- গোলটেবিল
- নির্মাণ শ্রমিকদের মৃত্যু কমানো সম্ভব
নির্মাণ শ্রমিকদের মৃত্যু কমানো সম্ভব
সমকাল-ব্লাস্ট মতবিনিময় সভায় বক্তারা

দৈনিক সমকালের সভাকক্ষে ‘নির্মাণ শ্রমিক ও ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নে করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় অতিথিরা -সমকাল
নির্মাণ শ্রমিকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা গেলে দুর্ঘটনায় তাঁদের মৃত্যুহার কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নিয়োজিত সংস্থাগুলোকে বাধ্য করতে হবে নিয়মিত তদারকি প্রতিবেদন জমা দিতে। জরুরি ভিত্তিতে সব সংস্থাকে দায়বদ্ধ করতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ছাড়া এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে ঠিকাদারের লাইসেন্স বাতিল করা যেতে পারে। একই সঙ্গে কোনো প্রকৌশল ফার্ম কোনো অনিবন্ধিত ঠিকাদার দিয়ে কাজ করালে ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে দৈনিক সমকালের সভাকক্ষে ‘নির্মাণ শ্রমিক ও ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নে করণীয়’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় তাঁরা এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি (এসআরএস) এবং দৈনিক সমকাল যৌথভাবে এর আয়োজন করে।
সভায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ব্লাস্টের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য জেড আই খান বলেন, নির্মাণ শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সবাইকে সমানভাবে ভূমিকা রাখতে হবে। অন্য সবার মতো তাঁরাও স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার রাখেন।
সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, বাংলাদেশে আইন আছে; কিন্তু বিধিমালা নেই। আবার আইন এবং বিধিমালা দুটিই আছে; কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিয়ে ২০০৬ সালে একটি বিধিমালা করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়নে ব্লাস্টের পক্ষ থেকে রিট করার পর হাইকোর্টের পক্ষ থেকে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে কতটা তোয়াক্কা করছেন, সেটা আমরা জানি না। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের হাইকোর্টের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান বলেন, নির্মাণ ক্ষেত্রে শ্রমিকের মৃত্যু দুর্ঘটনা নয়, বরং হত্যা। তাঁরা মারা গেলে তাঁদের পরিবারকে কিছু টাকা দেওয়া হচ্ছে। শুধু ক্ষতিপূরণ দিলেই হবে না। এ ধরনের প্রাণহানি হলে সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল আলম বলেন, তাঁদের পক্ষ থেকে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে অবিলম্বে বাংলাদেশ বিল্ডিং রেগুলেটরি অথরিটি প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছে। এটি করা না হলে ভবন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব-কর্তব্য কার্যকরা করা যাবে না। আইন-নীতিমালা শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
স্থপতি এবং নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, রানা প্লাজায় দুর্ঘটনার পর বিদেশি ক্রেতাদের চাপে শ্রমিকদের সার্বিক বিষয় মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হয়। কোনো শ্রমিক কিংবা শ্রমিক সংগঠনের চাপে কিন্তু এটা হয়নি। এ বিষয়ে ক্রেতারা চাপ দিতে পারলে সরকার কেন পারবে না? বিদেশিদের প্রকল্পে গেলে দেখা যাবে, সেখানে সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করা হয়। সেখানে কোনো ধরনের দুর্ঘটনার আওয়াজ পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, একবার কোনো দুর্ঘটনায় শ্রমিক মারা গেলে সেটাকে দুর্ঘটনা বলা যায়। কিন্তু বারবার মারা গেলে তাকে কীভাবে দুর্ঘটনা বলা হয়? তিনি বলেন, একটা নির্মাণ সাইটে কোন জায়গাগুলো ঝুঁকিপূর্ণ তা চিহ্নিত করতে হবে। একই সঙ্গে শ্রমিকদের মধ্যেও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
ব্লাস্টের পরিচালক (অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড কমিউনিকেশন) মাহবুবা আক্তার বলেন, ২০০৭ সালে ব্লাস্টসহ কয়েকটি সংগঠন মিলে হাইকোর্টে একটি মামলা করেছিল। ২০১০ সালে তার রায় হয়। নির্মাণ শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিধানের পক্ষে রায় দেওয়া হলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। এমপাওয়ারিং ওয়ার্কার্স ফর জাস্টিস প্রকল্পের অধীনে নির্মাণ শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় ব্লাস্ট কাজ করে যাচ্ছে।
ব্লাস্টের অ্যাডভোকেসি অফিসার এবং সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আয়শা আক্তার নির্মাণ শ্রমিক ও ভবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে দেশের বিদ্যমান আইন, হাইকোর্টের নির্দেশনা, বিল্ডিং কোড এবং এ-সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর বিভিন্ন নির্দেশনা তুলে ধরেন।
সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সিকান্দার আলী মিনা বলেন, বিদ্যুৎস্পর্শে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক মারা যান। এ ছাড়া ওপর থেকে পড়ে গিয়ে কিংবা ভারী বস্তুর আঘাতেও মৃত্যু হয়। একটু সচেতন হলেই এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু এড়ানো সম্ভব। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ঘাটতি দেখা যায় ব্যবস্থাপনায়। নির্মাণে নিরাপত্তা বিধানের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক মানদণ্ড থাকলেও এ দেশে তা মানা হয় না। এই মানদণ্ড সঠিকভাবে মেনে চলতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ব্লাস্টের উপদেষ্টা (অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড ক্যাপাসিটি বিল্ডিং) তাজুল ইসলাম বলেন, ঠিকাদারদের মাধ্যমেই নির্মাণ শ্রমিকদের অধিকার বেশি লঙ্ঘিত হচ্ছে। এ দেশের শ্রম আইনের আওতায় এ ধরনের ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের সচেতন করা এবং মালিকদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানিম হোসেন শাওন বলেন, হাইকোর্টের রায়ে বলে দেওয়া হয়েছে নির্মাণ শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে নিয়মিত ব্যবস্থা নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এ বিষয়ে কোনো কাজ না করলে কিংবা নিয়মিত প্রতিবেদন জমা না দিলে আবার আদালতকে অবহিত করা যায়। এ ছাড়া ২০২১ সালের নতুন বিল্ডিং কোড প্রণয়ন করা হলেও এর আওতায় কোনো সংস্থা গঠন করা হয়নি। এ বিষয়ে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। এটি করা হলে এ বিষয়ে সরকারের ওপর চাপ আসবে এবং সরকার সজাগ হবে।
ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা এসএম রেজাউল করিম বলেন, নির্মাণ শ্রমিক ও ভবনের নিরাপত্তা অতি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শ্রমিক নিজেও জানেন না তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিতে কী করতে হবে। এ বিষয়ে তাঁদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ব্লাস্টের পরিচালক (আইন) বরকত আলী বলেন, নির্মাণ শ্রমিকসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিয়ে যেসব সংস্থা কাজ করে, তাদের কর্মতৎপরতা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া শ্রম আইন লঙ্ঘন হলে একজন শ্রমিকের আইনগত সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে হবে।
ইমারত শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এ দেশের সবচেয়ে বড় এবং অসংগঠিত খাত হলো নির্মাণ খাত। এ খাতে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কর্মরত। এসব শ্রমিকের অধিকাংশেরই নিয়োগপত্রও নেই। নির্মাণাধীন ভবনে কর্মরত শ্রমিকদের পরিচয়ও লিপিবদ্ধ থাকে না। কোনো বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে নিহত শ্রমিকদের নাম-পরিচয় বের করাই কঠিন হয়ে পড়ে। তাই এসব শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে যেসব আইন আছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন করতে হবে। নির্মাণ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের মৃত্যু এড়াতে সবার জোরেশোরে আওয়াজ তুলতে হবে। আমরা একজন শ্রমিকেরও মৃত্যু চাই না।
মন্তব্য করুন