ঢাকা সোমবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৩

ভয় থেকে মুক্তি

ভয় থেকে মুক্তি

সুলতানা কামাল

প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২৩ | ১৮:০০ | আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২৩ | ২১:০১

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, সেটা জাতীয় কি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ‘রাজনীতিতে বহুমতের চর্চা’ বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে সন্দেহ নেই। মানবাধিকারের অন্যতম শর্ত অনুযায়ী একটি দেশের নাগরিক কতটা স্বাধীনভাবে নিজের মতামত ব্যক্ত করতে পারে, সেটা একটি জাতি ও জনগোষ্ঠীর অগ্রগতির মানদণ্ড হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। এ কথা অনস্বীকার্য, একটি দেশ বা জাতির চরিত্র সংজ্ঞায়িত হয় সে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির আলোকে। এ কথাও সত্য, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনের কারণে এখনকার সময়ে আগের চেয়ে অনেক বেশি করে জাতীয় রাজনীতিতে বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারেরও একটা বড় সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অতএব শুধু রাজনীতি নয়; অর্থনীতি, সমাজ নির্মাণ বা সংস্কৃতির বিকাশ ও প্রকাশেও নানা মতের সমারোহ লক্ষ্য করা যায় এবং সে জন্য এককভাবে কাউকে দায়ী করা সংগত নয়। তবে মূল দায় অবশ্যই জাতীয় রাজনৈতিক আবহের ওপর বর্তায়।

সমকাল যখন বিষয়টি আলোচনার জন্য নির্ধারণ করেছে, তার পেছনে যে উদ্দেশ্য রয়েছে বলে আমি মনে করছি তা হলো, আমাদের রাজনীতিতে বহুমতের চর্চা থাকা যে অপরিহার্য, সে কথা তুলে ধরা এবং একটি সমাজে বহুমতের সহাবস্থানে যেসব সমস্যা থাকে বা উদ্ভূত হতে পারে, বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা থেকে উত্তরণ ঘটানোর উপায় খোঁজা। আমি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিতে বহুমতের চর্চার যে চিত্র দেখতে পাচ্ছি, যা কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি, তাতে করে রাজনীতিতে এই বিষয়টি নিয়ে আমার চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার তাগিদ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারছি না। একই সঙ্গে মনের সব কথা ব্যক্ত করার আগে দশবার থমকেও দাঁড়াতে হচ্ছে।

আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় প্রফেসর রেহমান সোবহানের মতো ব্যক্তিত্বও এক সাক্ষাৎকারে বলেই ফেলেছেন, তিনি আগে যেসব কথা স্বতঃস্ফূর্তভাবে লিখে ফেলতেন, এখন সে কথা লেখার আগে তাঁকে কলম থামিয়ে ভাবতে হয় লিখবেন কিনা! এখানেই আলোচনায় চলে আসে সমস্যা ও সংকটের কথা। তবে সেখানে থেমে থাকা তো মানুষের ধর্ম নয়, তাই উত্তরণের পথ খোঁজা। 

যাহোক, ফিরে যাই রাজনীতিতে বহুমতের চর্চার কথায় এবং মূলত তা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেই দেখার চেষ্টা। তবে তা দেখেশুনে বুঝতে হলে তো একা একা সম্ভব হয় না। পড়তে হয় সংবাদপত্র, দেখতে হয় দূরদর্শন, কথাবার্তা বলতে হয় সাধারণ মানুষের সঙ্গে– নানা শ্রেণির, নানা পেশার। আমার কাজের ধরনে সে সুযোগটা অপেক্ষাকৃত সহজে ঘটে যায়।  সম্প্রতি ঢাকার বাইরে কয়েকটি জেলা সফর করতে হয়েছে আমার। সেখানে যে মতবিনিময় সভাগুলো অনুষ্ঠিত হয় সেগুলোতে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের অংশগ্রহণকারীরাই উপস্থিত ছিলেন। তাদের কথাবার্তায় মৌলিক যে ভাবনাটি প্রাধান্য পায় তা হলো, কীভাবে সব মানুষের ন্যূনতম মানবিক মর্যাদা রক্ষা করে বেঁচে থাকা যায়।

সেখানে যে সবাই এক সুরে কথা বলেন তা কিন্তু নয়, কারণ সবাই সব বিষয় এক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখেন না। কখনও কখনও আলোচনা যথেষ্ট উত্তপ্তও হয়ে ওঠে। বিশেষ করে নারী অধিকার, নারী নির্যাতন বিরোধী আইন, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয়ে নানা মতের প্রকাশ ঘটে। দেশের উন্নয়ন কী মাত্রায় ঘটছে, তার সুফলভোগী কারা হচ্ছেন– এসব নিয়েও বহুমত শোনা যায়। কিন্তু সাধারণত কেউ কাউকে অপমান করে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বা কারও প্রতি হিংসাত্মক বক্তব্য দেন না। এর মূল কারণ, তারা কোনো স্বার্থ চিন্তা থেকে মতামত ব্যক্ত করেন না। যদি কখনও কেউ তা করেন এবং সবার কথার দর্পণে যখন তাঁর নিজের কাছে সেটা দৃশ্যমান হয়, তিনি নিজেকে শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করেন।

 সভা শেষে নিজেদের মানুষের মর্যাদায় বিশ্বাসী সজ্জন নাগরিক হিসেবে সবার সঙ্গে এক কাতারেই দেখতে চান। কারণ তাদের চেতনার ভিত্তিতে আছে সামষ্টিক মঙ্গল চিন্তা। তাদের মধ্যে নাগরিক সমাজের সদস্যদের সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মী থাকেন, থাকেন নির্বাচিত প্রতিনিধি, এমনকি স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাও। তারা যে সব বিষয়ে সহজে সহমতে উপনীত হন তা নয়, কিন্তু লক্ষ্য অর্জনে বহুমতের চর্চা যে স্বাস্থ্যকর এবং সাধারণের জন্য সুফল বয়ে আনার নানা পথ উন্মুক্ত করে দেয়, সে ব্যাপারে তারা একে অন্যকে মেনে নিতে দ্বিধা করেন না। এই চিত্র আমরা বৃহত্তর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রতিফলিত হতে দেখি কি? এর সহজ উত্তর ‘না’। বরং প্রত্যক্ষ করি ভিন্নমত মানেই বৈরিতা, প্রতিহিংসা, সংঘাত, একে অন্যকে নির্মূল করার উন্মত্ত প্রতিযোগিতা এবং সেখানে ভব্যতার মান রক্ষার কোনো বালাই থাকে না।

আমার অভিজ্ঞতা বলে, এর অন্যতম কারণ আমাদের বর্তমান রাজনীতির মূল লক্ষ্য আর মানুষের মঙ্গল ইচ্ছায় নিহিত নেই। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের লক্ষ্য যেহেতু ছোট হতে হতে তা এখন একটি মাত্র আসনকে ঘিরে আবর্তিত, রাজনীতিকে কোনো বৃহত্তর নৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে চালিত হতে আর দেখতে পাই না। পরস্পরের সঙ্গে মতবিরোধের তীব্রতা তাই এতটা প্রকট, এত সহিংস। ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতার কোনো স্থান সেখানে নেই। নানাজনের নানা মত বিবেচনায় নিতে হলে পরমতসহিষ্ণুতার যে মানসিকতা গঠন করে নিতে হয়, সেই সাংস্কৃতিক অনুশীলনের ধারণাই আজকের রাজনীতিতে অনুপস্থিত। 

আমরা দেখি আমাদের রাজনীতিতে বাক্‌স্বাধীনতা নিয়ে প্রচুর অস্বস্তি আছে, কিন্তু স্বার্থের খাতিরে একেবারে বিরোধী সহিংস মতাবলম্বীদের সঙ্গে আপসের দৃষ্টান্তেরও অভাব দেখি না। এ কথা ঠিক যে বহুমতে অবশ্যই একেবারে বিপরীতধর্মী মতামত থাকার অধিকারকে অস্বীকার করা যায় না। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের ১৯ ধারা বলছে, ‘প্রত্যেকেরই  মতামতের ও মতপ্রকাশের স্বাধিকার রয়েছে; বিনা হস্তক্ষেপে মতামত পোষণ এবং যে কোনো উপায়ে ও রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে তথ্য ও মতামত সন্ধান, গ্রহণ ও জ্ঞাত করার স্বাধীনতা এই অধিকারের অন্তর্ভুক্ত।’ আমাদের সংবিধানের ৩৯ ধারায়ও বাক্‌, বিশ্বাস ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। তবে অত্যন্ত অস্বচ্ছ কিছু শর্তও আরোপ করা হয়েছে। তৎসত্ত্বেও সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিন্নমত পোষণের অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া আছে।

এখানে উল্লেখ করতে চাই, এই ঘোষণা এসেছে কিন্তু মানবজাতির বহু কষ্টের উপলব্ধি থেকে। দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধ, যা মানুষের জীবন, মান-মর্যাদা, পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসার ধারণাকে তছনছ করে দিয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে রচিত মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের মুখবন্ধে তাই পড়ি– ‘যেহেতু মানবিক অধিকারসমূহের প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণা মানবজাতির বিবেকের পক্ষে অপমানজনক বর্বরোচিত কার্যকলাপে পরিণতি লাভ করেছে এবং সাধারণ মানুষের সর্বোচ্চ আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হিসাবে এমন একটি পৃথিবীর সূচনা ঘোষিত হয়েছে, যেখানে মানুষ বাক্‌ ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা এবং ভয় ও অভাব থেকে নিষ্কৃতি ভোগ করবে; ...মানবিক অধিকারসমূহ অবশ্যই আইনের শাসনের দ্বারা সংরক্ষিত করা উচিত...।’ একই সঙ্গে আমরাও আমাদের সংবিধানটি পেয়েছিলাম ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আর কোটি কোটি মানুষের ওপর অমানুষিক অত্যাচার, নির্যাতন ও অপমানের বিনিময়ে। 

এখানে একটি সাবধানবাণী উচ্চারণ করতে চাই– মানবাধিকার বাক্‌স্বাধীনতাকে নিঃশর্ত মর্যাদা দিয়েছে, সহিংস আচরণকে কখনোই নয়।  যে কথা বলছিলাম, একদিকে আমাদের রাজনীতিতে বহুমতের চর্চা প্রায় নিষিদ্ধ আবার সুবিধাবাদী আপসকামিতায় বিপরীত মতের প্রচার-প্রসারে শুধু নির্লিপ্ততা নয়; বরং সুপ্ত সমর্থনও দেখা যায়। এত গৌরবের, এত বেদনা আর ত্যাগের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশের নাগরিকরা আজ প্রায় বাক্‌রুদ্ধ। কী কথা বললে কী পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে সেই দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত। অথচ এ দেশের ইতিহাস নাগরিক, সামাজিক আর রাজনৈতিক শক্তির মিলিত পথচলায় সমৃদ্ধ।

সব সংগ্রাম-আন্দোলনে এ দেশের মানুষ যার যার অবস্থান থেকে সোচ্চার থেকেছে। সোৎসাহে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। আমাদের ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান আর মুক্তিযুদ্ধ তার উজ্জ্বলতম স্বাক্ষর। সেখানে সবাই কি এক মতের অনুসারী বা এক দলের সদস্যই ছিল? তা তো নয়। দলমত নির্বিশেষে সাধারণ জনতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সবার লক্ষ্য ছিল দেশমাতৃকাকে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করা। আর প্রতিজ্ঞা ছিল সব মানুষের সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। সেখানে বহুমতের সহাবস্থানে বড় কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয়নি।

পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ের রাজনীতিতে যখন মসনদ দখলের ধারার অনুপ্রবেশ ঘটল, রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের সব অনুপ্রেরণা ও আকাঙ্ক্ষাকে অস্বীকার করার নীতি গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত সর্বত্র সাম্প্রদায়িক ও বিভাজনের সামাজিক সংস্কৃতি সঞ্চারিত করার বিষময় বীজ বপন করা হলো, তখন থেকে রাজনীতিতে বহুমতের চর্চা প্রকাশ্য হুমকির মুখে পড়ল। এর আগে যে আমরা পরিপূর্ণভাবে বহুমতের চর্চাকে বিকশিত হতে দিতে পেরেছি, সেই দাবি জোরগলায় করতে পারি না। তারপরও ইতিহাস সাক্ষী দেশের প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে সপরিবারে এবং তাঁর আত্মীয় ও সহযোগীদের নির্মমভাবে হত্যা করে সেই নিকৃষ্ট অপরাধকে যথার্থতা দেওয়ার জন্য সামরিকতন্ত্রী শাসকরা মানুষের মন থেকে মুক্তিযুদ্ধকে মুছে ফেলার উদ্দেশ্যে একদিকে তাদের কণ্ঠ রোধ করার সব আয়োজন সম্পন্ন করে; অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী মতবাদকে উল্লেখযোগ্য সফলতার সঙ্গে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবিষ্ট করাতে সফল হলো।

বাক্‌স্বাধীনতা চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলো। আমাদের কষ্টের কারণ হয়ে রইল স্বৈরাচারের পতন এবং গণতন্ত্রের অভিযাত্রার পরেও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যকে ঘায়েল করার জন্য সেই একই কৌশল বজায় রাখল। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির সামনে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রাজনীতিতে শুদ্ধতা ফিরিয়ে আনার প্রণোদনাকে দুঃখজনকভাবে বারবার পরাভূত হতে দেখতে হয়েছে এবং রাজনীতিতে বহুমতের চর্চা বিপন্নতার আবর্তে ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। তবে বাংলাদেশে এখন ক্ষমতার স্বার্থে বহুমত চর্চার এক অদ্ভুত প্রকাশ আমরা দেখতে পাই। প্রতিদিন আমরা মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দেশ গড়ার প্রত্যয় ও নির্দেশ শুনছি ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে। একই সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা বাহিনীতে তাদেরই নিয়োজিত অথবা সমর্থক ব্যক্তিদের সেই আদর্শবিরোধী কথাবার্তা এবং কার্যকলাপে জনগণ অতিষ্ঠ। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়,  নারীসমাজ, আহমদিয়া মুসলিম জামাতের প্রতি প্রকাশ্যে যে ধরনের নিকৃষ্ট ভাষা ব্যবহার করা হয়, যে ধরনের নির্যাতন করা হয়, সরকারের পক্ষ থেকে তা প্রতিরোধের যথাযথ উদ্যোগের কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। বরং ‘বাক্‌স্বাধীনতার’ নামে এমন আচরণকে প্রশ্রয় দিতেই দেখা যায়।

অন্যদিকে নানা ধরনের নিরাপত্তা বিধানের অজুহাতে একের পর এক নিপীড়নমূলক আইন প্রণয়ন করে যারা কোনো না কোনোভাবে সরকার অথবা তাদের সমর্থক ও সমর্থিত গোষ্ঠীর অসংগতি, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তপনা নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করে, তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে রাষ্ট্রের ক্ষিপ্রতায় অবাক না হয়ে পারা যায় না। বিরোধী রাজনৈতিক অংশগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। বাংলাদেশে বহুমত চর্চার এই অপরিচ্ছন্ন অবস্থার উৎস খুঁজতে বেশি দূর যেতে হবে না। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর জনবিচ্ছিন্নতার মধ্যেই এর কারণ নিহিত বলে আমি মনে করি। আরেকটি কারণ হলো, রাজনৈতিক দলগুলোর যেনতেন ক্ষমতায় আরোহণ বা টিকে থাকার মানসিকতা। নির্বাচনের মতো গণতন্ত্রের একটি মৌলিক শর্ত, যা জনগণের পবিত্র অধিকার, তাকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর যে আচরণ, তাতে তারা যে তাদের ক্ষমতার উৎস হিসেবে জনগণকে প্রাধান্য দেয় না, সেটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। তার ফলে রাজনীতি ঘোলাটে চরিত্র ধারণ করে। এ কথার সমর্থনে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে একটি উদ্ধৃতি দিতে পারি। চুয়ান্নর নির্বাচন নিয়ে ভাসানীর সঙ্গে কথোপকথনের এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে আইনসভায় আওয়ামী লীগ বিরোধী দল হয়ে কাজ করবে।

রাজনীতি স্বচ্ছ থাকবে, জগাখিচুড়ি হবে না। আদর্শহীন লোক নিয়ে ক্ষমতায় গেলেও দেশের কাজ হবে না। ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার হতে পারে।’ একইভাবে গান্ধী যে ‘সাতটি সামাজিক পাপ’ চিহ্নিত করেছেন, তার প্রথমটাই হলো ‘নীতিহীন রাজনীতি’। নীতিহীন রাজনীতি সমাজে সুস্থ মত প্রকাশকে ভয় পায়, অন্য সবাইকেও ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে ঠেলে দেয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরিত হতে হলে রাজনীতিকদের জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে। সরকারকে সত্যিকার অর্থে জনগণকে ক্ষমতার উৎস হিসেবে চিহ্নিত করে তার স্বীকৃতি দিতে হবে, জনগণের ওপর আস্থা রাখতে হবে। সরকার আর জনগণ একে অন্যকে ভয় পেয়ে চলার রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেতে হবে। মানুষকে কথা বলতে দিতে হবে।

লেখক মানবাধিকার কর্মী সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

আরও পড়ুন