- গোলটেবিল
- ভয়ের পরিবেশ তৈরিতে সফল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
সিজিএসের সেমিনারে বক্তারা
ভয়ের পরিবেশ তৈরিতে সফল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

প্রতীকী ছবি
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগই বেশি হচ্ছে। প্রতি মাসে সরকারি লোকজন গড়ে চারটি মামলা করেছে এ আইনে। ফেসবুকে মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে মাসে গড়ে ৯টি মামলা হয়েছে। ফলে যে ভীতির পরিবেশ তৈরি করার জন্য এ আইন করা হয়েছিল, তা সফল হয়েছে।
কী ঘটছে: বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর ব্যবহার প্রবণতা ও নিদর্শন' শীর্ষক ওয়েবিনারে গতকাল শনিবার আলোচকরা এসব মত তুলে ধরেন। সুশাসন, দুর্নীতি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা থিঙ্কট্যাঙ্ক সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) এই ওয়েবিনারের আয়োজন করে।
ওয়েবিনারে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা ও আটক-সংক্রান্ত পরিসংখ্যান তুলে ধরেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক ও সিজিএসের উপদেষ্টা আলী রীয়াজ। সিজিএসের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী ওয়েবিনারে সভাপতিত্ব করেন। সঞ্চালনা করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।
আলী রীয়াজ বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের উদ্দেশ্যই ছিল ভীতির পরিবেশ তৈরি করা। এটি সফল হয়েছে। এর মাধ্যমে এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে কেউ প্রতিবাদ না করে; সবাই সব সময় ভয়ে থাকে।
মনজুর আহমেদ চৌধুরী তাঁর বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করে আরও বলেন, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অবশ্য এ আইনের প্রয়োগ দেখা যায় না।
জিল্লুর রহমান বলেন, দেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন ও বাকস্বাধীনতার সংকট রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এই সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
গ্লোবাল টিভির প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, পরিসংখ্যানই বলে দেয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ বেশি হয়েছে। জামিন-অযোগ্য ধারার অপব্যবহার হয়েছে। প্রগতিশীলরা বেশি আক্রান্ত হয়েছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ল'র জ্যেষ্ঠ প্রভাষক সাইমুম তালুকদার বলেন, প্রশ্ন হচ্ছে, এই আইন কি জনগণের অধিকার রক্ষার জন্য, নাকি দমনপীড়নের জন্য? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বিষয়ে নতুন করে আইন করতে হবে।
সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একটি মন্দ আইন।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এলিনা খান বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারার যেভাবে অপব্যবহার হয়েছে, সেটাই নতুন আকার পেয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। দমনপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ব্যবহার করা হয়েছে।
ওয়েবিনারে জানানো হয়, চার বছরে ১ হাজার ১০৯টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন ২ হাজার ৮৮৯ জন। এর মধ্যে আটক হয়েছেন ১ হাজার ১১৯ জন। অভিযুক্তদের মধ্যে ১ হাজার ২৯ জনের পরিচয় জানা গেছে। যার মধ্যে ৩০১ জন রাজনীতিবিদ, ২৮০ জন সাংবাদিক, শিক্ষার্থী ১০৬ জন এবং শিক্ষক ৫১ জন। অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর মধ্যে ৭১ শতাংশই আটক হয়েছে। ২৬ জন শিশু (১৮ বছরের কম বয়সী) অভিযুক্ত হয়েছে।
আরও বলা হয়, এই আইনের মামলায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (৭৫ দিন) তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়ে না। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বিচারের আগেই দীর্ঘদিন আটক থাকেন। ওয়েবিনারে জানানো হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হওয়া মামলায় ১ হাজার ২৯ জন অভিযুক্ত ব্যক্তির পরিচয় জানা গেছে। এর মধ্যে ৩০১ জন রাজনীতিবিদ। সাংবাদিক রয়েছেন ২৮০ জন। শিক্ষার্থী ১০৬ জন এবং শিক্ষক আছেন ৫১ জন। তবে অভিযুক্ত অন্যদের চেয়ে শিক্ষার্থীদের আটকের হার বেশি।
ওয়েবিনারে আরও জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তির অভিযোগে ডিজিটাল আইনে মামলা হয়েছে ১৪০টি, অভিযুক্ত ২১০ জন, আটক হয়েছেন ১১৫ জন। রাজনীতিবিদদের মানহানির অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হওয়া মামলার অধিকাংশ বাদী তাঁদের সমর্থকরা।
বক্তারা বলেন, ফেসবুকে মতপ্রকাশ বাধাগ্রস্ত করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করা হয়েছে। মাসে গড়ে ৯টি মামলা হয়েছে ফেসবুকে মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে। মোট ৬৯৮টি মামলা হয়েছে ফেসবুককেন্দ্রিক। এর মধ্যে হয়রানির মামলা ৭৬টি, আর্থিক প্রতারণা ৪৪টি এবং ধর্মীয় অবমাননার ১১৫টি মামলা। বাকি ৪৬৩টি রাজনৈতিক মামলা বলেই প্রতীয়মান হয়।
আলোচকরা বলেন, আইনটির সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে সাংবাদিকরা। ২০২০ সালে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে। প্রতি মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারদলীয় লোকজন গড়ে চারটি করে মামলা করেছেন। আইনের ২৫, ২৯, ৩১ ও ৩৫ ধারায় মামলা বেশি হয়েছে। ২৫ ও ৩১ ধারা দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে আদালতও প্রশ্ন তুলেছিলেন।
মন্তব্য করুন