
আমি ব্র্যাকে যোগদান করি ১৯৭৩ সালের ১ জুলাই এবং ব্র্যাক ছেড়ে আসি ২০১৭ সালের ১ জুলাই। আমি যখন ব্র্যাকের নিয়োগপত্র পাই, তখন আমার বন্ধু-বান্ধবরা কাজে যোগদান করতে নিষেধ করেছিল। কারণ হিসেবে তারা বলেছিল রিলিফের কাজ শেষ, চাকরিও শেষ। বড় জোর ৩-৪ মাস এ কাজ চলতে পারে। তারপরেই ব্র্যাক বন্ধ হয়ে যাবে।
ব্র্যাক আমার বন্ধুদের ভবিষ্যৎ বাণী নাকচ করে দিয়ে এ বছর সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে। আশা করি, পৃথিবীতে যতদিন মানব জাতি থাকবে, ততদিন ব্র্যাক তার কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। রিলিফ থেকে উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করলে ব্র্যাকের নাম হয় 'বাংলাদেশ রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি'। সেখান থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে এখন 'ব্র্যাক' নামে পরিচিত এবং এটি একটি সফল প্রতিষ্ঠান। এটি সম্ভব হলো কীভাবে?
আমার মনে হয়, এটি সম্ভব হয়েছে আবেদ ভাইয়ের (স্যার ফজলে হাসান আবেদ) দূরদৃষ্টিসম্পনস্ন নেতৃত্ব, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, জীবনদর্শন, দারিদ্র্য বিমোচনে দৃঢ় প্রত্যয়, জনগণের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও সৃজনশীলতার কারণে। তাই তো দেখেছি তিনি সবসময় চিন্তা করতেন কীভাবে এ দেশের দারিদ্র্য দূর করা যায়। ব্র্যাক ছিল তার ধ্যান ও জ্ঞান। ব্র্যাক ছাড়া তিনি অন্যকিছু চিন্তা করতেন বলে মনে হয় না। তাই ব্র্যাক সম্পর্কে বলতে গেলে আবেদ ভাই সম্পর্কে বলতে হবে, আবার আবেদ ভাই সম্পর্কে বলতে গেলে ব্র্যাক সম্পর্কে বলতে হবে।
আবেদ ভাই ব্রাজিলিয়ান শিক্ষাবিদ পাওলো ফ্রেইরির দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। দর্শনটি হলো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হলে দরিদ্র জনগণকে মুখ্য ভূমিকায় রাখতে হবে। জনগণই তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে। উন্নয়ন কর্মীর কাজ হলো জনগণের দ্বারপ্রান্তে যাওয়া, তার সমস্যাগুলো শোনা ও জানা এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সেসব সমস্যা সমাধান করা।
১৯৭০-এর দশকে শাল্লায় শিক্ষিতের হার ছিল নগণ্য। ফলে পরিবার পরিকল্পনার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে কর্মীদের একই বাড়িতে অনেকবার যেতে হতো। আমরা ১৯৭৭ সালে আবেদ ভাইকে শিশুদের শিক্ষা কর্মসূচি চালু করার অনুরোধ করি। তিনি বললেন, শিশুদের শিক্ষা কর্মসূচি চালু করার জন্য দাতাগোষ্ঠী থেকে যে তহবিল সংগ্রহ করতে হবে, তা এই মুহূর্তে পাওয়া সম্ভব নয়। তিনি পরে ১৯৮৫ সালে শিশুদের জন্য শিক্ষা কর্মসূচি 'নন ফরমাল প্রাইমারি এডুকেশন' চালু করেন। এ সময় তিনি আমাদের বলেছিলেন, তোমরা যদি শিক্ষা কর্মসূচির ওপর কাজ করতে চাও, তাহলে স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসূচি নিয়ে চিন্তা কর। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ব্র্যাক ১৯৮০ সালে 'ওটেপ' নামে স্বাস্থ্য শিক্ষা কর্মসূচির ওপর ব্র্যাক এক জাতীয় কর্মসূচি হাতে নেয়।
ওটেপ ছিল একটি সফল কর্মসূচি। ওটেপ-ই ব্র্যাককে দেশে এবং বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি এনে দিয়েছে। ওটেপ বাংলাদেশে ডায়রিয়া হলেই মুখে খাওয়ার স্যালাইন খাওয়ার ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করেছে এবং মুখে খাওয়ার স্যালাইন ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার কমে গেছে। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার ছিল ১৯৯, ২০১৯-এ তা কমে হয়েছে ৩১। ওটেপ কর্মসূচি চালানোর ফলে ডায়রিয়া হলে মুখে খাওয়ার স্যালাইন খাওয়ানো আমাদের সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে গেছে। ওটেপ কর্মসূচি ব্র্যাকের সাংগঠনিক শক্তি বাড়িয়েছে এবং ব্র্যাককে এই আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করেছে, ব্র্যাক যে কোনো জাতীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম। ওটেপ সরকার ও দাতাগোষ্ঠীর কাছে ব্র্যাকের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে।
ওটেপ যেহেতু জাতীয় কর্মসূচি এবং তা বাস্তবায়ন করার জন্য প্রয়োজন প্রচুর লোকবল, তাই ১৯৮০ সালের দিকে আবেদ ভাই বলতেন উন্নয়ন কর্মসূচির এত ম্যানেজার সরবরাহ করতে হলে ব্র্যাকের একটি বিশ্ববিদ্যালয় দরকার। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ২০০১ সালে।
১৯৯০-এর দিকে আবেদ ভাই বলতেন, তার একটি কমার্শিয়াল ব্যাংক দরকার। কারণ যারা ক্ষুদ্রঋণ নিচ্ছে তারা যখন তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটাবে, তখন তারা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হবে। তখন তাদের মূলধনের চাহিদা বেড়ে যাবে। ব্র্যাক তাদের চাহিদামতো মূলধন সরবরাহ করতে পারবে না। ফলে প্রয়োজন একটি ব্যাংক। আবেদ ভাই ব্র্যাক ব্যাংকও প্রতিষ্ঠা করেন ২০০১ সালে। আবেদ ভাইয়ের কাছে গেলে প্রায়ই বলতেন, বর্তমানের সঙ্গে আগামী ১০-১৫ বছরে বিশ্বে এবং বাংলাদেশে কী ধরনের পরিবর্তন আসবে সেগুলো নিয়েও চিন্তাভাবনা করা উচিত। কারণ পরিবর্তনগুলোর ওপর নির্ভর করে পূর্বেই ব্র্যাক তার কর্মসূচির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করার প্রস্তুতি নিতে পারবে এবং কর্মীদের সেভাবে দক্ষ করে তুলতে পারবে।
তার উদ্ভাবনীমূলক চিন্তাভাবনা থেকে কর্মসূচির নতুন নতুন আঙ্গিক যুক্ত হয়েছে এবং কর্মসূচির পরিধি বিস্তার লাভ করেছে। যেমন দারিদ্র্য বিমোচনে দরকার আয় বৃদ্ধি। আয় বৃদ্ধির জন্য দরকার কর্মসংস্থান। শুরু হলো মুরগি পালন। মুরগি পালনে দেখা গেল একদিন বয়সী যে বাচ্চা লাগে তা বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। তখন আবেদ ভাই শুরু করলেন পোলট্রি হ্যাচারি। হ্যাচারির পর দেখা গেল, হ্যাচারিতে যে পরিমাণ বাচ্চা উৎপাদন হয়, সেই পরিমাণ বাচ্চার খাবার বাজারে পাওয়া যায় না। তখন তিনি শুরু করলেন ফিড মিল। ফিড মিল করার পর দেখা গেল, ফিড তৈরিতে যে পরিমাণ কাঁচামাল বিশেষ করে ভুট্টা দরকার, তা বাজারে পাওয়া যায় না। তখন শুরু করলেন ভুট্টা চাষ। এভাবে যদি আমরা বিশ্নেষণ করি তাহলে দেখব প্রতিটি কর্মসূচি বা কার্যক্রমের বিস্তৃতি ঘটেছে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান কীভাবে করা যায়, তার পথ খুঁজতে গিয়ে।
দারিদ্র্য বিমোচনে আবেদ ভাই যে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন, তার একটি ছোট উদাহরণ তুলে ধরতে চাই। ২০১৯ সালের ২ অক্টোবর আমি, সাব্বির ভাই, কৈরী ও শিপা হাফিজা অসুস্থ আবেদ ভাইকে দেখতে তার বাসায় যাই। তিনি প্রায় ঘণ্টা খানেক শাল্লা প্রকল্পের বিভিন্ন ঘটনা এবং উন্নয়নের অনেক বিষয় নিয়ে আলাপ করলেন। একটা পর্যায়ে তিনি বললেন, 'দেখো এতদিন এনজিও সেক্টরে সরকার, দাতাগোষ্ঠী, মৌলবাদী সংগঠন ইত্যাদি থেকে মাঝে মধ্যে যেসব ঝড়ঝাপ্টা আসত তা আমি সামাল দিয়েছি। আমি তো চলে যাচ্ছি। এখন এটা তোমাদের সামাল দিতে হবে। তোমরা এনজিও সেক্টরের সব নেটওয়ার্ক সংগঠনগুলো যেমন : এডাব, এফএনবি, সিডিএফ, ক্যাম্পে সব একীভূত করে একটি শক্তিশালী সংগঠন তৈরি কর, যাতে যে কোনো সমস্যা বা বাধা এলে তোমরা একত্র হয়ে তা মোকাবিলা করতে পার।' তারপরেই তিনি উঠে গেলেন এবং যাওয়ার সময় ভাবিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ডাক্তারের মতে আমার আর কয়দিন যেন বাকি আছে? এরপর ২০ ডিসেম্বর ২০১৯ তিনি আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেলেন।
আবেদ ভাইয়ের হাতে গড়া ব্র্যাকের আজ ৫০ বছর। আশা করি, শুধু ৫০ বছর নয়, ব্র্যাক যুগ যুগ ধরে টিকে থাকবে এবং দারিদ্র্য বিমোচনে ও মানবসেবায় সর্বদা নিয়োজিত থাকবে।
মন্তব্য করুন