। এ ব্যবস্থা সহজ করতে হবে। এদিকে দেশে কোনো জেলায় নারী ঘর থেকে বের হতে পারছেন না; অন্য জেলায় মাঠে কাজ করছেন নারী। উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলা ও নোয়াখালীর দিকে তাকালেই এ পার্থক্য উপলব্ধি করা যায়। পরিবার থেকে অনেক নারীই সহযোগিতা পান না। যদি পেতেন, তাহলে কৃষি খাতে বড় ভূমিকা পালন করতে পারতেন।
কাকলী খান
প্রান্তিক পর্যায়ের নারীরা যে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করেন, তা বিক্রির জন্য ঢাকা শহরে কোনো ডিপো নেই বা এ রকম বাজার গড়ে ওঠেনি। ফসল উৎপাদনের সঙ্গে আরও অনেক বিষয় আছে- গবাদি পশু, মৎস্য চাষ, সামাজিক বনায়ন। তবে এসবের ক্ষেত্রে বিদ্যমান চিন্তা-কাঠামোই বিপত্তি হয়ে দাঁড়ায়। আমরা যখন কৃষক, খামারি, মৎস্য ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করি অথবা বৃহৎ কৃষি উদ্যোক্তার কথা ভাবি, তখন কিন্তু আমাদের চিন্তায় নারী থাকে না। পাশাপাশি গ্রাম থেকে যখন পণ্য শহরে নিয়ে আসা হয়, তখন জায়গায় জায়গায় চাঁদা দিতে হয়।
শওকত আকবর ফকির
নারী কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য কীভাবে বাজারজাত করা যায়, সে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। নারী কৃষকদের বাদ দিয়ে উন্নয়নের চিন্তা করা যাবে না। কৃষিনীতিতে নারী কৃষকদের জন্য একটা অধ্যায় সংযুক্ত করা হয়েছে। যেখানে আটটি অনুচ্ছেদ রয়েছে। তারপরও কিছুটা ঘাটতি বা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ভবিষ্যতে এই সীমাবদ্ধতা দূর করতে হবে এবং কৃষিনীতির প্রেক্ষাপটে বার্ষিক কর্মপরিকল্পপ্পনা করা গেলে নারী কৃষক উপকৃত হবেন।
মনির আহমেদ
দীর্ঘদিন ধরে নারী কৃষকের অধিকার আদায়ে আন্দোলন করছি। অথচ আজ পর্যন্ত নারী কৃষকের কার্ড দেওয়া হয়নি। উপজেলা পর্যায়ে যখন কৃষকদের কার্ড দেওয়া হয়, তখন নারী বা পুরুষ বিবেচনা না করে সবাইকে দেওয়া উচিত। একই পরিবারে দু'জন কৃষক হলে উভয়কেই কার্ড দিতে হবে। এটা অধিকার। বিশেষ করে সরকার যে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে, সেখানে নারীরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। সুতরাং এ প্রকল্প নারীর নামেই হওয়া উচিত।
কানিজ ফাতেমা
নারী কৃষকের স্ব্বীকৃতির দাবিটি সময়োপযোগী। ফসল উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত গবাদি পশু, মৎস্য চাষ বা সামাজিক বনায়ন; যাই হোক না কেন আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় বিদ্যমান চিন্তা-কাঠামো। আমরা যখন কৃষক, খামারি, মৎস্য ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করি অথবা বৃহৎ কৃষি উদ্যোক্তাদের কথা ভাবি, তখন আমাদের চিন্তায় নারী থাকে না। চিন্তার কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার দিক থেকে কৃষিকাজের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ, স্ব্বীকৃতি, মূল্যায়ন অদৃশ্য হয়ে যায়। নারীর মূল্যায়ন বা অবদান হারিয়ে যায়। সে প্রতিফলন নীতিগত কাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে পড়ে। সেখানেও নারী কৃষক উপেক্ষিত থেকে যান।
তাহমিনা বেগম
আমি সবসময় মাঠে কাজ করি। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই শিখেছি। বর্তমানে মরিচ, বাদাম, মুগ ডাল, তরমুজ চাষ করছি। এতে সরকারি কোনো সহযোগিতা পাচ্ছি না। এ কৃষিকাজের আয় দিয়েই সংসার চালাই। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করাই। অথচ কৃষকের স্বীকৃতি পাই না, কার্ডও পাই না। সরকারের সহযোগিতা পেলে অন্যদের চেয়ে ভালো কাজ করতে পারব।
রোজিনা বেগম
নারী কৃষি খাতে বেশি ভূমিকা রাখেন। সেই নারী কেন কৃষি কার্ড পান না? ধরা যাক, নারীর জমি নেই। পুরুষেরও জমি নেই। নারী ও পুরুষ উভয়েই যদি বর্গা চাষ করতে পারেন, তাহলে পুরুষকে কার্ড দেওয়া হলেও নারীকে কেন দেওয়া হয় না? বর্তমানে আমি সরিষা আবাদ করছি। কার্ড দিয়ে সার কিনতে গেলে কৃষি অফিসার আমার কার্ডের বদলে স্বামীর কার্ড চান। কারণ জানতে চাইলে বলেন, স্বামীর কার্ড দিয়েই সার কিনতে পারব। আমার কার্ড কার্যকর নয়।
রোকসানা বেগম
আমি সরাসরি মাঠে কাজ করি। এবার 'জয়িতা' হয়েছি। উৎপাদনের পাশাপাশি বাজারে ফসল বিক্রি করতে যাই। কিন্তু নানা সমস্যার সম্মুখীন হই। সন্তানকে দুধ খাওয়াতে পারি না। ছাউনি নেই। টয়লেট ব্যবহার করতে পারি না। তবে আগে বেরোতে পারতাম না। একশনএইড আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। কৃষিঋণ চাইতে গেলে জমির কাগজ লাগে, কতজনের সিগনেচার লাগে! আমরা সাধারণ কৃষক। এ রকম ঝুট-ঝামেলা কেমনে সামলাই! আবার ক্ষেতে কাজ করলে মজুরিও কম পাই। যে জায়গায় একই শ্রম দিয়ে পুরুষ পান ৬০০ টাকা, আমি নারী হওয়ায় পাই ২৫০ টাকা। এত বৈষম্য!
অমিত রঞ্জন দে
নারী কৃষকদের উৎপাদক হিসেবে বিবেচনা না করায় ভূমির অধিকার থেকে তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। পারিবারিক কৃষিকাজে অংশগ্রহণ করেও পাচ্ছেন না স্ব্বীকৃতি। সরকারি তথ্যানুযায়ী ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ গ্রামীণ নারী কৃষিকাজে জড়িত। ইতোমধ্যে সংশোধিত কৃষিনীতি ২০১৮-তে নারীরা যে কৃষক, সে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। প্রায় চার বছর অতিক্রান্ত হলেও এখনও সরকারের বার্ষিক পরিকল্পনা, বাজেট বা নীতি বাস্তবায়ন কৌশলে তার কোনো প্রতিফলন পাওয়া যাচ্ছে না। একশনএইড বাংলাদেশ কর্তৃক পরিচালিত 'নারী কৃষকের অবস্থা : একটি জনবিশ্নেষণ' সমীক্ষার উদ্দেশ্য হলো- কৃষিকাজে নিয়োজিত নারী কৃষকের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি আদায়ে নীতির সীমাবদ্ধতা নির্ণয় এবং নীতিতে উল্লিখিত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণ; কৃষিকাজে নারী-পুরুষের সমমজুরি, কৃষিসেবা, ঋণ ও বাজার ব্যবস্থায় নারী কৃষকের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পর্যায়ের স্টেকহোল্ডারের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে টেকসই খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা; কৃষির স্থায়িত্বশীলতা রক্ষা এবং পরিবেশ-প্রতিবেশসহ মানবস্ব্বাস্থ্য সুরক্ষায় তৃণমূলে অবস্থিত নারী কৃষককে ক্ষমতায়িত করা; নারী নির্যাতন প্রতিরোধ এবং কৃষিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা।
কৃষি খাতে নারীর সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি ও বিকাশে কৃষিনীতিতে ধারা যুক্ত করা হলেও তার বাস্তবায়ন নেই। নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দেশে ফসল উৎপাদনে বর্গাচাষি বা প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকরা মুখ্য ভূমিকা পালন করলেও সরকারি সুবিধা, কৃষি উপকরণ বণ্টনে নীতিমালায় বর্গাচাষিদের বিষয়টি উপেক্ষিত। ক্ষুদ্র কৃষকরা সরকারি কৃষি সহায়তার খুব সামান্যই পেয়ে থাকেন। কৃষি ব্যবসার ক্ষেত্রে উপজেলা কৃষি অফিসের সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ন্যাযমূল্যে ধান ক্রয়ের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সরকার যে পরিমাণ ধান কেনে, তাতে বাজারে কোনো প্রভাব পড়ে না এবং তাতে লাভবান হন মিল মালিক ও বড় কৃষকরা। খাদ্য মজুত করার মতো সরকারের পর্যাপ্ত গুদাম নেই। লটারির মাধ্যমে কৃষক নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু করা হলেও কৃষকের তালিকা হালনাগাদ না থাকায় প্রকৃত কৃষক সুবিধা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আবার অনেক সময় আর্দ্রতা বেশি দেখিয়ে ধান ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
বাজারে নারীবান্ধব পরিবেশের অভাব, নিরাপত্তা ঘাটতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ধারণা না থাকায় নারীরা বাজারে স্থায়ী হতে পারছেন না। কৃষি বিপণন নীতি অনুযায়ী বাজার কমিটিতে নারী সদস্য অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না। দলভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদানের ক্ষেত্রে নীতিমালায় ৩০ শতাংশ নারী সদস্য রাখা বাধ্যতামূলক করায় নারীদের যুক্ত করা হচ্ছে। তবে তা শুধু কোটা পূরণের উদ্দেশ্যে। কৃষিনীতিতে মজুরি বৈষম্য দূরীকরণ এবং নারী-পুরুষ সমমজুরি নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও মজুরি বৈষম্য রয়েই গেছে। কৃষিঋণ গ্রহণে জটিলতা থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকৃত কৃষক সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছেন। কৃষি উপকরণ সহায়তা প্রদানে কার্ড সিস্টেম চালু করা হলেও ব্যাপকসংখ্যক কৃষক সে আওতার বাইরে থেকে গেছেন। কৃষির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ভূমি হলেও নীতিতে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। সরকারি নীতি-কাঠামোর এই অসামঞ্জস্য, বাস্তবায়নে শৈথিল্য এবং সীমাবদ্ধতা থাকায় নারীকে উৎপাদন চক্রে অবদান রাখার ক্ষেত্রে নানামুখী সংকট ও ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
এ অবস্থায় নারী কৃষকসহ প্রকৃত কৃষক ও খামারিদের তালিকা হালনাগদ করা; হালনাগাদকৃত তালিকা অনুযায়ী প্রণোদনা, বিনাসুদে ও হয়রানি ব্যতিরেকে ঋণ এবং সরকারি সহায়তা প্রদান করা; নারী ও ক্ষুদ্র কৃষকদের কৃষি প্রণোদনা ও ভর্তুকি বৃদ্ধি এবং উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা; দুর্যোগকালীন কৃষক ও কৃষিপণ্যের বীমা চালু; বিভাগীয় ও উপজেলা পর্যায়ে বাজারে নারীবান্ধব নিরাপদ খাদ্যের ডিপো নির্মাণ; নারী ও ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও নতুন নতুন অভিজ্ঞতা সরেজমিন শিখনের ব্যবস্থা; পরিবেশ-প্রতিবেশ, জনস্বাস্থ্য ও জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা; ভার্মি কম্পোস্টসহ জৈব সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি; ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূউপরিস্থ পানি সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারে গুরুত্ব প্রদান করে আইনি কাঠামোর পরিবর্তন করতে হবে এবং আঙিনাসহ সার্বিক কৃষিতে নারীর ভূমিকার স্বীকৃতি, মজুরি বৈষম্য দূরীকরণসহ জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে বার্ষিক পরিকল্পনা এবং জাতীয় বাজেটে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা থাকতে হবে।
শেখ রোকন
কৃষি খাতে যে ২১ ধরনের কাজ রয়েছে, তার মধ্যে ১৭ ধরনের কাজই করেন নারী আর চারটা করেন পুরুষ। কিন্তু স্ব্বীকৃতির জায়গায় বা পারিবারিক কৃষিতে নারীর যে অংশগ্রহণ, তা প্রাত্যহিক কাজের অংশ হিসেবেই দেখা হয়। নারী যখন পারিবারিক গণ্ডি পেরিয়ে অন্যের জমিতে কাজ করছেন, তখন ভয়াবহ কৃষি মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। যেখানে পুরুষ পান ৭০০ টাকা, সেখানে দীর্ঘ সময় কাজ করেও নারী পান ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। স্ব্বীকৃতি প্রদানের পাশাপাশি শ্রম মজুরির বৈষম্য দূর করতে হবে।
মোজাম্মেল হোসেন
নারী কৃষকের স্ব্বীকৃতি প্রদানের এ দাবি সময়োপযোগী। সব সময়ই খুব জরুরি এ জন্য যে, কৃষি উৎপাদনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছেন নারী। কৃষির উদ্ভবই নারীর হাত ধরে। কিন্তু কৃষিতে সেই নারীর কী অবস্থা, কী ভূমিকা, এ সম্পর্কে সচেতন থাকি না। আড়ালেই থেকে যান নারী। কৃষির পদে পদে নারীর অবদান। একটা সময় কৃষক মাঠে কাজ করতেন। আর বাকি যে অনেক কাজ, মানে বাড়ির গরু দেখা, খড়কুটো করা, ধান মাড়াই ও সেদ্ধ করা, উঠানে শুকানোর কাজ থেকে সবকিছু নারী করতেন। ব্যক্তিগত সম্পত্তি পরম্পরার জন্য পুরুষের প্রাধান্য তৈরি হয়। বর্তমানে মাঠের কাজেও অংশ নিচ্ছেন নারী। এখন সাংগঠনিক, প্রশাসনিক কার্যক্রমে নারীর অংশগ্রহণ নজরে পড়ছে। নারীর ক্ষমতায়নের বিষয় পদ্ধতিগত ও নীতিগতভাবে কীভাবে আসতে পারে, সরকারের পাশাপাশি সবার সম্মিলিত চেষ্টায় তা এগিয়ে নিতে হবে।
আলোচক
মো. সায়েদুল ইসলাম
সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়
বলাই কৃষ্ণ হাজরা
অতিরিক্ত সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়
মো. আনোয়ার ফারুক
সাবেক সিনিয়র সচিব, কৃষি মন্ত্রণালয়
এম এম আকাশ
চেয়ারম্যান, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ফারাহ্ কবির
কান্ট্রি ডিরেক্টর, একশনএইড বাংলাদেশ
রেজাউল করিম সিদ্দিক রানা
কৃষিতথ্য বিশ্নেষক ও সহসভাপতি, খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক-খানি
কাকলী খান
কৃষি উদ্যোক্তা
মনির আহমেদ
সভাপতি, কেন্দ্রীয় কৃষক মৈত্রী
কানিজ ফাতেমা
সমন্বয়কারী, খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ
শওকত আকবর ফকির
সমন্বয়কারী, ওমেন ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট, একশনএইড বাংলাদেশ
তাহমিনা বেগম
নারী কৃষক, কলাপাড়া, পটুয়াখালী
রোজিনা বেগম
নারী কৃষক, ঘোড়াঘাট, দিনাজপুর
রোকসানা বেগম
নারী কৃষক, গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন
অমিত রঞ্জন দে
ডেপুটি ম্যানেজার, এফআরএসএল
একশনএইড বাংলাদেশ
সঞ্চালক
শেখ রোকন
সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান, সমকাল
সভাপতি
মোজাম্মেল হোসেন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, সমকাল
অনুলিখন
সাজিদা ইসলাম পারুল
স্টাফ রিপোর্টার, সমকাল
মন্তব্য করুন