ঢাকা শনিবার, ২১ জুন ২০২৫

রানির মৃত্যুতে আমি শোক জানাতে পারি না: কেনিয়ার আইনজীবী

রানির মৃত্যুতে আমি শোক জানাতে পারি না: কেনিয়ার আইনজীবী

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ/ ছবি- রয়টার্স।

হাসনাত কাদীর

প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ০৬:২৪ | আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | ০১:১২

ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে শোকের স্রোতটি উৎসাহব্যঞ্জক। যুগের পর যুগ ব্রিটিশ শাসনে পরাধীনতার যাতনা ভোগ করেছে যারা, তারাও রানির গুন গাইছে। কেনিয়ার সদ্য বিদায়ী প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা তো ‘বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে আইকনিক ব্যক্তিত্ব’ বলেই ঘোষণা করলেন রানিকে। অথচ তাঁর দাদা পরাধীন কেনিয়ায় এই রানির শাসনামলেই কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর ভূখণ্ডের জনগণ ভোগ করেছে গ্লানি ও যাতনা। 

এলিজাবেথ-বন্দনার হাওয়ায় ওড়ানো পাল কম নয়। রানির প্রশংসা করে সরকারি সমবেদনা জানিয়ে শোক ঘোষণা করা হচ্ছে। এককালে যেসব দেশ ছিল ব্রিটিশদের উপনিবেশ, তারাও ঘোষণা করেছে রাষ্ট্রীয় শোক। কিন্তু এই রাষ্ট্রীয় শোকের বিপরীতে আরেক চিত্র উঠে এসেছে বার্তা সংস্থা এপির প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, আফ্রিকা, এশিয়া, ক্যারিবিয়ানসহ নানা দেশের সাধারণ মানুষের মনে রানির মৃত্যুতে শোকের বদলে এক মিশ্র অনুভূতি কাজ করছে। তাদের মনে অতীত ইতিহাসের তিক্ত স্মৃতি জ্বলজ্বলে ও যাতনার। অনেকের মনেই নাড়া খেয়েছে অতীত অপমানের যাতনা, দুঃখ, ক্ষোভ ও ক্রোধের জটিল অনুভূতি।

রানির মৃত্যুতে এসব অঞ্চলের সাধারণ মানুষ নতুন করে আলোচনা করছেন ঔপনিবেশিকতা, দাসত্ব, পরাধীনতা ও ‘সম্পদ লুটপাট’ নিয়ে। বলছেন, দীর্ঘ সাত দশক ধরে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ মূলত এসবেরই প্রতিনিধিত্ব করতে এসেছিলেন। ‘তিনি তা করেছেন। তিনি মারা গেছেন। আর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ জন্য কখনই ক্ষমা চাননি’, এপি’কে বলেন জ্যামাইকার অ্যাক্টিভিস্ট নাদিন স্পেন্স। 

এলিস মুগো নামের কেনিয়ার এক আইনজীবী অনলাইনে একটি ছবি শেয়ার করেছেন। ছবিটি ১৯৫৬ সালের একটি ‘মুভমেন্ট পাস’র। তখন রানির সিংহাসনে বসার চার বছর চলে। সেটি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ‘মাউ মাউ বিদ্রোহের’ বছর। এই বিদ্রোহের প্রতি কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল ব্রিটেন। এক লক্ষেরও বেশি কেনিয়ানকে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছিল। সে সময় মুগোর দাদির মতো অন্যরাও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে ব্রিটিশদের অনুমতির নিতে বাধ্য হয়েছিল।

রানির মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পর এই মুগো টুইটে লিখেছেন, ‘আমাদের প্রায় সবার দাদা-দাদিই (রানির শাসনামলে) ভোগ করেছেন চরম নিপীড়ন। আমি (তাঁর মৃত্যুতে) শোক প্রকাশ করতে পারি না।’ সাধারণ মানুষের মনে পড়েছে পুরোনো ক্ষতের স্মৃতি। ক্ষোভ হওয়াটাও অমূলক নয়। তাই অনেকেই অতীতের দাসত্ব ও নিপীড়নের জন্য ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। 

এলিজাবেথের শাসনামলেই ঘানা থেকে জিম্বাবুয়ে পর্যন্ত আফ্রিকান দেশগুলো স্বাধীনতার স্বাদ আহরণ করে। স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে ক্যারিবীয় দ্বীপ ও আরব উপদ্বীপের প্রান্তে জাতিগুলো। তবে রানির মৃত্যুর পর ক্যারিবীয় অঞ্চলে মিশ্র মতামত পাওয়া গেছে। সেখানে কিছু দেশ রাষ্ট্রপ্রধানের আসন থেকে ব্রিটিশ রাজাকে সরিয়ে দিচ্ছে। 

মধ্যপ্রাচ্যের অনেক বাসিন্দা মনে করেন, ব্রিটিশদের ‘খামখেয়ালি সীমান্ত নির্ধারণ’ এই অঞ্চলের অনেক সংঘাতের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। ঔপনিবেশিক নানা কর্মকাণ্ডের জন্য ব্রিটেনকে তাঁরা দায়ী মনে করে। গতকাল শনিবার হামাস শাসকরা রাজা তৃতীয় চার্লসকে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের সিদ্ধান্তগুলো পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান। 

সাইপ্রাসে অনেকে ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে চালানো গেরিলা প্রচারণার কথা স্মরণ করেন। চার বছর ধরে চলা ওই প্রচারণাকালে ৯ জনকে ফাঁসি দিয়েছিল ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে রানির উদাসীনতার কথা এখনো ভোলেনি সাধারণ মানুষ। দায়ভার রানি এড়াতে পারেন না বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাসোসিয়েশন অব ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব সাইপ্রিয়ট ফাইটারস’র সভাপতি ইয়ানিস স্প্যানোস। তাঁর মতে, রানির মৃত্যুর পরে এখন ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস আড়াল করার এবং একে ভিন্নভাবে মোকাবিলার চেষ্টা চলছে। 

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন। পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে ভারত উপমহাদেশে সূচনা হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের। প্রায় ২০০ বছর পর ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পরাধীনতা থেকে মুক্তি পায় ভারত। এপি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেই ভারত এখন আকারে ব্রিটিশ অর্থনীতিকেও ছাড়িয়ে গেছে। ভারতে ঔপনিবেশিক নাম ও চিহ্ন মুছে ফেলার প্রচেষ্টা চলছে। ধীরেন সিং নামের ৫৭ বছর বয়সী দিল্লির এক উদ্যোক্তা মনে করেন, আজকের বিশ্বে রাজা-রানি নিয়ে ভাবার সময় তাদের নেই। কারণ, ভারত এখন বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ। 

বাংলাদেশের অনেক মানুষও রানির অতি স্তুতির বিপক্ষে কথা বলছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে বেশ আলোচনা দেখা গেছে। মাহমুদুল হাসান পারভেজ নামের এক গণমাধ্যমকর্মী লিখেছেন, ‘ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথ নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। দুঃখ নেই। শোক নেই। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে রানি এলিজাবেথ কে? মারা গেছেন জাস্ট একটা ইনফরমেশন। পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষের রক্ত চুষে যে সাম্রাজ্য গড়ে তোলা হয়েছে, সেই সাম্রাজ্যের রানি নিয়ে শোক প্রকাশ করার কিছুই দেখি না।’ 

আশিক মেহেদী নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মতে, ‘তিনি আমাদের রানি ছিলেন না। তিনি যে রাজতন্ত্রের রানি সেই রাজতন্ত্রের হাতে আমার পূর্ব পুরুষের রক্ত লেগে আছে। তাদের জন্য আমার দেশ দুর্ভিক্ষে পড়ে লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে। আর আফ্রিকার এই অবস্থাও তার হাত দিয়েই। শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ার আগে একটু চিন্তা করি- আমার এইসব শোক দেখলে মুক্তির মন্দির সোপানতলে যত প্রাণ হয়েছে বলিদান, সবাই লজ্জা পেতো!’

একুশ তপাদার নামে একজন লিখেছেন, ‘এলিজাবাথের পূর্বসূরিদের কারণে ভুগতে হয়েছে উপমহাদেশকে। সমৃদ্ধ অঞ্চল ব্যাপক লুটপাটে হয়েছে নিঃস্ব।’

ভাইরাল এক ফেসবুক পোস্টে দেখা গেছে, ‘এই উপমহাদেশকে যারা ২০০ বছর গোলামির জিঞ্জিরে বেঁধে রেখেছিল তাদের প্রতি এখন শ্রদ্ধা জিইয়ে রাখতে হবে!’ 

আরও পড়ুন

×