- গোলটেবিল
- প্রাক-বাজেট আলোচনা ২০২৩-২৪: বেসরকারি খাতের প্রত্যাশা
প্রাক-বাজেট আলোচনা ২০২৩-২৪: বেসরকারি খাতের প্রত্যাশা

আগামী অর্থবছরের বাজেট সামনে রেখে গত ২২ মার্চ রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই), দৈনিক সমকাল এবং চ্যানেল টোয়েন্টিফোর যৌথভাবে এক আলোচনার আয়োজন করে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বেসরকারি খাত কোন কোন পদক্ষেপ চায় এবং এ বিষয়ে নীতিনির্ধারকরা কী ভাবছেন তা নিয়েই ছিল এ আয়োজন।
সালমান এফ. রহমান, এমপি
আজকের আলোচনায় যেসব সুপারিশ এসেছে, তার মধ্যে অনেক কিছুই যুক্তিসংগত। শুরুতে বলবো, আমাদের অর্থনীতি কিন্তু ভালোই চলছিল। হঠাৎ করোনার সংক্রমণ শুরু হলো। বলা হয়েছিল, আমাদের অর্থনীতি অত্যন্ত গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে আমরা মোটামুটি সফলভাবে কভিডের প্রভাব মোকাবিলা করেছি। এরপর এলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর ফলে অপ্রত্যাশিতভাবে বহিঃস্থ উৎস থেকে কিছু প্রভাব আমাদের ওপর পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়েছে। ডলার অনেক শক্তিশালী হয়ে টাকার মূল্যমানে বড় পতন ঘটেছে। আমাদের আমদানির ওপর যার প্রভাব পড়েছে। বিরূপ প্রভাব পড়েছে জ্বালানি দামের ওপর। এলএনজির ইউনিট দামের ১৪-১৫ ডলার থেকে ৬৫-৭০ ডলারে উঠে গেল। এমন পর্যায়ে গেল যে, স্পট মার্কেট থেকেও এলএনজি কেনা সম্ভব হচ্ছিল না। একই সঙ্গে খাদ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যদিও চাল, মাছ, শাক-সবজিসহ অনেক পণ্যে আমরা কম- বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমি মনে করি, খাদ্য নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন, এক ইঞ্চি জমি ফেলে রাখা যাবে না। মূল্যস্ফীতির বিষয়ে আমি বলবো, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। টিসিবি কম দামে পণ্য বিক্রি করছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সুরক্ষায় আমদানি নিয়ন্ত্রণের কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমদানি আগের চেয়ে কমে এসেছে। আগামী জুন নাগাদ রিজার্ভ অনেকটা স্থিতিশীল হয়ে আসবে। আইএমএফ আমাদের অর্থনীতির দৃঢ়তা বুঝেই ঋণ দিচ্ছে। তারা যেসব শর্তের কথা বলেছে, সেগুলো বাংলাদেশ আগে থেকেই করতে চায়। সুদের হার এবং বিনিময় হার বাজারভিত্তিক হবে। আমি মনে করি, সামষ্টিক অর্থনীতি কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে এবং এগুলো মোকাবিলায় আমরা সঠিক পথেই আছি।
বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত অনেক কম। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে যাদের আয় করযোগ্য, তাদের সবাইকে কর দিতে হবে। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর উচিত এ কাজে এনবিআরকে সহযোগিতা করা। কর ব্যবস্থা অবশ্যই স্বয়ংক্রিয় হতে হবে এবং অনেক ক্ষেত্রে যৌক্তিকীকরণ করতে হবে। তবে কর অব্যাহতি এবং ছাড় কমিয়ে আনতে হবে। তা না হলে রাজস্ব আয় বাড়ানো যাবে না। এখন নানা চ্যালেঞ্জ সামনে আসছে। উন্নত দেশেও মানুষের মৌলিক প্রয়োজন মেটাতেও সমস্যা হচ্ছে। বাংলাদেশের রপ্তানি খাত চাঙ্গা রয়েছে। রেমিট্যান্স বাড়ছে। দেশের বাজার বড় হচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগ দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ দেশের উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ। পুঁজিবাজার প্রসঙ্গে বলবো, আমাদের দেশে ৯০ শতাংশ বিনিয়োগকারী রিটেইলার বা ব্যক্তি বিনিয়োগকারী। বাকিটা প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। অন্যান্য ফ্রন্টিয়ার বাজারে এর উল্টো। ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা নিজ সিদ্ধান্তে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার দায় সরকারের নয়। তারা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিনিয়োগ করতে পারে। আমাদের রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণের খুব প্রয়োজন। তৈরি পোশাকের মতো প্লাস্টিক, ফার্নিচারসহ বিভিন্ন খাত বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা পেতে পারে।
ড. এম. শামসুল আলম জিডিপিতে বিভিন্ন খাতের অবদান অনুযায়ী কর আহরণ বাড়ানোর একটি প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু অর্থনীতিতে অবদানের হার অনুযায়ী সমানভাবে কর আহরণের হার অর্জন সম্ভবপর নাও হতে পারে। যেমন– অর্থনীতিতে সেবা খাতের অবদান ৫২ শতাংশ। এ খাত থেকে করের ৫২ শতাংশ আহরণ করতে হলে চাপে পড়ে যাবে। একথা ঠিক, অর্থনীতিতে এখন অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং সময়। কভিডের সংকট সরকার সামাল দিয়েছে। বিশ্বে এখন আরেক সংকট চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশেও ব্যাংক ধসে যাচ্ছে। ফলে আমাদের আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। তবে আমাদের অর্থনীতি ঋণাত্বক পর্যায়ে যায়নি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। কৃষি খাতে ভর্তুকিসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। আজকের আলোচনায় অনেকে রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণের সুপারিশ করেছেন। বৈচিত্র্যকরণ কিন্তু কিছুটা হচ্ছে। রপ্তানি তৈরি পোশাকনির্ভর, তারপরও কয়েকটি খাত থেকে এখন বছরে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় হচ্ছে। এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি হিসেবে অন্তত এক ডজন দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি এবং অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আগামী বাজেট নিয়ে বলব, মূল্যস্ফীতি যাতে না বাড়ে কিংবা কমে এবং একই সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যাতে ধীর না হয়– তা মাথায় রাখা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাজেট করার সুযোগ নেই। আবার বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সরকারকে যাতে কম ঋণ গ্রহণ করতে হয় এবং সামষ্টিক অর্থনীতি যাতে স্থিতিশীল থাকে, তা মাথায় রাখতে হচ্ছে। জ্বালানিতে ভর্তুকি না দিলে এর আমদানিতে কর প্রত্যাহার করার যে প্রস্তাব এখানে এসেছে, তা বিবেচনাযোগ্য মনে করি।
শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন
এনবিআরের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সমন্বয় অতীতে হয়ে এসেছে। এখন কিছুটা গ্যাপ দেখা যাচ্ছে, যা কাঙ্ক্ষিত নয়। এনবিআরকে ব্যবসায়ীদের কথা শুনতে হবে। প্রতিষ্ঠানটির মনোভাবে পরিবর্তন আনতে হবে। বিতর্কের মাধ্যমেই একটি অভিন্ন অবস্থানে আসা যায়। কর নির্ধারণে ট্যারিফ কমিশনের প্রধান ভূমিকা থাকা উচিত, যার বাস্তবায়ন করবে এনবিআর। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন থাকতে হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো পুরোপুরিভাবে চালু হতে সময় লাগবে। সেখানে অনেকে কারখানা করছেন। এই অন্তর্বর্তী সময়ে বিভিন্ন জায়গার কারখানায় বিদ্যুৎ-গ্যাসসহ অন্যান্য ইউটিলিটি যেন বাধাগ্রস্ত না হয়, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
এ. কে. আজাদ এ অনুষ্ঠানে এমন একজন উদ্যোক্তা উপস্থিত রয়েছেন, যার প্রতিষ্ঠানে এক লাখেরও বেশি কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। এখন যদি তাঁর কারখানায় দিনে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা গ্যাসের চাপ না থাকে, তাহলে কী অবস্থা দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। সুতরাং বিদ্যুৎ ও গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ শিল্পের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানির দাম বহুলাংশে বেড়েছে। এখন বিশ্ববাজারে দাম অনেকটা কমে এসেছে। এখন এলএনজির ইউনিট দাম ১৩ ডলারে নেমে এসেছে, যা প্রায় ৬৯ ডলারে উঠেছিল। ফলে দেশে এখন দাম সমন্বয় করা উচিত।
কেননা রপ্তানি সেভাবে বাড়ছে না। অন্যদিকে উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। ফলে দাম না কমালে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান ঝুঁকিতে পড়বে। পেট্রোবাংলার হিসাবেই এখন গ্যাসের যে মজুত আছে, তা ৫ বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। পুরোপুরি আমদানিনির্ভর হলে তখন বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় অনেক বেড়ে যাবে। অন্যদিকে এলএনজি টার্মিনাল
বর্তমানের ২টির জায়গায় ১৭টি লাগবে। এ ধরনের পরিস্থিতি যাতে না হয় তার প্রস্তুতি থাকতে হবে। বাসা-বাড়িতে গ্যাসের যে ১৩ শতাংশ ব্যবহার রয়েছে, তার পুরোটাই এলপিজির মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে। রপ্তানি খাতে এখন রিসাইকেল প্রক্রিয়ার উৎপাদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পোশাকের বড় ক্রেতারা জানাচ্ছেন, ২০২৫ সালের পর অন্তত ২৫ শতাংশ পণ্য রিসাইকেল্ড না হলে তারা কিনবেন না। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন এজন্য পুরোনো কাপড় আমদানির অনুমতি চাইছে। বাজেটে এ বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত থাকা উচিত। অন্যদিকে উদ্যোক্তারা বিদ্যুতের জন্য ছাদে সোলার প্যানেল বসাতে চান। কিন্তু এর উপকরণ আমদানির ওপর কর অত্যন্ত বেশি। সোলারের জন্য প্যাকেজ আমদানির কর ৩৭ শতাংশ এবং ইনভার্টার আমদানির কর ৫৮ শতাংশ। ভারতে যা মাত্র ৫ শতাংশ। বাজেটে এ বিষয়ে পদক্ষেপ দরকার।
মো. জসিম উদ্দিন
আজকের আলোচনায় যেসব বক্তব্য এসেছে, তার সব কিছুর সঙ্গে আমি একমত। তাদের সব কথা আমার কথা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আগামী বাজেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাজস্ব আয় বাড়ানো দরকার, আবার ব্যবসা-বাণিজ্যও চালু রাখা দরকার। আমাদের রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণে জোর দিতে হবে। আমাদের পশ্চাৎসংযোগ শিল্প বাঁচানো দরকার। এসএমইকে আরও প্রণোদনা দিতে হবে। কর প্রসঙ্গে আমার মত হলো, ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে বেশিরভাগ কর আদায় হয়। দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে কর আদায় বাড়াতে হবে। অন্যদিকে ব্যবসার ওপর অগ্রিম আয়করের চাপ কমাতে হবে। আমাদের এখানে আয়করের ৫৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর থেকে আসে। আমি মনে করি, এনবিআরের রাজস্ব নীতি এবং বাস্তবায়ন বিভাগ আলাদা হতে হবে। জ্বালানিতে ভর্তুকি না থাকলে আমদানিতে করও না রাখার যে প্রস্তাব এসেছে, তা আমি সমর্থন করি। সম্প্রতি বাংলাদেশ বিজনেস সামিটের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, লাল ফিতার দৌরাত্ম্য থাকবে না। আগামী বাজেটে ব্যবসায়ীরা এর প্রতিফলন দেখতে চান। ব্যবসাবান্ধব বাজেট চান তাঁরা।
ব্যারিস্টার সামীর সাত্তার
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটকে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ব্যবসাবান্ধব করার জন্য বেসরকারি খাতের প্রত্যাশা সরকারের কাছে তুলে ধরা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমাদের অর্থনীতিতে যে সংকট চলছে, তা কীভাবে মোকাবিলা করা যায়– সে বিষয়ে আলোচনার জন্য আজকের এ আয়োজন। বাজেটের পুরোপুরি সফলতা নির্ভর করে খাতগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া, কার্যকর নীতি সিদ্ধান্ত এবং নির্ধারিত সময়ে তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে। ঢাকা চেম্বার মনে করে বাজেটে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রত্যাশার পাশাপাশি দেশের সাধারণ মানুষের চাহিদাকেও সরকার বিবেচনায় নেবে। ঢাকা চেম্বার আসন্ন বাজেটে শিল্প খাতের উন্নয়ন, সহজ ও ব্যবসাবান্ধব আয়কর ব্যবস্থা, আয়কর ও ভ্যাটের আওতা বৃদ্ধি, অটোমেশন, রপ্তানি বহুমুখীকরণ, স্থানীয় শিল্পায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং আরও বেশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার অনুরোধ করছে।
মোজাম্মেল হোসেন
আজকের আলোচনায় উপস্থিত অতিথিদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। বেসরকারি খাত আমাদের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সুতরাং তাদের প্রত্যাশা আগামী বাজেটে গুরুত্ব পাবে বলে আমার বিশ্বাস। আমার মনে হয়, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ বছর বাজেট প্রণয়নে সরকারকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। এর মধ্যেও মূল্যবৃদ্ধির চাপ থেকে নিম্ন আয়ের মানুষকে রক্ষা করতে হবে। আমি সংবাদপত্রের লোক। সংবাদপত্র শিল্প এখন গভীর সংকটে। আগামী বাজেটে সংবাদপত্র শিল্পের ওপর করের বোঝা কমাতে পদক্ষেপ আশা করছি।
জাভেদ আখতার বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন দেশের করহারের তুলনামূলক পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন। বাংলাদেশে করপোরেট করহার গত কয়েক বছরে কমানো হয়েছে। এর ফলে কিন্তু রাজস্ব আদায় কমেনি। তবে অননুমোদনযোগ্য ব্যয়ের শর্তের কারণে কার্যকর করের হার বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে আমাদের এখানে অনলাইনে রিটার্ন দাখিল হচ্ছে। কিন্তু কর ব্যবস্থার সব ক্ষেত্রে ডিজিটাইজেশন দরকার।
মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির
করের আওতা বাড়ানোর কথা বহু বছর ধরে বলা হচ্ছে। অথচ কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ছে না। বাড়তি কর কোথা থেকে আসবে, তা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হচ্ছে না। জিডিপিতে অবদান পর্যালোচনা করে যেসব খাতের অবদান বাড়ছে, কর বাড়ানোর ক্ষেত্রে সেদিকে নজর দেওয়া যেতে পারবে। ডিজিটাইজেশন আসলেই একটি স্লোগান। টাকা খরচ করা হচ্ছে, কিন্তু জবাবদিহি নেই। এনবিআরের মধ্যেই ট্যাক্সেশন, কাস্টমস এবং ভ্যাটের ইন্টিগ্রেশন না হলে সমাধান হবে না।
মো. আলমগীর হোসেন
করজাল আসলেই বাড়াতে হবে। ৩০ লাখ মানুষ রিটার্ন দাখিল করেন, যা জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ। টিআইএন নিলে রিটার্ন দাখিলের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। করের আওতা বাড়াতে গ্রোথ সেন্টারগুলোতে যেতে হবে। করজাল বাড়াতে শুধু এনবিআরের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে। এ বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।
মো. নজিবুর রহমান
বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলোতে ধাক্কা লেগেছে। এ সময় ‘আউট অব দ্য বক্স’ চিন্তা করতে হবে। সুরক্ষাকবচ বাড়াতে হবে। পুঁজিবাজারের টেকসই উন্নয়নে শক্তিশালী রাজনৈতিক সদিচ্ছা রয়েছে। বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এখনও ঠিকমতো বিকশিত হয়নি। আমরা ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড থেকে পুঁজিবাজারে তারল্য সহায়তা দিচ্ছি। আগামী বাজেটের জন্য আমার প্রস্তাব হলো, তালিকাভুক্ত কোম্পানির লভ্যাংশ পুরোপুরি করমুক্ত করা যেতে পারে। শেয়ার লেনদেন পুরোপুরি করমুক্ত করা উচিত। তালিকাভুক্ত এবং অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানির করের পার্থক্য পুনরায় পর্যালোচনা করা যেতে পারে।
ড. সেলিম রায়হান
বাংলাদেশ সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য এক বছর ধরে লড়াই করছে। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো খাদ্য নিরাপত্তা। কর ব্যবস্থায় সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক অঙ্গীকারের ঘাটতি দেখি না। অংশীদারদের সঙ্গে বসে স্বচ্ছতার মাধ্যমে কর ব্যবস্থায় সংস্কার করতে হবে। এলডিসি থেকে উত্তরণের আগে আগামী ২-৩ বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৬ সালের পর আমরা কোথায় দাঁড়াবো, সেই চিত্র স্পষ্ট করা দরকার। বিভিন্ন ক্ষেত্রে হাতে নেওয়া সংস্কার উদ্যোগ চলমান রাখতে হবে।
আরিফ খান
বাংলাদেশে এসএমই খাতে খেলাপি ঋণের হার তুলনামূলক কম, তিন শতাংশের নিচে। মুম্বাইতে নতুন আইপিওর ৯৭ শতাংশ হচ্ছে এসএমই। আমাদের এখানে এসএমই কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে আনার উৎসাহ দিতে হবে। পুঁজিবাজার তাদের জন্য অর্থায়নের বড় উৎস হতে পারে। বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের প্রায় পুরোটা ব্যাংক থেকে আসছে। এর বিকল্প হিসেবে প্রাইভেট ইক্যুইটি ও ভেঞ্চার ক্যাপিটাল তহবিল আকৃষ্ট করার নীতি গ্রহণ করতে হবে। বন্ড ও মিউচুয়াল ফান্ড থেকে অর্থায়ন বাড়াতে হবে।
মাশরুর আরেফিন
সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক বন্ধ হয়েছে মূলধন পর্যাপ্ততার অভাবে নয়, আস্থা হারিয়ে আমানত উত্তোলনের কারণে হয়েছে। আস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে তারল্য নিয়ে অনেক সময় ভুল তথ্য দেওয়া হয়। ব্যাংক খাতে সামগ্রিকভাবে তারল্য সংকট নেই। কয়েকটি ব্যাংকের সমস্যা থাকতে পারে। ১০০ টাকার আমানত নিলে ১৭ টাকা তরল হিসেবে রেখে দিতে হয়। সামগ্রিকভাবে তরল হিসেবে আছে ২৫ টাকা। ডলার কেনায় বড় অঙ্কের অর্থ ব্যাংকগুলো থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫০ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন করছে।
আহসান খান চৌধুরী
আমরা এফএমসিজি নিয়ে কাজ করছি। লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্নিচার, ইলেকট্রনিক্স নিয়ে কাজ করছি। আমরা চাই পৃথিবীর সব অঞ্চলে এসব পণ্য ছড়িয়ে দিতে। এর জন্য সামগ্রিক কর ব্যবস্থা সহজ করতে হবে। শিথিল করতে হবে। যৌক্তিক করতে হবে। নতুন কোনো কর আরোপ না করে উদারভাবে চিন্তা করতে হবে। রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে হবে। সব রপ্তানি খাতকে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা দিতে হবে। রপ্তানিতে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজার আরও চাঙ্গা করতে হবে।
আসিফ আশরাফ
২০২৬ সালের পর আমরা বেশিরভাগ গন্তব্যে রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা হারাবো। এ জন্য বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএ এবং পিটিএ করতে হবে। তৈরি পোশাকের বিশ্ববাজারের ৭৫ শতাংশ এখন ম্যান মেইড ফাইবারের পণ্য। আমরা মাত্র ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বাজারের জন্য প্রতিযোগিতা করছি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি হিসেবে নন-কটন সুতা উৎপাদনে প্রণোদনা দিতে হবে। আমদানি করা এ ধরনের সুতায় ৪ থেকে ৫ বছর শুল্ক সুবিধা দিতে হবে।
মোহাম্মদ আলী খোকনআমরা বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তারা শুধু তৈরি পোশাক রপ্তানির জন্য নয়, দেশের বাজারেও প্রচুর পণ্য সরবরাহ করছি। এ খাতে আরও বিনিয়োগ সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু তার জন্য সুযোগ দিতে হবে। ম্যান মেইড ফাইবার নিয়ে বিড়ম্বনা দূর করতে হবে। এর আমদানির ওপর কর অনেক বেশি। নানা রকম ট্যারিফ ও নন-ট্যারিফ বাধা রয়েছে। শুধু ম্যান মেইড ফাইবার নয়, পোশাক বর্জ্য থেকেও পুনরায় পণ্য উৎপাদনে সহায়তা দিতে হবে।
হোসেন খালেদ
আমিও মনে করি অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। তবে আমলাতন্ত্র ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে গ্যাপ দূর করতে হবে। একটা বাস্তবতা আমাদের মনে রাখতে হবে যে, ব্যবসা কমে যাচ্ছে। এলসি খোলা যাচ্ছে খুব কম। ৩০ থেকে ৪০ শতাংশের বেশি উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় অগ্রিম আয়করের বোঝা থাকলে অনেকের পক্ষে কর্মীদের বেতন দেওয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
মাইনুদ্দিন মোনেমঅবকাঠামো নিয়ে প্রচলিত চিন্তার পরিবর্তে বাণিজ্য, ট্রানজিট ও লজিস্টিকস মিলিয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম বা গাজীপুরে পণ্য পরিবহনের চিন্তা করেই বিষয়টি ভাবলে হবে না, বৃহত্তর আঙ্গিকে অবকাঠামোর উদ্যোগ থাকতে হবে। এমনভাবে অবকাঠামো থাকতে হবে, যাতে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টার মধ্যে সারাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়।
ইমরান করিম
আমাদের জ্বালানি খাত এখন আমদানিনির্ভর হয়ে গেছে। ২০২৩ সালে ১২ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানি আমদানি করতে হবে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার বহিঃপ্রবাহ বেশি হচ্ছে এবং কর আহরণ কম হচ্ছে। আমাদের এখানে একেক জ্বালানির ওপর কর একেক রকম। সকল জ্বালানির ওপর একই হারে কর আরোপ থাকা উচিত। আর জ্বালানিতে সরকার ভর্তুকি না দিলে করও প্রত্যাহার করা উচিত।
মোহাম্মদ আরিফুল ইসলামমোবাইল কলের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপরও একই হারে ভ্যাট রয়েছে। টেলিযোগাযোগ অবকঠামোর ওপরও উচ্চহারে করহার রয়েছে। আগামী বাজেটে এসব বিষয় পর্যালোচনা করা উচিত। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং দেশের বর্তমান চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে বাজেট প্রণয়ন করা উচিত।
প্রধান অতিথি
সালমান এফ. রহমান, এমপি
প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা
বিশেষ অতিথি
ড. শামসুল আলম
প্রতিমন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়
সম্মানিত অতিথি
শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, এমপি
সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই
এ. কে.আজাদ
সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই
মো. জসিম উদ্দিন
সভাপতি, এফবিসিসিআই
স্বাগত বক্তব্য
ব্যারিস্টার মো. সামীর সাত্তার
সভাপতি, ঢাকা চেম্বার
সমাপনী বক্তব্য
মোজাম্মেল হোসেন
সম্পাদক, সমকাল
নির্ধারিত আলোচক
বিষয়: আয়কর ও ভ্যাট
জাভেদ আখতার
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ইউনিলিভার বাংলাদেশ
মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির
সাবেক সভাপতি, আইসিএবি
মো. আলমগীর হোসেন
সাবেক সদস্য, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড
বিষয় : আর্থিক খাত
মো. নজিবুর রহমান
চেয়ারম্যান, ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড
আরিফ খান
ভাইস চেয়ারম্যান, শান্তা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট
মাশরুর আরেফিন
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, দ্য সিটি ব্যাংক
ড. সেলিম রায়হান
নির্বাহী পরিচালক, সানেম
বিষয় : শিল্প ও বাণিজ্য
আসিফ আশরাফ
পরিচালক, বিজিএমইএ
মোহাম্মদ আলী খোকন
সভাপতি, বিটিএমএ
হোসেন খালেদ
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আনোয়ার গ্রুপ
বিষয় : অবকাঠামো
মাইনুদ্দিন মোনেম
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আব্দুল মোনেম লিমিটেড
ইমরান করিম
ভাইস চেয়ারম্যান, কনফিডেন্স গ্রুপ
মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম
কান্ট্রি হেড, নোকিয়া
অনুলিখন
জাকির হোসেন
সহযোগী সম্পাদক
সমকাল
মন্তব্য করুন