মামলার বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) মাধ্যমে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমানোর বিষয়টি বারবার আলোচানায় এলেও তাতে সাড়া কম। ২০১৯ সালে এ উদ্যোগ নেওয়ার পর গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এ উপায়ে ব্যাংকগুলোর ১ হাজার ২৮টি ঋণের বিপরীতে মাত্র ৬৭২ কোটি টাকা আদায় হয়েছে। দেশের ৬০টি ব্যাংক ১ লাখ ৯১ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা আদায়ে ২ লাখ ১৪ হাজারের মতো মামলা করেছে। অর্থ আদায়ে অভিজ্ঞতার অভাব, বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতিসহ নানা কারণে মামলার বাইরে সমঝোতার এ পদ্ধতিতে অর্থ আদায়ে ব্যাংক বা গ্রাহকের আগ্রহ কম।

ব্যাংকাররা জানান, মামলা করেও যে অনেক অর্থ আদায় করা যাচ্ছে, তেমন নয়। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর করা ২ লাখের বেশি মামলার মধ্যে মাত্র ১৩ হাজার ১১৫টি নিষ্পত্তি হয়েছে। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৩ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা। এর মানে খুব সামান্য অর্থ আদায় হয়েছে। অর্থঋণ আদালতে অনেক দিন ধরে বিচরক সংকট রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে মামলা চলে। আবার অর্থঋণ আদালতে কোনো মামলা নিষ্পত্তির পর আদায় প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে দিতে ঋণখেলাপিরা এক আদালত থেকে আরেক আদালতে মামলা করেন। সব মিলিয়ে মামলার প্রক্রিয়া শেষ করতে বছরের পর বছর লেগে যায়।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, যাদের মাধ্যমে সমঝোতা হবে, তাদের গ্রহণযোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতার অভাবে অনেকে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতে রাজি হন না। আবার খেলাপিদের বেশিরভাগই ইচ্ছাকৃত খেলাপি। তারা চান আদালতের মাধ্যমে অর্থ আদায় প্রক্রিয়া যত দীর্ঘ করা যায়। তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ কমানো ও অর্থ আদায় প্রক্রিয়া দ্রুত করতে আমাদের বিচারিক প্রক্রিয়ায় কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। অনেক অর্থ ঋণ আদালতে বিচারক থাকেন না। এ ছাড়া অর্থঋণ আদালতে দীর্ঘদিন পর একটি মামলা নিষ্পত্তির পর আবার অন্য আদালতে কেন যাবে। এসব সমাধান করতে হবে।

আদালতের নির্ধারিত প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে স্বল্পতম সময়ে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রক্রিয়াকে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বা এডিআর বলে। সমঝোতার মাধ্যমে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায়ে বর্তমানে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। যদিও আরবিট্রেশন বা সালিশি আইন-২০০১-এর আওতায় কিছু মামলা নিষ্পত্তি হয়। তবে এ প্রক্রিয়ায় শুধু অর্থঋণ আদালতে মামলা হওয়ার পর উভয় পক্ষের সমঝোতার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা যায়। এ ক্ষেত্রে তৃতীয় একটি পক্ষকে সালিশি নিয়োগ দেন আদালত। এরকম বাস্তবতায় ২০১৯ সালে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) গাইডলাইনস ফর ব্যাংকস’ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু এখনও এ নীতিমালা হয়নি। নীতিমালা হলে ব্যাংক চাইলে কোনো মামলা ছাড়াই ২৫ কোটি টাকা পর্যন্ত সমঝোতায় আদায় করার সুযোগ পাবে।

আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের অন্যতম একটি শর্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি কমাতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রীয় ব্যাংগুলোর খেলাপি ঋণ নামাতে হবে ১০ শতাংশের নিচে। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ৫ শতাংশের নিচে নামাতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের এ শর্তে সায় দিয়ে এরই মধ্যে ১০টি ‘দুর্বল’ ব্যাংক আলাদাভাবে তদারকির উদ্যোগ নিয়েছে। এসব ব্যাংকে সমন্বয়ক নিয়োগের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমানোসহ বিভিন্ন সূচকে উন্নতির লক্ষ্যে সমঝোতা স্মারক সই করা হচ্ছে। এর বাইরে অনেক ব্যাংকে পর্যবেক্ষক রয়েছে। যদিও সমন্বয়ক বা পর্যবেক্ষকের কথায় তেমন কাজ হয় না।

জানা গেছে, নানা উপায়ে গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ কম দেখিয়েছে অনেক ব্যাংক। যে কারণে আগের প্রান্তিকের চেয়ে ১৩ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা কমে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকায় নামে। তবে ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে এখন নতুন করে অনেক খেলাপি ঋণের তথ্য আড়ালের ঘটনা ধরা পড়ছে। যেমন– বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ দেখিয়েছিল ৬ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনের পর অন্তত ১০ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা বা ২৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ খেলাপির তথ্য উদ্ঘাটন হয়েছে। ব্যাংকটি খেলাপি ঋণের পরিমাণ থেকে প্রয়াত ঢাকার সংসদ সদস্য আসলামুল হকের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি অনাদায়ী ঋণ অন্তর্ভুক্ত নেই। আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে অনাদায়ী হলেও ওই ঋণ খেলাপি দেখানো যাবে না।