সমকাল: এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর বাংলাদেশ ২০২৯ সাল পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নে ‘এভরিথিং বাট আমর্স’-এর আওতায় শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাবে। এরপর আমরা কি বড় সংকটে পড়ব?

মোস্তফা আবিদ খান: এলডিসি তালিকাভুক্ত দেশ হিসেবে আমরা বর্তমানে ইইউতে ১২ শতাংশের মতো শুল্ক সুবিধা পাই, ২০২৯ সালের পর যা আর পাওয়া যাবে না। এতে ওইসব দেশে পণ্য রপ্তানিতে ১২ শতাংশ ব্যয় বাড়বে। ভিয়েতনামের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনয়নের এফটিএ থাকায় তারা শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। তাই ভিয়েতনামের সঙ্গে আমরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ব। এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

সমকাল: ইইউতে জিএসপি প্লাস পাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সম্ভাবনা কতটুকু? এ সুবিধা নিশ্চিত করতে আমাদের কী করতে হবে?

মোস্তফা আবিদ খান: প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী কোনো একটি পণ্য তাদের আমদানির ৭ দশমিক ৪ শতাংশের বেশি হলে সেই পণ্যে জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়া যাবে না। নতুন প্রস্তাবে তারা এ নিয়ম তুলে দিয়েছিল। তবে অন্য আরেকটা নীতিতে একই ধরনের শর্ত থাকায় ২০২৯ সালের পর অন্যান্য পণ্যে জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়া গেলেও তৈরি পোশাক পাবে না। আরও চিন্তার কথা, এসব সুবিধা শুধু এলডিসি ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের জন্য প্রযোজ্য। বাংলাদেশ সরকারের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ২০৩১ সালে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া। আমরা যদি এ লক্ষ্য অর্জন করতে পারি, তাহলে তারপর থেকে আর কোনো জিএসপি সুবিধা পাওয়া যাবে না। তাই সুবিধার জন্য বসে না থেকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার প্রস্তুতি নিতে হবে।

সমকাল: আমরা ২০২৯ সালের পর ইইউসহ উন্নত দেশগুলোতে বাড়তি কয়েক বছর বর্তমানের শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। এ উদ্যোগকে আপনি কীভাবে দেখেন?

মোস্তফা আবিদ খান: এলডিসি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরও শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখার জন্য বিশ্ববাণিজ্য সংস্থাতে (ডব্লিউটিও) বাংলাদেশসহ অন্যান্য এলডিসি দেশ আবেদন করেছে। এটা ভালো উদ্যোগ। এ ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

সমকাল: কোনো কোনো পর্যালোচনায় বলা হচ্ছে, এলডিসি-পরবর্তী পর্যায়ে ইইউতে আমাদের রপ্তানিতে চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি অনেক সম্ভাবনাও রয়েছে। আপনার কাছে কী মনে হয়?

মোস্তফা আবিদ খান: আমরা এখনও ইইউর বাজারেই সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করি। আরও বেশি রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। এমনকি এখনই সুযোগটা বেশি। আমরা সে সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছি না। এজন্য আমাদের দক্ষতা বাড়িয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। কিন্তু এখনও আমাদের সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে।

সমকাল: বেসরকারি খাতে কী ধরনের প্রস্তুতি প্রয়োজন বলে মনে করেন?

মোস্তফা আবিদ খান: বেসরকারি খাতে অবশ্যই দক্ষ জনবল ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। বেসরকারি খাত অনেক সুবিধা পেয়েছে। এ কারণে তারা দক্ষতার ওপর তেমন জোর দেয়নি। অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা থেকে পরবর্তী ধাপে যেতে অবশ্যই দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। দক্ষতা বাড়িয়ে স্থানীয় জনবল দিয়ে পশ্চাৎসংযোগ শিল্পের ব্যবস্থা করা সম্ভব হলে বৈদেশিক মুদ্রা দেশেই থেকে যাবে। কারখানাগুলোর উৎপাদন খরচও কমবে। পণ্য বৈচিত্র্যকরণেও বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের কোনো নীতি যেন বাধা হয়ে না যায়, সে বিষয়টি সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে।

সমকাল: আগামী ফেব্রুয়ারিতে ডব্লিউটিও মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন। সম্মেলনে আমাদের কৌশল কেমন হওয়া উচিত?

মোস্তফা আবিদ খান: এলডিসি থেকে উত্তরণের পর আমাদের যেসব চ্যালেঞ্জ আসবে, সেগুলো যথাযথভাবে সম্মেলনে তুলে ধরতে হবে। একই সঙ্গে তা মোকাবিলায় যৌক্তিক সহায়তা চাইতে হবে। এ ছাড়া নতুন নতুন ইস্যু যেমন– ই-কমার্স, বিনিয়োগ সুবিধার বিষয়ে আমরা কী করব, সেগুলো স্পষ্ট করা জরুরি। আমাদের সুবিধার জন্য ডব্লিউটিওর নীতিতে কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন, সেসব বিষয়েও একটা অবস্থান নিতে হবে।

সমকাল: সরকার সম্প্রতি ‘ন্যাশনাল ট্যারিফ পলিসি’ জারি করে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি করেছে। এ কমিটি ২০২৬ সাল নাগাদ পণ্য আমদানিতে অযৌক্তিক শুল্ক কমিয়ে আনবে। এ পদক্ষেপকে কীভাবে দেখছেন?

মোস্তফা আবিদ খান: আমাদের শিল্প তথা সার্বিক অর্থনীতি আমদানিনির্ভর। আমদানি কার্যক্রম যত সহজ করা যাবে, অর্থনীতির জন্য ততই মঙ্গল। বাংলাদেশে আমদানির বিভিন্ন স্তরে অযৌক্তিক শুল্ক রয়েছে, তা যতটা সম্ভব কমিয়ে সহজ করতে হবে। একই সঙ্গে বন্দর থেকে পণ্য খালাস প্রক্রিয়াও সহজ করতে হবে।

সমকাল: এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের সার্বিক প্রস্তুতি কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?

মোস্তফা আবিদ খান: সরকারের নীতিতে সংস্কারে গুরুত্ব দিতে হবে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। যাতে দক্ষ জনবল গড়ে ওঠে। অবকাঠামো উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে হবে। বেসরকারি খাতকে দেওয়া সুরক্ষা কমিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে নীতি সহায়তা বাড়াতে হবে।

সমকাল: মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করার বিষয়ে এখন পর্যন্ত খুব বেশি অগ্রগতি নেই। সামগ্রিকভাবে বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

মোস্তফা আবিদ খান: চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশকে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) করতে হবে। তবে এটি অনেক বড় কর্মযজ্ঞ। চাইলেই এফটিএ করা যায় না। শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে আমাদের কিছু দিতে হয়নি। কিন্তু এফটিএ করতে হলে আমাদেরও ছাড় দিতে হবে। এ জন্য আমাদের অনেক নীতিতে সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। তাই অনেক সমীক্ষা ও সমপর্যায়ের দেশের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করেই এফটিএ করা যৌক্তিক হবে।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মেসবাহুল হক